ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

উস্কানিদাতা ও হামলাকারীরা শনাক্ত

কেন এই সহিংসতা উত্তর এখনও মেলেনি

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ২০ অক্টোবর ২০২১

কেন এই সহিংসতা উত্তর এখনও মেলেনি

শংকর কুমার দে ॥ দুর্গাপূজা চলাকালে এবং পূজাপরবর্তী দেশের কয়েকটি স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে সরকারী কঠোর পদক্ষেপের ফলে চাপা উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ থাকলেও স্বস্তি ফিরে আসছে। গোয়েন্দাসহ পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা সংঘটিত ঘটনার স্থানগুলোতে ধরপাকড়, জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে। তবে, কেন এ ঘটনা। মঙ্গলবার পর্যন্ত এর সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণাদি উন্মোচিত হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন, সরকার ঘটনা সংঘটনকারীদের মুখোশ উন্মোচনের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছে। সোমবার মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী এসব ঘটনা নিয়ে তার কঠোর মনোভাব প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন। এসবের পরও বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চায়, কি কারণে এ অপতৎপরতা, আইএসআইসহ বিদেশী কোন সংস্থার মদদ রয়েছে কিনা ইত্যাদি। যদিও সরকার পক্ষে দায়িত্বশীল কেউ কেউ এ ঘটনার সঙ্গে জামায়াত-বিএনপি, হেফাজত ও জঙ্গীপনায় সংশ্লিষ্টরা জড়িত বলে দাবি করেছেন। অপরদিকে, কয়েক জেলার এসপি বদলির ঘটনা রুটিন মাফিক বলে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে থেকে দাবি করা হয়েছে। যদিও বদলির ঘটনা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে বিভিন্ন মণ্ডপে হামলাকারী, ইন্ধনদাতা শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু কি কারণে অনাকাক্সিক্ষত এ ঘটনা ঘটানো হলো এর উত্তর এখনও মেলেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় দুর্গাপূজায় মণ্ডপে, মন্দিরে হামলার ঘটনা পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিটকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশের সব সংস্থাই অভিযানের পর অভিযান চালাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এসব হামলার সঙ্গে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে পুলিশের সব ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে হামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পুলিশী তদন্তে দেশের বিভিন্নস্থানে হামলায় সম্পৃক্তদের বিষয়ে বিশদ তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। প্রতিমা ভাংচুরের উস্কানিদাতা ও হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করেছে পুলিশসহ গোয়েন্দারা। সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব ও মোবাইল ফোনের কললিস্ট, ভয়েস রেকর্ডারের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে তদন্তে। তদন্তে উঠে এসেছে, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের একাধিক নেতার নাম। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লার পূজামণ্ডপে ভাংচুরের পর থেকে দেশের বিভিন্নস্থানে অন্তত ৯০টি পূজামণ্ডপে ভাংচুর হয়েছে। দেশের বিভিন্নস্থানে অন্তত শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে ভাংচুর ও হামলার ঘটনার জের ধরে কয়েকদিন ধরে দেশের বিভিন্নস্থানে পূজামণ্ডপে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ গত রবিবার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জে জেলেপল্লীর বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, লুটপাট, মারধর করার ঘটনা ঘটে। হিন্দু সম্প্রদায়ের দশমী পূজা ছিল গত শুক্রবার। অথচ গত শুক্রবারের দুইদিন পর গত রবিবার রংপুরের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাটিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টনক নড়ে। সরকারের কাছে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে। রংপুরের আগের দিন গত শনিবার ফেনীতে বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পূজামণ্ডপে হামলা করে মূর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। মণ্ডপে হামলার প্রতিরোধ করতে গিয়ে হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে অন্তত দুজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এর আগে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে অন্তত চারজন নিহত হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের উর্ধতন এক কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রদায়িক সহিংস হামলার আশপাশে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিমা ভাংচুরে যারা যারা অংশ নিয়েছিল তা ওইসব ফুটেজে ফুটে উঠেছে। তাছাড়া আড়ালে থেকে যারা উস্কানি দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। আর যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তার