ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সেই মাহেন্দ্রক্ষণের প্রত্যাশায়

প্রকাশিত: ২০:২০, ১৯ জুলাই ২০২১

সেই মাহেন্দ্রক্ষণের প্রত্যাশায়

এবারের লকডাউনের দ্বিতীয় পর্যায়ে এখন বাংলাদেশ। দুই সপ্তাহের কড়াকড়ির পর এক সপ্তাহের জন্য শিথিল করা হয়েছে চলমান কঠোর লকডাউন। নিন্দুকেরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করছেন করোনা আটদিনের জন্য সফরে গেছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি বিজিবি এবং সেনা সদস্যদের মোতায়েন করে এ মাসের প্রথম দফার লকডাউনে কড়াকড়ি আরোপের সরকারী প্রয়াসটা ছিল লক্ষণীয় এবং সফলতা-ব্যর্থতা মিলিয়ে স্বীকার করতেই হবে যে, এবারের যে লকডাউন তা ইতোপূর্বে কোভিডকালীন আরোপিত বিধিনিষেধগুলোর চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ছিল। তবে এবারের লকডাউন যে ঠিক কতটা কাজে এসেছে তা আমরা ঠাওর করে উঠতে পারছি না। এখনও উর্ধমুখী নতুন রোগী শনাক্তের হার আর দৈনিক মৃত্যু কিংবা রোগী শনাক্তের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশে কোভিড প্রতি সপ্তাহেই গড়ছে নতুন নতুন জাতীয় রেকর্ড। পাশাপাশি মৃত্যুর হার এবং নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যা দুই বিবেচনাতেই পৃথিবীতে এই মুহূর্তে শীর্ষ দশে আমাদের অবস্থান। তবে সাম্প্রতিক কঠোর লকডাউনের সুফল ঘরে তোলার সময় এখনও সম্ভবত আসেনি। কারণ কোভিড রোগটাই এমন যে, লকডাউনের ১৪ দিন শেষ হলে তার পরেই শুধু বোঝা যায় কতদূর কার্যকর হলো তা নতুন রোগী কমিয়ে আনায়। আর যদি মৃত্যুর সংখ্যায় পরিবর্তন দেখতে চান তাহলে তো অপেক্ষা করতে হবে আরও ৭ দিন অর্থাৎ এবারের লকডাউনের শুরু থেকে তিন সপ্তাহ। তবে এতটুকু নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, এই ১৪ দিনে লকডাউনের এটুকু বাড়াবাড়ি না থাকলে এখন এদেশে কোভিড পরিস্থিতি যে কোন্ ভাগাড়ে গিয়ে দাঁড়াত তা আমরা চিন্তাও করতে পারছি না। এখনও আমাদের কোভিড হাসপাতালগুলোয় যে হাতেগোনা কিছু সাধারণ বেড আর আইসিইউ খালি আছে সেখানে উপচে পড়ে রোগীদের এখন ঠাঁই হতো হাসপাতালের বারান্দা ছাপিয়ে রাস্তায়। কোভিড যখন বাড়বাড়ন্ত তখন এমনি পরিস্থিতিতেই শিথিল করা হয়েছে লকডাউন। তবে এবারের লকডাউনের প্রেক্ষাপটটি যেমন ছিল ভিন্ন, তেমনি চলমান এই শিথিলতাটুকুও এসেছে একেবারেই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। এর আগে আমাদের এখানে কোভিডের যে দুটি বড় ঢেউ আঘাত হেনেছিল এবারেরটা সেগুলোর চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। কারও কারও মতে এটি কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়েরই সম্প্রসারিত রূপ। কারণ দৈনিক নতুন রোগী শনাক্তের হার কমপেক্ষ ৬ সপ্তাহ ৫ শতাংশের নিচে ধরে রাখা না গেলে বলা সম্ভব না যে, আমরা কোভিডের ঢেউটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। প্রথমবার কিন্তু আমরা এই কাজটি করতে পেরেছিলাম। তবে দ্বিতীয় দফায় সেই লক্ষ্যটি অর্জন হওয়ার আগেই আবারও তরতরিয়ে বাড়তে শুরু করে কোভিড। আর যারা চলমান ওয়েভটিকে তৃতীয় ওয়েভ বলতে চাইছেন তাদেরও কিন্তু যথেষ্ট যুক্তি আছে। কোন ওয়েভে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্তের হারটা দৈনিক হিসেবে যখন প্রথম ওয়েভকে ছুঁয়ে ফেলে তখন একে একটি আলাদা ওয়েভের মর্যাদা দিতেই হয়। এবারের যে চলমান ওয়েভ তা তো কোভিডের প্রথম ওয়েভকে হার মানিয়েছে যে কোন বিবেচনাতে সেই কবেই। কাজেই সেই হিসেবে এটি তো কোভিডের তৃতীয় ওয়েভই বটে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এটি কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভই হোক আর তৃতীয় ওয়েভ হোক, এর চরিত্র কিন্তু প্রথম দুটি ওয়েভের চেয়ে একেবারেই আলাদা। প্রথমত, প্রথম দুবার কোভিড ছড়াতে শুরু