ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারত গম রফতানি বন্ধ করেনি ॥ বাণিজ্যমন্ত্রী

রাইস ব্র্যান ও সরিষার তেল উৎপাদন বাড়ানো হবে

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ১৯ মে ২০২২

রাইস ব্র্যান ও সরিষার তেল উৎপাদন বাড়ানো হবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ভোজ্যতেলের সঙ্কট কাটাতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে রাইস ব্র্যান ও সরিষার তেলের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারী সংস্থা টিসিবিকে সরাসরি বিদেশ থেকে খাদ্যপণ্য আমদানির পরামর্শ দিয়েছে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, টিসিবি ব্যবসায়ীদের অমদানিকৃত পণ্য কিনে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করছে। এতে বাজারে পণ্যের জোগান কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নিত্যপণ্যের দাম কমাতে হলে বিদেশ থেকে সরাসরি আমদানি করা প্রয়োজন বলে মনে করছে এফবিসিসিআই। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পামতেল ও সয়াবিনের ব্যবহার কমিয়ে সরিষা এবং রাইস ব্র্যান তেলের উৎপাদন বাড়ানো হবে। গ্লোবাল এ ক্রাইসিসকে সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে। ভোজ্যতেলের এখন যে অবস্থা, তাতে আশা করছি আর কোন সঙ্কট হবে না। এছাড়া ভারত গম রফতানি বন্ধ করেনি বলেও তিনি জানিয়েছেন। বুধবার দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটির দ্বিতীয় সভা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সভায় তিনি বলেন, বার্ষিক চাহিদার ৯০ শতাংশ ভোজ্যতেল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করতে হয়। এ কারণে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় তেলের উৎপাদন বাড়ানো জরুরী হয়ে পড়ছে। দেশে এখন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন রাইস ব্র্যান অয়েল উৎপাদন হয় এবং এটি ‘খুব সহজেই’ ৭ লাখ টনে উন্নীত করা সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে রাইস ব্র্যানের সুফল সম্পর্কে প্রচার বাড়াতে হবে। ডাক্তারদের এ নিয়ে কথা বলতে হবে। পাশাপাশি সরিষার উৎপাদন বাড়ানোর সম্ভাবনার কথাও কৃষি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে। এছাড়া দেশে সয়াবিন উৎপাদন হচ্ছে। কৃষিতে নানামুখী কর্মসূচীর মাধ্যমে সয়াবিন বীজের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারী নীতিগত সহায়তা বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, সয়াবিন ও পামঅয়েল খাওয়াতে এদেশে এক সময় ব্যাপকহারে বিদেশী কোম্পানিগুলো মার্কেটিং করেছে। এর ফলে তেলের বাজারে সয়াবিন ও পামঅয়েলের আধিপত্য বাড়ে। কিন্তু এদেশে সব সময় সরিষা, তিল, মসনে এবং ভেন্না থেকেও বিপুল পরিমাণ তেল উৎপাদন হতো। শুধু তাই নয়, এসব তেল দিয়ে চাহিদা পূরণ করতেন দেশের মানুষ। কিন্তু ভোজ্যতেল বিশেষ করে সয়াবিন ও পামঅয়েলের ব্যাপক মার্কেটিংয়ের কারণে দেশীয় উৎপাদন হ্রাস পেয়ে তলানিতে এসে ঠেকেছে। এ অবস্থায় তেল জাতীয় সব ধরনের বীজের উৎপাদন বাড়িয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি মহামারীর মধ্যে ভোজাতেলের বাজারে যে অস্থিরতার শুরু হয়েছিল, তিন মাস আগে ইউক্রেন যুদ্ধের পর তা আরও চড়তে থাকে। এ পরিস্থিতিতে ভোজ্যতেল আমদানির ভ্যাট ও শুল্ক কমিয়ে আনা হয়। তাতে বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হলেও ঈদের আগে খুচরা বাজার থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যায় সয়াবিন তেল। এরপর সরকার সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪০ টাকা বাড়ালেও আগের তেল অনেক ব্যবসায়ী মজুদ রেখে বাড়তি দরে বিক্রি করছেন বলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের অভিযানে প্রকাশ হয়। এই পরিস্থিতিতে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমানোর বিষয়টি আলোচনায় আনা হচ্ছে। সয়াবিনের বিকল্প হিসেবে রাইস ব্র্যান ও সরিষার তেল উৎপাদন বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। টাস্কফোর্সের বৈঠকে ভোজ্যতেল ছাড়াও পেঁয়াজ, গম ও লবণের মূল্য এবং সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ভারত গম রফতানি বন্ধ করছে এটা কিন্তু সঠিক নয়। এ ব্যাপারে ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বাংলাদেশের জন্য রফতানি বন্ধ রাখা হয়নি। এ কারণে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে গম ও ময়দার দাম বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। দেশে গমের মজুদ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে এবং সঙ্কট তৈরি হওয়ার কোন কারণ নেই। তিনি বলেন, জিটুজি ভিত্তিতে আমদানি চালু রয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়ে বাংলাদেশী কোন ব্যবসায়ী আমদানি