কিছুদিন আগে পাকিস্তান কেন বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে গেল তার একটি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। তখন বলেছিলাম, এরপর লিখব ভারত কেন বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে, তার ওপর। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে ভারত পিছিয়ে গেছে। অনেকদিন ধরে সে দেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এ বিষয়টি নিয়ে ভারতকে সতর্ক করে আসছিলেন। কিন্তু ভারত যে তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি। আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী সি. রাইট মিল অনেক আগেই বলেছিলেন, প্রতিটি সমাজে বুদ্ধিজীবীরা ক্ষমতাহীনতায় ভোগেন। তারা কেবল সমাজের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করতে পারেন, কিন্তু তারা তা প্রতিহত করতে পারেন না।
১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান- দেশ দুটি স্বাধীন হওয়ার পর উন্নয়নের ভুল পথে চলছিল। ভারত এবং পাকিস্তান- দুই দেশই ভারি শিল্পায়নের দিকে বেশি নজর দেয়। কৃষির প্রতি সামান্য নজর দিলেও দেশ দুটি খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল সবুজ বিপ্লবের জনক বলে পরিচিত নোবেল বিজয়ী নুম্যান ব্যুরলগের অতি উন্নত জাতের গম আবিষ্কার। তার এই অতি উন্নত জাতের গম আবিষ্কারের ফলে মেক্সিকো ১৯৬৩ সালে গম আমদানিকারক দেশ থেকে গম রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়। আর পাকিস্তান ও ভারত ১৯৬৫-১৯৭০ সালের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ গম উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। এভাবে দেশ দুটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। এই আবিষ্কারের ফলে পৃথিবীর ১০০ কোটি মানুষের অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয় বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ফলে ১৯৭০ সালে ক্ষুধা দূরীকরণের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য এই মার্কিন কৃষি বিজ্ঞানীকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় শান্তিতে।
এবার মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। প্রথমে দেখা যাক ভারত প্রধান প্রধান কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে? বর্তমানে মাথাপিছু আয় ভারতের হচ্ছে ১৯৪৭ ডলার। বাংলাদেশের হচ্ছে ২২২৭ ডলার। শিক্ষার হার ভারতের হচ্ছে ৬৯.৩%, বাংলাদেশের হচ্ছে ৭২.৮%। বেকারত্ব ভারতের হচ্ছে ৭.১১%। বাংলাদেশের হচ্ছে ৫.৩%। দারিদ্র্য ভারতের হচ্ছে ২৭.৯%। বাংলাদেশের হচ্ছে ২০.৫%। নারীর কর্মসংস্থান ভারতের হচ্ছে ২০.৩%। বাংলাদেশের হচ্ছে ৩৬.১৫%। এভাবে উন্নয়নের বেশ কিছু সূচকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে ভারত পিছিয়ে যাচ্ছে, যেমনটা পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে গেছে। ভারত পিছিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান কয়েকটি কারণ হচ্ছে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক, যা নিয়ে এখানে সীমিত পরিসরে আলোচনা করা হলো।
প্রথমে আলোচনা করা যাক সামাজিক বিষয় নিয়ে। ভারতের রয়েছে একটি প্রায় অনড় সামাজিক বৈষম্য, যাকে বলা হয় কাস্ট বা বর্ণভিত্তিক সমাজ। এটি তাদের সনাতন ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। ১৯৮৪ সালে একদিন ভারতের পুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের গার্ডকে বিকেলে কেন্টিনের সামনে জলখাবারে ডাকলাম। সে গাছের নিচে বসে আছে। যতই ডাকছি সে আসছে না। তার ওপর বিরক্ত হয়ে আমার জলখাবার সেরে হোস্টেলের রুমে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি সে আমার জানালার পেছন দিয়ে এসে বলছে, বাবু! আমরা নমশূদ্র। তোমাদের সঙ্গে আমাদের কোন কিছু খাওয়া নিষেধ। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, সে নমশূদ্র এবং তার কেন্টিনে বসে কোন কিছু খাওয়া নিষেধ। ভাবলাম, একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই যদি এ অবস্থাা হয়, তাহলে অজপাড়াগাঁয়ে কি অবস্থা? লক্ষণীয়, ভারতের অধিকাংশ মানুষ এটাকে কোন সমস্যা মনে করে না বা উন্নয়নের পথে অন্তরায় মনে করে না। ভারতের এই সামাজিক বৈষম্য এতই তীব্র এবং অনড় যে, সারা পৃথিবীর অন্যতম একটি অনড় সমাজ বলা হয় ভারতীয় সমাজকে। যদিও সম্প্রতি কিছু কিছু সমাজ গবেষণায় দেখা যায়, সেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নীচু শ্রেণীর লোকে আয়রোজগার বাড়ার ফলে কিছুটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে।
