ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক বাংলাদেশ ॥ আজ জাতীয় বস্ত্র দিবস

রফতানি আয় পাঁচ দশকে ৯৬ গুণ বেড়েছে

প্রকাশিত: ২২:০৭, ৪ ডিসেম্বর ২০২১

রফতানি আয় পাঁচ দশকে ৯৬ গুণ বেড়েছে

রহিম শেখ ॥ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর মাত্র ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল বাংলাদেশ। তার মধ্যে ৯০ শতাংশ বা ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের পণ্যই ছিল পাট ও পাটজাত। পাটের পর প্রধান রফতানি পণ্যের মধ্যে ছিল চা ও হিমায়িত খাদ্য। গত পাঁচ দশকে রফতানির শীর্ষস্থান এখন তৈরি পোশাক খাতের দখলে। এই সময়ে রফতানি আয় ৯৬ গুণ বেড়েছে। প্রায় ৪০ লাখ গ্রামীণ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন, সহযোগী শিল্পের বিকাশসহ অনেক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে পোশাকশিল্প। চীনের পর একক দেশ হিসেবে দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক বাংলাদেশ। পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যার দিক থেকেও বিশ্বে সবার ওপরে বাংলাদেশ। এই অর্জনের মধ্যেই আজ শনিবার তৃতীয়বারের মতো ‘জাতীয় বস্ত্র দিবস-২০২১’ উদ্যাপন করতে যাচ্ছে সরকার। দিবসটি উপলক্ষে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচী আয়োজন করা হয়েছে। জানা গেছে, স্বাধীনতার পর পণ্য রফতানির তালিকায় তৈরি পোশাকের কোন নাম-নিশানা ছিল না। বেসরকারী খাতে ১৯৭৮ সালে রিয়াজ গার্মেন্টসের মাধ্যমে পোশাক রফতানির যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠানটি ১০ হাজার পিস শার্ট রফতানি করেছিল ফ্রান্সে। সেই চালানে ১ লাখ ৩০ হাজার ফ্রাঁ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে রিয়াজ উদ্দিনের হাতে গড়া রিয়াজ গার্মেন্টস। সেই থেকে শুরু। তারপর আসে দেশ গার্মেন্টস। সরকারী চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে নুরুল কাদের খান প্রতিষ্ঠা করেন দেশ গার্মেন্টস। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৯ সালে পোশাক রফতানি শুরু করে। কাজ শেখানোর জন্য দেশ গার্মেন্টসের ১৩০ জনকে সে সময় কোরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন নুরুল কাদের। তাদের অনেকেই পরে পোশাক কারখানার মালিক হন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ওপেক্স নামে পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন আনিসুর রহমান সিনহা। দ্রুতই প্রতিষ্ঠানটির কলেবর বাড়তে থাকে। বছর দশকের মধ্যেই ৪৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান করতে সক্ষম হয়। ওপেক্সের কাছাকাছি সময়ে আনিসুল হক, এ কে আজাদ, মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, কুতুবউদ্দিন আহমেদসহ আরও অনেকে পোশাকের ব্যবসায় আসেন। সে সময়কার অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন পোশাক খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি দেশে অন্যান্য খাতেও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র তথ্য মতে, পোশাক খাতের রফতানি গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৩ হাজার ৩০৬ কোটি ডলারের, যা দেশীয় মুদ্রায় ২ লাখ ৮১ হাজার ১০ কোটি টাকা। করোনার কারণে গত অর্থবছর রফতানি কিছুটা কমে ৩ হাজার ৭৬ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল। চলতি অর্থবছরের পাঁচ (জুলাই-নবেম্বর) মাসে তৈরি পোশাক খাতে রফতানি বেড়েছে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু নবেম্বর মাসে পোশাক রফতানি বেড়েছে ৩২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। বর্তমানে মোট রফতানি আয়ের ৮৩ শতাংশই তৈরি পোশাকের দখলে। আর পাট ও পাটজাত পণ্যের হিস্যা কমে ২ দশমিক ৬২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মূলত সস্তা শ্রম, সরকারের নীতিসহায়তা আর উদ্যোক্তাদের নিরলস পরিশ্রমের কারণে পোশাকশিল্পের কলেবর দ্রুতই বাড়ে। ফলে ২০০৫ সালে কোটা ব্যবস্থা উঠে গেলেও থেমে থাকেনি বাংলাদেশ। তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা বা জিএসপি কাজে লাগিয়ে এগোতে থাকে খাতটি। কানাডাসহ কয়েকটি দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধিতে ভাল সহায়তা করে। কোটা ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর পোশাকের খাতে বড় ধাক্কাটি আসে ২০১২ সালের ২৪ নবেম্বর। সেদিন তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকান্ডে শতাধিক শ্রমিক মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। সেটি সামলে ওঠার আগেই মালিকদের