সংখ্যা শতাধিক হবে। ইতোমধ্যে তাদের পূর্ণাঙ্গ বায়োডাটা সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, হামলাকারী ও উস্কানিদাতাদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের একাধিক নেতার নাম রয়েছে। যারা মণ্ডপে কোরান শরীফ রেখে গেছে তাদেরও ছাড় দেয়া হবে না। যে কোন পরিস্থিতি এড়াতে বাড়তি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আশা করি, দ্রæত সময়ের মধ্যে উস্কানিদাতা ও হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ফেসবুক এ্যাডমিনের প্রোফাইল কালো তালিকাভুক্ত করাসহ গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত আছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জি বলেছেন, দেশে অতীতে নানা ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলা বা আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মন্দির বা পূজার প্রস্তুতিকালীন থেকে শুরু করে পূজা শেষ হওয়ার পরও প্রতিমা ভাংচুর ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা অব্যাহত থাকে কিভাবে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এবার দুর্গাপূজার সময়ে যেভাবে ব্যাপক মাত্রায় হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, এমনটা সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। পূজার আগেই তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন এবং সেসব বৈঠকে নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সরকারকে, প্রশাসনকে বারবার বলেছি যে এই ঘটনা সাম্প্রদায়িক অপশক্তি করছে। তাদের পক্ষ থেকে বারবার আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম দেবালয়ের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের হত্যা করা হলো। দেবালয় ধ্বংস করা হলো। আমার মনে হয় প্রশাসনের কোথাও কোন গাফলতি থাকতে পারে। না হলে এমন অবস্থা এ সময়ে হওয়ার কথা না। কিন্তু তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি কেন ? মানবাধিকার সংস্থার এক সংগঠক বলছেন, কুমিল্লার মণ্ডপে, মন্দিরে হামলার পর ২২ জেলায় বিজিবি মোতায়েনের পরও হামলা হয়েছে প্রকাশ্যেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন তা ঠেকাতে পারল না? হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও শাস্তি পেতে দেখা যায় না, বরং হামলাকারীরা অনেক সময় পরবর্তীতে পুরস্কৃতও হয়। হিন্দুদের ওপর হামলা নিয়ে যতটা রাজনীতি হয় তাদের সুরক্ষা দেয়ার ততটা আগ্রহ কারও মধ্যে দেখা গেলে সহিংসতার ব্যাপকতা ও বিস্তৃত হওয়াটা এমন হবে কেন ? আজ পর্যন্ত এ ঘটনাগুলোর বিচার না হওয়ার ফলে সমাজে এমন কোন বার্তা দিতে পারছে না যে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়া যাবে না, শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ইন্ধন থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার একটি ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার পর বিভিন্নস্থানে পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং সন্ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করছে যার সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে রংপুরের পীরগঞ্জে। এখানে গুজব ছড়িয়ে হিন্দু এলাকায় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাগুলোকে এখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করছে না, তারা মনে করছে পরিকল্পিতভাবেই সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে। এই ঘটনার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত এবং হেফাজতের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার হয়েছে। এতেই এই দলগুলোর জড়িত তার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়। আর এই দলগুলোর সঙ্গে আগে থেকেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর সখ্য রয়েছে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই বা আসার সম্ভাবনা দেখা দিলেই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত করতে মদদ দিতে তৎপর হয়ে ওঠে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। গত কিছু দিন ধরেই বাংলাদেশে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সক্রিয় এমন খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। ওই খবরে বলা হয়, একটি হোয়াটস গ্রæপ করে সেই গ্রæপের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করা হচ্ছে, মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীকে উস্কানি দেয়া। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের পৃষ্ঠপোষকতায় আইএসের তৎপরতা নতুন করে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা মদদ আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তি ও দেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতের স্থানীয় নেতা-কর্মী গ্রেফতার ও সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর মদদদান ও উস্কানীদানের বিষয়টি তদন্তের সামনে এসেছে।
×