প্রখ্যাত ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানী আন্দ্রে বেতেহাসহ বেশ কিছু সমাজবিজ্ঞানী তাদের লেখায় এটি দাবি করেন। আর তা হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে ভারত পিছিয়ে যাচ্ছে আরেকটি সামাজিক কারণে। আর তা হচ্ছে ভারতীয়রা আয় করে জমানোর জন্য আর বাংলাদেশের লোকেরা আয় করে খরচ করার জন্য। ফলে যে দেশে ভোগ কম থাকে, সে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার সুযোগ এমনিতেই কমে যায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে পিছিয়ে আছে। একটি গোষ্ঠীকে পিছিয়ে রেখে অন্য আরেকটি গোষ্ঠী এগিয়ে গেলে তাকে উন্নয়ন বলে না; যা থেকে ভারত এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি।
বাংলাদেশীদের মধ্যে কেবল ১.৯% মদ পান করে। সেখানে ভারতীয়দের মধ্যে এই হার ৩০%। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্যে দেখা যায়, ১৫ বছরের উপরের ভারতীয়রা ২০২০ সালে গড়ে ৪.৩ লিটার মদ পান করে, যা আগে ২০১৬ সালে ছিল ৫.৭ লিটার। একজন ভারতীয় বিশেষজ্ঞ একদিন আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনাদের দেশে মদ পান করার জন্য পরদিন শতকরা কতজন অফিসে যায় না?’ এ প্রশ্ন শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এ ধরনের কোন প্রশ্ন কোনদিন মাথায়ও আসেনি। তাকে বললাম, আমাদের দেশে কোন সময় এ ধরনের কোন কথা শুনিনি। ভারতের নাগরিকদের এই মদ পান বিভিন্নভাবে উন্নয়নকে ব্যাহত করে। বিশেষ করে গরিবদের আয়ের একটি অংশ তারা ব্যয় করে এই মদ পানে, যা কোনভাবেই তাদের পরিবারের কল্যাণে আসে না। এ ছাড়াও এই মদ পানের ফলে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা প্রায় রোজকার ব্যাপার। পারিবারিক বিশৃঙ্খলা তো (ফ্লেমিলি ডিসঅর্গানাইজেশন) আছেই।
দেশটির নেতারা এক সময় মানুষকে বোঝা হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু তাদের প্রতিটি মানুষ ছিল দেশের জন্য সম্পদ। দেশের পুঁজির অভাবকে দূর করার জন্য কোন উদ্ভাবনী ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি তারা। ভূমি সংস্কারের বিষয়টি বিবেচনায় নেননি। এগুলোর ফলাফলে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, আয় বৈষম্য, নিরক্ষরতা, সীমিত স্বাস্থ্য সেবা, বাল্যবিবাহ, পুষ্টিহীনতা, দুর্নীতি ইত্যাদির মতো ঘটনা বেড়েছে।
ভারত এক পর্যায়ে সনাতনী ‘ভারত’কে আধুনিক ‘ইন্ডিয়া’ বানানোর ¯েøাগান দিলেও শেষ পর্যন্ত বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর লক্ষ্যবিহীন ‘ইন্ডিয়া’কে ‘ভারত’ বানানোর জন্য এগিয়ে যেতে থাকে। লক্ষণীয়, ভারত সম্ভবত একমাত্র দেশ যার দাফতরিকভাবে দুটি নাম রয়েছে, একটি ভারত আর ইংরেজী নাম ইন্ডিয়া।
ভারত তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতিমালায় কয়েকবার পরিবর্তন আনে। তারা প্রথমে আমদানির বিকল্প ভারি শিল্প তৈরিতে মনোযোগ দেয়, পরে মনোযোগ দেয় রফতানিতে। তারপর তারা আবার তুলনামূলক সুবিধার নীতিতে বা অবাধ বাণিজ্যের নীতিমালায় ফিরে যায়। উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই যে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তাতে তাদের অনেক সময় নষ্ট হয়।
স্বাধীনতার তিন দশক পর্যন্ত ভারত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ধারা বহাল রেখেছিল, অনেক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছিল, বিদেশী বিনিয়োগের দরজা প্রায় বন্ধ রেখেছিল। অর্থাৎ বলতে গেলে দারিদ্র্য বণ্টন করেছিল। বছরে ১-১.৭% হারে প্রবৃদ্ধি করেছিল, যা ছিল খুবই হতাশাজনক।
১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময় এসে তারা একটু একটু করে উদারনৈতিক অর্থনীতি শুরু করে। তখন তারা গরীবি হটাও আন্দালন শুরু করে, যখন অনেকে আবার আমীরি হটাও আন্দোলন করার কথা বলছিল। ১৯৯১ সালে প্রথম তারা অর্থনীতির ক্ষেত্রে উদারনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ করে। ২০০০ সালে তারা মুক্তবাজার অর্থনীতির দ্বার খুলে দেয়। তখন এই এক দশকে ৭.৫% প্রবৃদ্ধির হার যুক্ত হয়। তাদের উৎপাদনের চেয়ে সেবা খাত ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২০০০ সালে ভারতের জিডিপি দাঁড়িয়েছিল ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, কিন্তু মাত্র ১৫ বছরে তা ৫ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ২.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে ধনীদের আরও বেশি করে পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা যায়, যা দরিদ্র বান্ধব নয়। ভারত মূলত তার সামাজিক উন্নতি বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নারীর কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো গুরুত্ব প্রদান করেনি। জাতীয় আয় বাড়লেই হবে না, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা চিন্তা করতে হবে। তারা কেবল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন, কিন্তু সামাজিক অন্তর্ভুক্তির কথা বলছেন না। বরং ভারতবাসীকে আরো বেশি বিভক্ত করছে সে দেশের সমকালীন রাজনীতি। তাই বিশ্বের কাছে আধুনিক বিকশিত ভারত হতে আরও অনেক সময় লাগবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক
[email protected]