করেছিল আমাদের বড় শহরগুলো থেকে প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর দিকে। আর আমাদের সময়োচিত পদক্ষেপে, তা সে কঠোর বিধিবিধান বা লকডাউন যাই হোক না কেন, তার কল্যাণে সেই ঢেউ বেশি বাড়বাড়ন্ত হওয়ার আগেই আমরা সে দুটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলাম। অথচ এবার কোভিড বাড়তে শুরু করল আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে আর ক্রমেই তা এগোতে থাকল ঢাকার দিকে। এমনকি ঢাকার আশপাশের সাতটি জেলায় লকডাউন করেও ঠেকানো গেল না কোভিডকে। এর বড় কারণ এবার কোভিড ছড়াচ্ছে সার্স-কোভ-২’র ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে, যা ভাইরাসটির অন্য যে কোন উচ্চ সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে পঞ্চাশ শতাংশ বেশি সংক্রমণের সক্ষমতা রাখে। এই দফায় লকডাউনটি শিথিল করার বিষয়টি কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তিতেই ধোপে টিকবে না সত্যি এবং কেউ সেই চেষ্টাও করছেন না। নীতিনির্ধারণী মহল থেকে কোরবানির ঈদকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা-কে পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলা হচ্ছে ঠিকই, তবে আমার মনে হয় এটিও আংশিক সঠিক। অতিমারীর মধ্যে গত তিনটি ঈদের অভিজ্ঞতায় এটি এখন স্পষ্ট যে, মানুষ কথা শুনছে না। তারা যে কোন মূল্যে গ্রামে যাবেই যাবে। যাবে প্রয়োজন হলে হেঁটে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে। কোভিডের মধ্যেও মানুষের চাপে গত ঈদে শুধু মানুষ পারাপারের জন্য সরকারকে পদ্মায় নামাতে হয়েছিল বাড়তি ফেরি আর যমুনা ব্রিজে একদিনে আয় হয়েছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ টোল। আমার ছোটবেলায় আমি কখনও এত মানুষকে এভাবে দলবেঁধে ঈদে বাড়ি যেতে দেখিনি। বড়বেলায় এসে তা দেখছি, কারণ আজ মানুষের হাতে এমনকি এই করোনাকালেও উৎসবে ব্যয় করার মতো বাড়তি কিছু টাকা আছে আর পাশাপাশি দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও ঘটে গেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। অথচ যে মহীয়সী নারীর কারণে আমাদের এই শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি সেই প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানেও আমরা সাড়া দেইনি। ধর্মীয় উৎসব পালন করতে গিয়ে আমরা দাম দেইনি ধর্মীয় বিধিবিধানগুলোকেও। আমাদের ধর্মে বলা আছে মহামারীর সময় যেখানে মহামারী আছে সেখানে না যেতে, আর মহামারী যদি ঘরের দোরগোড়ায় এসে হাজির হয় তাহলে ঘরের দরজা বন্ধ রাখতে। আজ যখন গোটা দেশটাই কোভিড মহামারীর হটস্পট, তখন গ্রামে যাওয়া তো দূরে থাক ঘর থেকে অকারণে বের হওয়াই তো ধর্র্মীয় অনুশাসনের পরিপন্থী। পাশাপাশি আমরা কেমন যেন খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। কোভিডে এদেশে এখন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় সতেরো হাজারেরও বেশি মানুষ। দেশের এমন কোন জেলা নেই যেখানে অন্তত শ’খানেক মানুষ কোভিডে প্রাণ হারাননি। অর্থাৎ কোভিডের কালো থাবায় এরই মাঝে ঈদ চিরতরে হারিয়ে গেছে দেশের অন্তত প্রায় সতেরো হাজারেরও বেশি পরিবারের জীবন থেকে। অথচ আমাদের প্রতিবেশী পরিবারটির জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া ঈদের আনন্দে মাততে আমাদের এতটুকুও বাধছে না। কাজেই মানুষ যখন যাবেই তখন মানুষের সেই যাওয়াটাকে ফ্যাসিলিটেট করার জন্যই সম্ভবত কঠোর লকডাউনে এবারের এই শিথিলতা। তবে এই ক’দিনেই শিথিলতার সুযোগে মানুষের বেপরোয়া আচরণে ঈদের পর পরই কোভিডের আরেক দফা চোখ রাঙানির শঙ্কাটা বুকে কাঁপন ধরাচ্ছে। কঠোর লকডাউনটি শিথিল করা হয় রাত বারোটায়। সেদিন সন্ধ্যায় আমার বিটিভিতে একটা টকশোতে অংশ নেয়ার কথা ছিল। ল্যাবএইড থেকে রওনা হয়ে আমি সেদিন দেড় ঘণ্টায় বিটিভিতে যখন পৌঁছি, ততক্ষণে লাইভ টকশোটির পনেরো মিনিট পার হয়ে গেছে। পথে তীব্র জ্যামে বসে আমি ভাবছিলাম মানুষের এই উন্মত্ত আচরণের কারণ কি? আমার মনে হয়েছে আমাদের মধ্যে যারা ততটা সৌভাগ্যবান নন, যাদের প্রতিদিন চুলা জ্বালাতে ঘরের বাইরে ছুটতে হয়, তাদের ঘরে ধরে রাখার জন্য সরকারী প্রণোদনা নিঃসন্দেহে অশেষ। কিন্তু শেষমেষ তার সবটুকু বোধ করি সব অভাবী ঘরে পৌঁছাচ্ছে না। এজন্য আমরা বড় বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি আমাদের দক্ষ আমলাতন্ত্রের ওপর। