ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড্রাম ব্যবস্থাপনা নিয়ে কঠোর অবস্থানে সরকার

বন্ধ হচ্ছে খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি

প্রকাশিত: ২৩:১১, ১৫ মে ২০২২

বন্ধ হচ্ছে খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি

এম শাহজাহান ॥ ভোজ্যতেল নিয়ে অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধে ‘ড্রাম ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। চলতি মে মাসের পর বাজারে আর খোলা সয়াবিন বিক্রির কোন সুযোগ থাকছে না। এক্ষেত্রে ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলোকে ড্রামের পরিবর্তে ফুড গ্রেড কন্টেনার, জেরিক্যান, পলি প্যাক এবং পেটবোতল ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ স্টান্ডার্ডস এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)। ভোজ্যতেলের গুণগতমান বজায় রাখা, মিলগুলোর উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিশ্চিত হওয়া, দাম বাড়ানোর অভিপ্রায়ে গুদামজাতকরণ হলে সেই কোম্পানি সহজে চিহ্নিত করা, সয়াবিন ও পামওয়েলের ভেজাল প্রতিরোধ এবং সর্বোপরি রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু সয়াবিনই নয়, আগামী ডিসেম্বর মাসের পর পামওয়েলও খোলা অবস্থায় বিক্রির সুযোগ থাকছে না। এ কারণে খোলা নয়, প্যাকেটে করে ভোজ্যতেল বিক্রির জোর প্রস্তুতি নেয়ার জন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। খোলা সয়াবিন বাজারজাত করতে হবে পলিপ্যাক মোড়কে। এ প্যাকেটের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ থাকতে হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। এদিকে, মজুদকৃত ভোজ্যতেল উদ্ধারে শনিবারও সারাদেশে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করা হয়। অন্যান্য দিনের মতো এদিনেও সারাদেশে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া মিলগুলো থেকে ড্রামে ড্রামে তেল যাচ্ছে খুচরা বাজার, ডিলার ও পরিবেশকদের কাছে। এতে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে ভোজ্যতেলের সঙ্কট কেটে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। খিলগাঁও সিটি কর্পোরেশন বাজারের ইয়াসমিন স্টোরের ম্যানেজার মাইনুদ্দিন জানান, বোতলজাত এবং খোলা সব ধরনের তেলের সরবরাহ বেড়েছে। তবে বিক্রি হচ্ছে নতুন নির্ধারিত দামে। ক্রেতারা জানিয়েছেন, সরবরাহ বাড়লেও তাদের বেশি মূল্যে কিনতে হচ্ছে এটাই কষ্টের বিষয়। সারাদেশে উদ্ধার অভিযান আরও জোরদার করার কথা জানিয়েছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। সংস্থাটির এ উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ভোজ্যতেলের সঙ্গে অন্য কোন পণ্য কেনার শর্ত দেয়া হলে সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তা অধিদফতরে অভিযোগ দেয়ার ক্রেতাদের অনুরোধ করেছে সরকারী এ সংস্থা। জানা গেছে, সরকারী নির্দেশনা কালক্ষেপণ করে ভোজ্যতেল খোলা অবস্থায় বিক্রিতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা মিলারদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। এ কারণে বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত বৈঠকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ার কথাও জানানো হয়েছে। বাজারে ৬৫ শতাংশ ভোজ্যতেল এখন খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়ে থাকে, আর বাকি ৩৫ ভাগ বিক্রি হচ্ছে পলি প্যাক কিংবা পেটবোতলে। কিছু ভোজ্যতেল টিনের ছোট ড্রামেও বিক্রি হয়ে থাকে। খোলা অবস্থায় যেসব ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া পুষ্টিমান নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। শুধু তাই নয়, তেল সরবরাহে দেশের শীর্ষ কোম্পানিগুলো যে ড্রামগুলো ব্যবহার করছে তা মূলত বিভিন্ন ‘রং’ কিংবা অন্যান্য আমদানিকৃত রাসায়নিক পণ্যের অব্যবহৃত খালি ড্রাম। অথচ ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা করলেও নিজস্ব সিলমোহরকৃত কোন ড্রাম ব্যবহার করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে কোম্পানিরগুলোর অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান সারাদেশে হাজার হাজার ড্রাম ভোজ্যতেল উদ্ধার করা হলেও এগুলো কোন কোম্পানির তেল তা নিশ্চিত হতে প্রশাসনকে বেগ পেতে হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মজুদকৃত তেলের সন্ধান পাওয়া গেলেও এসব তেলের সরবরাহকারী বা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করতে পারছে না গোয়েন্দা সংস্থা। নিজস্ব পলিপ্যাক না থাকায় পামওয়েল তেল চালিয়ে দেয়া সয়াবিন হিসেবে। এতে ক্রেতারা ঠকলেও কোম্পানিগুলো কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নিচ্ছে। চলতি বছরের শুরুতেই বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছিলেন মে মাসের পর সয়াবিন তেল আর খোলা অবস্থায় বিক্রি করা যাবে না। এছাড়া ওই সময় তিনি আরও জানিয়েছিলেন ডিসেম্বর শেষে পামওয়েলও খোলা অবস্থায় বিক্রি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে পলিপ্যাক কিংবা অন্য কোন প্যাকে ভোজ্যতেল বিক্রির প্রস্তুতি নিতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এছাড়া সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিএসটিআই কর্তৃক ভোজ্যতেলের ড্রাম ব্যবস্থাপনা নিয়মিত মনিটরিং করার লক্ষ্যে গঠিত কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিল্প সচিবের সভাপতিত্বে ওই সভায় জানানো হয়- ইতোমধ্যে খোলা সয়াবিন বিক্রি বন্ধ করার যে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে তা আর পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এছাড়া সভায় জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়- এ সময় বৃদ্ধি করা হলে তাদের বাজার মনিটরিং করা সমস্যা হবে। এ কারণে আর সময় বৃদ্ধি করা ঠিক হবে না। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, চলতি মে মাসের পর আর খোলা অবস্থায় সয়াবিন বিক্রির সুযোগ থাকছে না। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। তিনি জানান, প্রতিদিন লাখ লাখ লিটার মজুদকৃত ভোজ্যতেল উদ্ধার করা হচ্ছে। ভোক্তাদের স্বার্থে অভিযান অব্যাহত রাখা হবে। শুধু তাই, ভোক্তা স্বার্থেই খোলা তেল বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আসছে। আশা করব নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারী নির্দেশনা মেনে খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ থেকে সরে আসবে। জানা গেছে, বর্তমানে দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোজ্যতেল এসব অস্বাস্থ্যকর ড্রামে বাজারজাত করা হয়। বাকি ৩৫ শতাংশ বোতলের মাধ্যমে বাজারজাত হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, ভোজ্যতেল পরিবহনের ড্রামগুলো নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর। ভোজ্যতেলের জন্য নির্দিষ্ট কোন ড্রাম না থাকায় কেমিক্যাল, লুব্রিক্যান্ট বা মবিল অথবা অন্যান্য পণ্যের ব্যবহৃত ড্রামগুলোই তেল পরিবহনে পুনর্ব্যবহার করা হয়, যা প্যাকেজিং আইনের পরিপন্থী। বর্তমানে বোতলজাত কিংবা খোলা দুইভাবেই সয়াবিন তেল বাজারজাত করা হচ্ছে। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত, বোতলজাত সয়াবিনের বাইরে বাকি খোলা সয়াবিন বাজারজাত করতে হবে পলিপ্যাক মোড়কে। এতে বাজার তদারককারী প্রতিষ্ঠান অভিযানে গেলে পণ্যের ওজন, মান, দাম এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকেও সহজে চিহ্নিত করে অভিযোগ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবেন। উল্লেখ্য, খোলা সয়াবিন তেল খুচরা বাজারে প্যাকেটজাত করে বিক্রি নিশ্চিত করতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে গত বছর চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে শিল্প সচিবের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে সয়াবিন তেলের যথাযথ মান রক্ষা, সয়াবিন তেলের সঙ্গে পাম তেল মেশানোর প্রবণতা পরিহার, লিটার না কেজি এ ধরনের বিভ্রান্তি দূর করতে খোলা সয়াবিন বাজারজাত করার পরিবর্তে প্যাকেটজাত মোড়কে সরবরাহ নিশ্চিত করতে বলা হয়।
×