ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বই ॥ শতবর্ষের ধূসর স্মৃতির জিয়নকাঠি

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ২৬ নভেম্বর ২০২১

বই ॥ শতবর্ষের ধূসর স্মৃতির জিয়নকাঠি

ভৌগোলিক অবস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ঐতিহাসিকভাবে চাঁদপুর একটি গুরুত্ববহ স্থান। সড়কপথের পাশাপাশি বিশেষত রেলপথ ও নৌবন্দরের কারণে এটিকে ‘গেটওয়ে টু ইন্ডিয়া’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা, সিলেট, আসামসহ সমগ্র পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ, কলকাতা তথা ভারতীয় পশ্চিমাঞ্চল এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম রুট ছিল চাঁদপুর। তাই ঐতিহাসিকভাবে চাঁদপুরের গুরুত্বের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবেও ঐতিহাসিক নানা ঘটনার সঙ্গে রয়েছে এর পরম যোগসূত্র। কিন্তু সময়ের আবর্তনে বিস্মৃত হতে চলেছে সেসব স্মৃতি। চাঁদপুরের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, ঘটনাপ্রবাহ ও নানা বিষয়আশয়কে স্মৃতি হিসেবে জাগরূক রাখার প্রয়াসে কাদের পলাশ ও মুহাম্মদ ফরিদ হাসান সম্পাদনা করেছেন ‘বিস্মৃতির চাঁদপুর’ সংকলনটি। এই গ্রন্থটির শুরুতেই রয়েছে রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য শান্তিদেব ঘোষের স্মৃতিগদ্য ‘আমার চাঁদপুর’। চাঁদপুরে জন্ম নেয়া এই কৃতীসন্তানের গদ্যটি পাঠে তৎকালীন চাঁদপুরের যোগাযোগব্যবস্থা, সামাজিক অবস্থা ও রীতিনীতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সংকলনটির এই অংশে সন্নিবেশিত হয়েছে প্রয়াত শঙ্খঘোষের ‘মেঘনা ১৯৯৭’ নামে আরেকটি স্মৃতিগদ্য। এই সংকলনে স্থান পেয়েছে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯২১ সালে সংঘটিত চা-শ্রমিক হত্যাকা- ও বাঙালী পুলিশ ইন্সপেক্টর তারিণী মুখার্জি হত্যাকা-। দুটি গদ্যে উঠে আসে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চাঁদপুরের ভূমিকা, সেসব ঘটনায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের চাঁদপুরে আগমনসহ ঐতিহাসিক বিষয়আশয়। পরবর্তী অংশে বইটিতে রবীন্দ্রনাথের আগমন সংবাদ, চাঁদপুরের কৃতীসন্তান সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি, ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালী ও চাঁদপুরে অবস্থান এবং চাঁদপুরে শেরে বাংলার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ, চাঁদপুরে কাজী নজরুলের আগমন এবং স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে বঙ্গবন্ধুর একাধিকবার চাঁদপুরে আগমনের সচিত্র গদ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধবিষয়ক পর্বে উঠে এসেছে চাঁদপুরে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটে যাওয়া ইতিহাসের বয়ান। ১৯৭২ সালের পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি সংবাদের বরাতে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধ। এই অংশে যুক্ত হয়েছে একটি স্মৃতিগদ্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কিছু করার প্রয়াস থেকে একটানা ৯০ ঘণ্টা সাঁতার কেটে বিশ্বরেকর্ড করার ঘটনা ও তার অন্তরালের বিষয়আশয় উঠে আসে অরুন নন্দীর স্মৃতিগদ্যে। বইটিতে সংযুক্ত হয়েছে নদীভাঙন ও বন্যা বিষয়ক কিছু সচিত্র সংবাদ। সংকলনটিতে ১৯৩৭ সালে চাঁদপুর মুসলিম যুবক সমিতির বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে দেয়া ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর দেয়া একটি দীর্ঘ অভিভাষণ সংকলিত হয়েছে। সংকলনটির পরিশিষ্টে উঠে এসেছে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের একটি বক্তৃতা। তিনি চাঁদপুরের নাট্যসংগঠন বর্ণচোরার আমন্ত্রণে এসে এই বক্তৃতাটি করেছিলেন। পরিশিষ্টে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু বিষয়। এই গ্রন্থটির শেষ প্রান্তে যুক্ত হয়েছে বেশকিছু দুর্লভ ঐতিহাসিক ব্যক্তি, ঘটনা ও স্থানের ছবি যা এই বইটিকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। বইটির তথ্যসূত্রের দিকে লক্ষ্য করলে অনুমান করা যায়, চাঁদপুরের প্রায় শতবর্ষের ইহিতাসবিজড়িত বিষয়গুলোকে গ্রন্থিত করতে গিয়ে সম্পাদকগণকে অসংখ্য গ্রন্থ, সংকলন, জার্নাল, পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছে, তথ্যের প্রয়োজনে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটতে হয়েছে। বইটিতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্কাইভ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আর্কাইভ, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর ও জাতীয় গণগন্থাগার থেকে তথ্য সংগ্রহ, বিভিন্ন গবেষক, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান সংযুক্ত করা হয়েছে যা বইটিকে ঋদ্ধ করেছে। এটি একটি শ্রমলব্ধ, দুঃসাধ্য ও অপরিহার্য কাজ। চাঁদপুরের ইতিহাস সংরক্ষণে এবং উত্তর প্রজন্মের ইতিহাস-সচেতনতা ও ইতিহাসচর্চায় বইটি নিঃসন্দেহে ভূমিকা রাখবে। গ্রন্থটির নামকরণ ‘বিস্মৃতির চাঁদপুর’ যথার্থ হয়েছে কেননা চাঁদপুরের এই ইতিহাসগুলো বিস্মৃতি এবং বিকৃতির দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল প্রায়। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু। চমৎকার বাঁধাই ও ঝকঝকে ছাপায় বইটি প্রকাশ করেছে চৈতন্য প্রকাশন। পৃষ্ঠা : ১৪৪। মূল্য : ৩২০ টাকা।
×