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, একজন প্রশাসক যত দক্ষই হোন না কেন, এলাকায় কোন্্ ঘরে চুলা জ্বলে না তার খবর সবচেয়ে ভাল রাখেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। কারণ দিন শেষে ওই জনপ্রতিনিধিকেই তার ভোটারের কাছে ভোট ভিক্ষা চাইতে যেতে হয়। পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিগুলোকেও আমরা সম্ভবত এখনও ঠিকঠাকমতো মবিলাইজ করতে পারিনি। আমি যদি ভুল না জেনে থাকি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় থেকে গ্রাম পর্যন্ত কমিটিগুলোয় মোট পদের সংখ্যা পঞ্চাশ লাখের বেশি। গণমানুষের এই সংগঠনটির কর্মীদের কথা বাদই দিন, আমরা যদি শুধু এই দলটির নেতাদেরও মাঠে নামাতে পারি আমার বিশ্বাস কোভিডকে বনবাসে পাঠানো আমাদের জন্য কোন কঠিন বিষয় হবে না। আমরা যদি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা তারও আগে স্বাধীনতার জন্য চব্বিশ বছরের প্রস্তুতি পর্বের দিকে ফিরে তাকাই দেখব যে, সেখানে সাংস্কৃতিক কর্মীদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। জাতির পিতা কখনই শুধু রাজনৈতিক শক্তির ওপর ভরসা করেননি। তাঁর সমান আস্থা ছিল এদেশের সংস্কৃতিকর্মী, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী আর বুদ্ধিজীবীদের ওপরও। এখন যখন আমরা আরেকটি যুদ্ধে লিপ্ত তখন বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি হয়ে আমরা নিশ্চয়ই তাঁর দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত হতে পারি না। দেশের মানুষকে সারাক্ষণ দায়ী না করে আমাদের বরং উচিত এই জায়গাগুলোয় আরেকটু মনোনিবেশ করা। তবে এও সত্যি যে, আমাদের মধ্যে এমনি অনেক মানুষ আছেন যারা দেখেও দেখেন না, আর বুঝেও বুঝতে চান না। তারা সঙ্গে মাস্ক রাখেন ঠিকই, তবে তা থাকে তাদের পকেটে, নচেৎ খুব বেশি হলে থুতনিতে। এরা কারণে-অকারণে লকডাউন দেখতে রাস্তায় বের হন। এই মানুষগুলোকে ঘরে ঢোকাতে হলে শুধু সচেতনতায় আস্থা রাখলে হবে না, এক্ষেত্রে এনফোর্সমেন্টের কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি গরুর হাট থেকে শুরু করে দূরপাল্লার গণপরিবহন অথবা শপিং সেন্টার, জনসমাগম হয় এমন জায়গাগুলোতে প্রবেশের সময় এ্যান্টিজেন টেস্ট করার বিষয়টি বিবেচনায় আনা যেতে পারে। এটি আজ অনস্বীকার্য যে, সামনে আমাদের আরও এক বা একাধিক কোভিড ওয়েভের মোকাবেলা করতে হবে। কাজেই এ দফায় না হোক, অন্তত আগামী দফায় সফল লকডাউন আর কোভিড মোকাবেলায় সাফল্য নিশ্চিত করায় আমরা এসব বিষয় বিবেচনা করতে পারি। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতি রাখতে হবে চিকিৎসার ময়দানেও। আমরা এরই মধ্যে দেখেছি সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভেনশন সেন্টারে একটিসহ আরও বেশ কটি আইসিইউ সমৃদ্ধ কোভিড ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমি নিশ্চিত আমরা কোভিডের চলমান ওয়েভটিকে আর বড়জোর মাসখানেকের মধ্যে বশে আনতে পারব। আমার অনুরোধ একটাই, যতদিন না আমরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশের কমপক্ষে আশি শতাংশ মানুষকে কোভিড ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে পারছি, দেশে কোভিডের পরিস্থিতি যাই থাকুক