ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপুষ্টি ও মুক্তির দুয়ার খুলে দিতে পারে ‘চিয়া ও কিনোয়া’

প্রকাশিত: ২১:৫১, ১৫ জানুয়ারি ২০২২

অপুষ্টি ও মুক্তির দুয়ার খুলে দিতে পারে ‘চিয়া ও কিনোয়া’

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী ॥ চিয়া ও কিনোয়া নামের সুপারফুডের বাংলাদেশে উৎপাদনযোগ্য প্রজাতির ফলন শুরু হওয়ায় মানুষের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে এগুলো গ্রহণের প্রতি আগ্রহ। উত্তরের জেলা নীলফামারীতে এবার প্রথম চাষ হচ্ছে চিয়া ও কিনোয়া নামের দুটি সুপারফুড। অপুষ্টি ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির দুয়ার খুলে দিতে পারে এই ফসল দুটো এমন কথাই বলছে কৃষিবিদরা। তবে নতুন শস্যের বাজারজাত সৃষ্টি করতে পারলে কৃষকরা হবেন প্রচুর লাভবান। সুস্থ দেহ সুন্দর মন। আর সুস্থ দেহ নিশ্চিত করতে হলে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের বিকল্প নেই। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরের ধাপে মানুষের লক্ষ্য থাকে পুষ্টিকর খাদ্য নিরাপত্তার দিকে। বাংলাদেশেও বর্তমানে সকলের জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চয়তার দিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অধিক পুষ্টিগুণ সম্পূন্ন খাবার যেগুলো হবে সকলের জন্য সাশ্রয়ী। এমনই সাধারণত প্রচুর পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারগুলোকেই সুপারফুড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ, এরা যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান এবং খুব কম ক্যালোরি সরবরাহ করে। চিয়া ॥ মেক্সিকো ও আমেরিকার উচ্চ পুষ্টিতে ভরপুর ও মানবদেহের অত্যন্ত কার্যকরী বিভিন্ন রোগের ঔষধিগুণ সম্পন্ন সুপারসিড নতুন ফসল ‘চিয়ার’ এই প্রথম চাষ হচ্ছে নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জ উপজেলায়। এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া চিয়া চাষে উপযোগী হওয়ায় কৃষকদের মাঝে এক নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা নতুন এ ফসল এদেশে চাষাবাদে উপযোগী জাত উৎপাদন করে নাম দিয়েছেন বাউ চিয়া। ওই উপজেলার মাগুড়া ইউনিয়নের মাস্টারপাড়া গ্রামের কৃষক শাহজাহান মিয়া পরীক্ষামূলকভাবে ২০ শতাংশ জমিতে বাউ চিয়ার চাষ করেছেন। ফসলও আশানুরূপ হয়েছে। বাজারে সুবিধা পেলে আগামীতে আরও বেশি জমিতে উচ্চমূল্যের এ ফসল চাষ করব। ২০ শতাংশ জমিতে খরচ হয়েছে ৩ হাজার টাকা। যা ফলন হবে ৪০ থেকে ৫০ কেজি। ৬শ’ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হবে। রোগবালাই, পরিচর্যা কম যা অন্য ফসলের চেয়ে দ্বিগুণ লাভ। কিনোয়া ॥ এই ফসল হচ্ছে মহাকাশ নভোচারীদের শক্তির উৎস্য এবং সকল দানা শস্যের মা বলে পরিচিত। শাকের মতো পাতা হলেও এতে রয়েছে উচ্চ মাত্রার হজমযোগ্য প্রোটিন। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ উপাদান। কিনোয়া ছিল ইনকা সাম্রাজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। তারা একে ‘সমস্ত শস্যের মা’ হিসাবে উল্লেখ করত এবং পবিত্র বলে বিশ্বাস করত। এটি দক্ষিণ আমেরিকায় হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং সম্প্রতি একটি ট্রেন্ড ফুডে পরিণত হয়েছে, এমনকি সুপারফুড মর্যাদায় পৌঁছেছে। যারা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন তাদের কাছে কিনোয়া ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। উচ্চ প্রোটিন এবং অন্যান্য খনিজ উপাদানের কারণে এটি একটি সম্পূর্ণ খাদ্য হিসাবে বিবেচিত হয়। কিনোয়ার কিছু চিত্তাকর্ষক দিক রয়েছে, যেমন- এতে কার্বো হাইড্রেট কম যা রক্তে শর্করার মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে। উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল কমায়। