ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গুও ভয়ঙ্কর রূপে ॥ হাসপাতালে রোগী বাড়ছে প্রতিদিনই

প্রকাশিত: ২৩:২২, ২৯ জুলাই ২০২১

ডেঙ্গুও ভয়ঙ্কর রূপে ॥ হাসপাতালে রোগী বাড়ছে প্রতিদিনই

শরীফুল ইসলাম ॥ প্রাণঘাতী করোনার পর দেশে এবার ডেঙ্গু রোগের প্রকোপও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। তবে সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকায়। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার ২ সিটি কর্পোরেশনের চিরুনী অভিযানের পরও সফলতা আসছে না। তাই ডেঙ্গু নিয়ে মানুষ এখন আতঙ্কিত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া তথ্যানুসারে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৯৮ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রæয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ৪৩ জন, জুনে ২৭১ জন এবং জুলাই মাসে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৭১৭ জন। জুলাই মাসের ২৮ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আগের ৬ মাসের মোট আক্রান্তের প্রায় ৫ গুণ বেশি। এর মধ্যে মারা গেছেন ৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বুধবার ১৫৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগের দিন ২৭ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১৪৩ জন। ২৬ জুলাই ছিল ১২৩ জন, ২৫ জুলাই ১০৫ জন এবং ২৪ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ১০৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুসারে প্রতিদিনই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যার নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে। ২৭ জুলাই মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে ২৮ জুলাই বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৫৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন, যা চলতি বছর দেশে একদিনে সর্বোচ্চ রেকর্ড। আগের দিন ২৭ জুলাই এ সংখ্যা ছিল ১৪৩ জন, যা ওই দিনের জন্য ছিল সর্বোচ্চ রেকর্ড। বুধবার দেশের বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে যে ১৫৩ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন তার মধ্যে শুধু ঢাকাতেই ১৫০ জন। আর ঢাকার বাইরে মাত্র ৩ জন। আর বুধবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৫৬৮ জন। এর মধ্যে ঢাকার ৪১টি সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে ৫৫৭ জন এবং অন্যান্য বিভাগে রোগী ভর্তি রয়েছেন ১১ জন। ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৯৮ জন। এই ২ হাজার ৯৮ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে এ পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ১ হাজার ৫২৬ জন। এদিকে ঢাকায় অস্বাভাবিক হারে ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসায় সুবিধার জন্য আলাদা ৪টি হাসপাতাল নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এ ৪টি হাসপাতালের নাম ঘোষণা করেন। এগুলো হচ্ছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল ও টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল। স্বাস্থ্য মন্ত্রী জানান, এ ৪টি হাসপাতালের পাশাপাশি আরও ক’টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। যেখানে করোনা রোগীর চিকিৎসা হয়, সেখানে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়। তাই আলাদা হাসপাতাল নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ২৫ জুলাই দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। এ বৈঠকে তিনি বলেন, এডিসসহ অন্যান্য মশার প্রাদুর্ভাব ও ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে যে বাসা-বাড়িতে রোগী পাওয়া যাবে, হাসপাতাল থেকে সেই ব্যক্তির নাম-ঠিকানা নিয়ে তার বাসাসহ ওই এলাকা চিহ্নিত করে বিশেষ চিরুনী অভিযান চালাতে হবে। এ বৈঠকের পর ২৬ জুলাই থেকে নতুন উদ্যমে চিরুনী অভিযান শুরু করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। অভিযানে অংশ নেয় ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযান চলাকালে যেখানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে সেই স্থাপনার মালিককেই আর্থিক জরিমানা করা হচ্ছে। ২৭ জুলাই এডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) নতুন উদ্যমে চিরুনী অভিযান শুরু করে। অভিযানের উদ্বোধনী দিনে খোদ নিজেদের এক কাউন্সিলরকে জরিমানা করে ডিএনসিসি। ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তোফাজ্জল হোসেনের অংশীদারে মালিকানা থাকা একটি বিপণিবিতানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় তাকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানে অংশ নেয় ১১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ অভিযান ৫ আগস্ট পর্যন্ত চালাবে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, ডেঙ্গুর বাহক এডিস নিয়ন্ত্রণে চিরুনী অভিযান চলছে। যেখানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে সেই ভবনের মালিককেই জরিমানা করা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, যতদিন মশা থাকবে ততদিন মশা নিয়ন্ত্রণ অভিযান অব্যাহত থাকবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব মতে দেশে এবার ২ হাজার ৯৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে এ রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ অনেকে টেস্টই করেন না। আবার টেস্ট করানোর পরও অনেকে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নেন। স্থাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে বুধবার রাজধানীর সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৯ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৪ জন এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ মেডিক্যালে ১ জন, হলি ফ্যামিলিতে ৬ জন, বারডেমে ৩ জন, ইবনে সিনায় ৬ জন, স্কয়ারে ৬ জন, ডেল্টা মেডিক্যাল মিরপুরে ৩ জন, ল্যাবএইডে ১ জন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ১২ জন, গ্রীন লাইফ হাসপাতালে ৯ জন, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল কাকরাইলে ১৬ জন, ইউনাইটেড হাসপাতালে ২ জন, খিদমা হাসপাতাল খিলগাঁওয়ে ৬ জন, সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৬ জন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন। আরও রয়েছেন এভারকেয়ার হাসপাতালে ৩ জন, আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ৭ জন, ইউনিভার্লে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২ জন, বিআরবি হাসপাতালে ৩ জন, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ২ জন, উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪ জন, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ৮ জন, পপুলার ধানমণ্ডিতে ২ জন, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৩ জন এবং আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহতা বৃদ্ধি এমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষকেও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে। কারণ এডিস মশার মাধ্যমেই ডেঙ্গু ছাড়ায়। দেশে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। তাই এ সময়টাই ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম। তবে ডেঙ্গু জ্বর বেশি হয় মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তবে এবার মে ৩ জুন মাস পর্যন্ত খুব কম মানুষই ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে। জুলাইয়ের শুরু থেকে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে এবং মধ্য জুলাইয়ের পর থেকে বেশি বাড়ে। আর বিগত ক’দিন ধরে বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত অধিকাংশ মানুষই জানে না তারা এ রোগে ভুগছেন। এছাড়া এখন কারো জ্বর আসলেই মনে করেন কারোনা হতে পারে, তাই তারা শুধু করোনা টেস্ট করান। এর ফলে করোনা নেগেটিভ হওয়ার পর তারা আর চিকিৎসা নেন না। এর ফলে এক পর্যায়ে রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং টেস্টের পর জানতে পারেন ডেঙ্গু হয়েছে। তাই এ অবস্থার অবসানে করোনার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুরও টেস্ট করা প্রয়োজন। সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও করোনার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে ডেঙ্গু টেস্ট করানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ডেঙ্গু রোগ থেকে বাঁচতে সবাইকে নিজ নিজ বাসস্থান ও চারপাশে স্বচ্ছ পানি যাতে জমে না থাকতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে বংশবিস্তার কারা এডিস মশা আশপাশের মানুষকে কামড়ালে ডেঙ্গু রোগ হয়ে থাকে। বিশেষ করে ডেঙ্গুর বাহক এডিশ মশা যেন বংশবিস্তার করতে না পারে সেজন্য ঘরের ভেতর ও বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। বাসাবাড়িতে সবাইকে মশারি ব্যবহার করতে হবে। আর জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবেত হবে। নিয়মিত মশানাশক স্প্রে করতে হবে। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর কারো জ্বর হলে সেটাকে সাধারণ জ্বর মনে করে অবহেলা না করে টেস্ট করতে হবে। কারো জ্বর, গাব্যথা, বমি এবং হাতে-পায়ে ফুসকুড়ি কিংবা র‌্যাশ হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। চিকিৎসকদের দেয়া তথ্য মতে করোনা ও ডেঙ্গু রোগের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। দুটো রোগের ক্ষেত্রেই জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি, কাশি এবং স্বাদ না থাকার লক্ষণ থাকতে পারে। তাই একই রোগী করোনা এবং ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যবস্থা অধিকতর জটিল হয়। করোনার ক্ষেত্রে এসব লক্ষণের সঙ্গে নাকে ঘ্রাণ না পাওয়া, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ও কারো কারো পাতলা পায়খানা হতে পারে। তবে ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে এমন হয় না।
×