অবহেলায় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে, যা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা। রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক মারা যান। পাঁচ মাসের ব্যবধানে বড় দুটি ঘটনায় অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জে পড়ে তৈরি পোশাক খাত। দেশে দেশে বাংলাদেশী পোশাক বর্জনের ডাক দেয় শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। তীব্র সমালোচনার মুখে বিদেশী ক্রেতা ও শ্রম সংস্থার উদ্যোগে কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের উদ্যোক্তারা। বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে কারখানার কাঠামোগত, বৈদ্যুতিক ও অগ্নিসংক্রান্ত ত্রুটি সংস্কার করে বিশ্বে ইতিবাচক বার্তা দিতে সক্ষম হন তারা। তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকা- ও রানা প্লাজা ধসের পর ভালভাবে ঘুরে দাঁড়ায় পোশাক খাত। বিষয়টি বোঝার জন্য একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। ২০১০-১১ অর্থবছরে পোশাক রফতানি ছিল ১ হাজার ৭৯১ কোটি ডলারের। তারপর ৯ বছরের ব্যবধানে সেই রফতানি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। তবে করোনাকালে নতুন করে সঙ্কটে পড়েছে খাতটি। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ তুলনামূলক ভাল অবস্থানে রয়েছে, খাতটির উদ্যোক্তারাই তা বলছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো সারা বছর যে পরিমাণ টি-শার্ট বা গেঞ্জি কেনে, তার প্রায় ৪০ শতাংশই বাংলাদেশী পোশাক কারখানা সরবরাহ করে। কেবল টি-শার্ট নয়, ট্রাউজার, শর্টস প্যান্ট ও পুরুষ বা বাচ্চাদের শার্ট রফতানিতে ইইউতে সবার ওপরে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ডেনিম রফতানিতে ইইউর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও শীর্ষস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র খাত। গত নবেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বাংলাদেশেই তৈরি পোশাক খাতে সবচেয়ে বেশি সবুজ কারখানা রয়েছে। বিশ্বে এখন যে ১০টি প্লাটিনাম গ্রীন কারখানা রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশেই রয়েছে ৭টি। পোশাক খাতে বাংলাদেশে এখন গ্রীন ফ্যাক্টরি ১৫০টি। এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, গ্রীন ফ্যাক্টরি দেশের গার্মেন্টস শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এতে বিদেশী ক্রেতারা আকৃষ্ট হবেন। রফতানি বাড়বে। তিনি বলেন, বর্তমানে যারাই ফ্যাক্টরি করছেন, তারা গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার আলোকেই কারখানা স্থাপন করছেন। কারণ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কারখানা না হলে ক্রেতারা অর্ডার দেবেন না। তাই উদ্যোক্তারা ব্যবসার আইন-কানুন ও দেশের আইন মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আমরা এখন পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তুলছি। জাতীয় বস্ত্র দিবস আজ ॥ জাতীয় বস্ত্র দিবস আজ (শনিবার)। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘বস্ত্র খাতের বিশ্বায়ন : বাংলাদেশের উন্নয়ন’। তৃতীয়বারের মতো ‘জাতীয় বস্ত্র দিবস-২০২১’ উদ্যাপন করতে যাচ্ছে সরকার। এ উপলক্ষে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় বস্ত্র দিবস-২০২১ উপলক্ষে দৈনিক পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে। পাশাপাশি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘জাতীয় বস্ত্র দিবস-২০২১’ উদ্যাপন উপলক্ষে আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য র্যািলি অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এমপি এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মির্জা আজম বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। করোনার অভিঘাত থেকে দেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতকে রক্ষায় অবদানের জন্য এই খাতের প্রধান তিন সংগঠনসহ মোট সাতটি সংগঠনকে এবারের জাতীয় বস্ত্র দিবসের সম্মাননা দেবে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। যেসব সংগঠন এবার সম্মাননা পাচ্ছে সেগুলো হলো- বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ), বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস এ্যাসোসিয়েশন (বিজিবিএ), বাংলাদেশ স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলস এ্যান্ড পাওয়ার লুম ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশন (বিএসটিএমপিআইএ), বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল এ্যান্ড লিলেন ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিটিটিএলএমইএ) ও বাংলাদেশ জাতীয় তাঁতি সমিতি।
×