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খাদ্যতালিকায় একটি দুর্দান্ত সংযোজন হতে পারে। আজকাল, সারাবিশ্বে কিনোয়া এবং কিনোয়াজাত পণ্যগুলো খুঁজে পাওয়া যায়, বিশেষত স্বাস্থ্যকর খাবারের দোকান এবং রেস্তরাঁগুলোতে যারা প্রাকৃতিক খাবারের উপর জোর দিয়ে থাকে। কিনোয়ার তিনটি প্রধান প্রকার রয়েছে: সাদা, লাল এবং কালো। বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি হ্রাসে কিনোয়া কার্যকরী খাদ্যের একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে। বিশেষ করে কোষের ঝিলি রক্ষা করতে, মস্তিষ্কের নিউরোনাল ফাংশনে ভূমিকা রাখে। এটি মাথাব্যথা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় কিনোয়ায় ম্যাঙ্গানিজ রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য করে। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সম্প্রতি বাংলাদেশে চাষের উপযোগী সাউ কিনোয়া-১ জাতের উদ্ভাবন করেছে, যা এই সুপারফুডটি বাংলাদেশে উৎপাদন এবং তার বাজারজাতকরণের জন্য অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখছে। নতুন ফসল পরীক্ষামূলক চাষে নেমে কৃষক শাহজাহান মিয়া জানালেন আমি জানতে পেরেছি এই ফসলের দাম অনেক। এর বাজারজাতকরণে সরকারের বিশেষ ভূমিকার সহযোগিতা পেলে আমরা ধান,পাট সরিষার চেয়ে এতে বেশি লাভবান হতে পারব। কিশোরীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার তুষার কান্তি রায় এই নতুন দুই প্রকার ফসলের উৎপাদনে বিশেষ তদারকি করছেন। তিনি চিয়া ফসল সম্পর্কে বলেন, সাধারণত একটি তিল ও রাই সরিষার শস্যদানার মতো। ফসলটি দেশীয় পদ্ধতিতে সারিবদ্ধ কিংবা বীজ ছিটিয়ে চাষাবাদ করা যায়। চিয়া সাধারণত একটি রবি মৌসুমের তিন মাসের ফসল। অক্টোবর মাসে বীজ রোপণ করতে হয়। গম বা সরিষার মতো মাড়াই করে, যথাযথ চালুনি, মশারির কাপড়, কুলা ইত্যাদি ব্যবহার করে সহজে বীজ পরিস্কার করা যায়। তিনি আরও জানান, মেক্সিকোসহ ইউরোপের দেশগুলোতে চিয়া একটি ঔষধি ফসল হিসাবে চাষ হয়। সেখানকার প্রাচীন আদিবাসী এ্যাজটেক জাতির খাদ্য তালিকায় থাকা চিয়া সিড বা বীজকে তারা সোনার থেকেও মূল্যবান মনে করতেন। তারা বিশ্বাস, করতেন এটা তাদের শক্তি ও সাহস জোগাবে। চিয়া সিডে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, কোয়েরসেটিন, কেম্পফেরল, ক্লোরোজেনিক এবং ক্যাফিক এসিড নামক এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। নিরপেক্ষ স্বাদের কারণে চিয়া সব ধরনের খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ার উপযুক্ত। এই কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার কিনোয়া সম্পর্কে বলেন, নাসার মহাকাশ বিজ্ঞানীদের খাদ্য সব দানা শস্যের মা সুপারফুড কিনোয়া উপজেলার মাগুড়া মাস্টারপাড়াতে এবার আমি সম্পূর্ণ রূপে নতুন শস্য সংযোজন করেছি। এই ফসলে প্রচুর এমাইনো এসিড, ফাইবার, ভিটামিন, মিনারেল, পটাশিয়াম, আয়রন সমৃদ্ধ। গাইসেন ইনডেক্স কম থাকায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভাল। প্রোটিন আছে ১৪ -১৮ শতাংশ। ওজন কমাতে সাহায্য করে নিরামিষভোজী ও স্বাস্থ্য সচেতনদের জন্য আশীর্বাদ । সবজি হিসেবে খুব সুস্বাদু পোলাও, খিচুড়ি, পায়েস, ভাত হিসেবে খাওয়া যায় বিস্কুট জাতীয় খাবারে ভ্যালুএ্যাড করে সালাদ, স্যান্ডউইচ এ ব্যবহার করে খাওয়া যায় এটি রান্না করলে ৪ গুণ বৃদ্ধি পায়। এজন্য পেটে দীর্ঘ সময় থাকে। ফলে ক্ষুধা কম লাগে। ওজন কমাতে সহায়ক। এক কথায় কাউনের বিকল্প। কিশোরীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার হাবিবুর রহমান বলেন, চিয়া ও কিনোয়া ফসলদুটি আমরা কৃষকদের মাছে ছড়িয়ে দিতে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এটির উৎপাদন ও বাজারজাত সু-নির্দিষ্টভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষকদের অপুষ্টি ও দরিদ্র থেকে মুক্তির দুয়ার খুলে দিতে পারে।
×