করতে চাইলে সেই সুযোগ করে দেয়া হবে। রফতানি বন্ধের খবরের সমালোচনা করে তিনি জানান, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মেঘ দেখলেই বলে ঝড় এসে গেল। এখানেও সেটি হয়েছে। পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২২ টাকা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এর বাইরে বড় পরিমাণের পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। এখন আমাদের ভাবনার বিষয় হচ্ছে আমরা কত দামে পেঁয়াজ খাব। কৃষকদেরও কিছু প্রণোদনা দিতে হবে তাহলে তারা উৎপাদন বাড়াবে। গত বছর কৃষক পেঁয়াজের ভাল দাম পেয়েছে এবার আড়াই লাখ টন উৎপাদন বাড়িয়েছে। পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সরকার সতর্ক রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এখন আমদানি অনুমোদন বন্ধ করা আছে। প্রয়োজন হলে সেটা চালু করে দেয়ার সুযোগ সরকারের রয়েছে। প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে লবণের দাম বেশি বলে বৈঠকে আলোচনা উঠলে মন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে অভ্যন্তরীণ বাজারে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবেলায় সবাইকে মিলেমিশে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। ডলারের দাম বাড়ায় সমস্যা তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, গত দুই বছর আমদানি কম ছিল। এখন খুলে যাওয়ায় ক্যাপিটালে প্রভাব পড়েছে, দুই বছরের চাপ পড়েছে এক সঙ্গে। সবকিছু মিলে একটা প্রভাব পড়েছে। আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভে চাপ পড়েছে। গত দুই বছর আমদানি কমায় বেড়েছিল রিজার্ভ। এখন চাপ পড়ায় এই সমস্যা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শ্রীলঙ্কায় বিপদ বলে আমাদের বিপদ তা তো নয়। আমরা তো তাদের সহায়তা করেছি। আমাদের ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রী এটি নিয়ে সুন্দরভাবে বলেছেন আমাদের দেশে বৈশ্বিক প্রভাব পড়েছে, সাশ্রয়ী হতে হবে। বৈঠকে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এসএইএম সফিকুজ্জামান, টিসিবির চেয়াারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরিফুল হাসান, এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি আমিন হেলালী ও বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, গোয়েন্দা সংস্থা, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রতিযোগিতা কমিশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের বাজার অস্থির। অনেক পণ্যের ঘাটতিও আছে। বাড়ছে দাম। তবে সে দিক থেকে বাংলাদেশ এখনও বেশ স্বস্তিতে রয়েছে। দেশে যা হয়েছে সেটি কিছু ব্যবসায়ীর অপতৎপরতার কারণে হয়েছে। যার দায়ভার পুরো ব্যবসায়ী সমাজের ওপর পড়ছে। সরকার সে দিক থেকে সতর্ক। এখানে যা করার করছে। তবে শঙ্কা কাটেনি। তিনি বলেন, সামনে কোরবানির ঈদ। সেখানে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। ভবিষ্যতে এসব পণ্য মজুদ করে কেউ যাতে সুযোগ নিতে না পারে সে জন্য যার যার জায়গা থেকে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। টিসিবিকে সরাসরি আমদানির পরামর্শ ॥ সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবিকে সরাসরি বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির পরামর্শ দিয়ে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির পরামর্শ দিয়েছে ফেডারেশ অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। টাস্কফোর্স কমিটির বৈঠকে অংশ নিয়ে সংগঠনটির সহ-সভাপতি আমিন হেলালী বলেন, টিসিবি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পণ্য কেনায় বাজারে নিত্যপণ্যের সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। অথচ টিসিবি যদি সরাসরি আমদানি করে বিক্রি কার্যক্রম চালু রাখত তাহলে এ পণ্যের বাড়তি জোগান হতো বাজারে। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। তিনি জানান, কোরবানি সামনে রেখে টিসিবি সারাদেশে কোটি পরিবারের হাতে পণ্য পৌঁছে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি খুবই ভাল উদ্যোগ। কিন্তু পণ্য যেন সরাসরি আমদানি করা হয়। অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে পণ্য কেনা হলে বাজারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। এ কারণে সংস্থাটির সরাসরি আমদানি করা প্রয়োজন। কোরবানি ঈদ সামনে রেখে দেশে লবণের সঙ্কটের আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এখনই বস্তাপ্রতি লবণ ৭০০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০০ টাকা হয়ে গেছে। কোরবানির চামড়া সংরক্ষণে বাড়তি লবণের প্রয়োজন হবে। এ অবস্থায় লবণের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এখনই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
×