না কেন, অন্তত সেই লক্ষ্যটি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত এই ফিল্ড হাসপাতালগুলো যেন ডিসম্যান্টেল না করা হয়। আমাদের ব্যবসায়ী এবং পেশার প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনগুলোকেও তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ভারতে চলমান কৃষক আন্দোলনে আমরা দেখেছি কৃষক সংগঠনগুলো আন্দোলনরত কৃষকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনতে বিতরণ করেছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী আর স্থাপন করেছে এমনকি ফিল্ড হাসপাতালও। আমাদের শ্রমিক সংগঠনগুলোর আর ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের এ থেকে শেখার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয়। সঙ্গত কারণেই চলে আসে টিকার প্রসঙ্গটিও। আমরা লক্ষ্য করছি সরকার প্রবাসী, ছাত্রসহ বিভিন্ন টার্গেট গ্রুপকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার আওতায় আনছে। আমার মনে হয় গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্প এবং পরিবহন শ্রমিকদেরও এই অগ্রাধিকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। সচেতন হতে হবে টিকা বাছাইয়ের বেলাতেও। আমি প্রায় নিশ্চিত সামনে আমাদের হাতে এত বেশি টিকা চলে আসবে যে, টিকার সঠিক ব্যবস্থাপনা আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমরা যদি আমাদের টিকার সংগ্রহশালার দিকে ভাল করে তাকাই দেখব যে, আমরা পয়সা দিয়ে যে পরিমাণ টিকা আনতে পেরেছি তার চেয়ে বেশি টিকা এসে গেছে বা আসবে উপহার হিসেবে। এর একটাই কারণ, আর তা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের নতুন ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব। এখন জি-৭ই বলুন অথবা চীন, রাশিয়া কিংবা ভারত, এই সবগুলো সোর্স থেকেই আমাদের টিকা পেতে কোন সমস্যা হবে না। কারণ আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে সত্তর, আশি কিংবা নব্বই দশকের বাংলাদেশের তো বটেই, এমনকি চলমান শতকের প্রথম দশকের বাংলাদেশেরও যোজন যোজনের ফারাক। আমি কোন বিশেষ টিকার নাম বলতে চাই না। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে এ কথা এখন আমাদের সবারই জানা যে, চিলি, সিশেলিস, মঙ্গোলিয়া আর বাহরাইনের মতো দেশগুলো একটি বিশেষ টিকা ব্যবহার করে তাদের জনগোষ্ঠীকে হার্ড ইমিউনিটির জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যার কাছাকাছি ভ্যাকসিনেশন করার পরও এখন কোভিড সংক্রমণে পৃথিবীতে শীর্ষ দশে। কারণ টিকা প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করেনি। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা একটি বিশেষ টিকা নিতে প্রকাশ্যে আপত্তি জানিয়েছেন। কারণ ওই টিকাটি নেয়ার পরও শতশত স্বাস্থ্যসেবাকর্মী সে দেশে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। আর ইন্দোনেশিয়ায় তো একটি বিশেষ ভ্যাকসিন গবেষণার প্রধান গবেষক নিজেই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে দুঃখজনকভাবে সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেছেন। যেহেতু সামনে আমাদের কোভিড ভ্যাকসিনে ঘাটতির শঙ্কা নেই, কাজেই ভ্যাকসিন বাছাইয়ে আরেকটু চিন্তা-ভাবনার বোধ করি প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি এক সঙ্গে এতগুলো ভ্যাকসিন রোল আউট করে সেকেন্ড ডোজ যথাযথভাবে দেয়া যাবে কিনা আর ভবিষ্যতে যদি বুস্টারের প্রয়োজন পড়ে, তখন তাও সময়মতো পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ও বিবেচনায় রাখা জরুরী। আমার সীমিত জ্ঞানে আমি দ্বিতীয় আর কোন দেশের কথা জানি না যেখানে একসঙ্গে চার ধরনের ভ্যাকসিন রোল আউট করা হচ্ছে। আর পাইপলাইনে আছে আরও তিন ধরনের ভ্যাকসিন। কোভিডের সঙ্গে প্রায় দুটি বছর ঘর-সংসার করার পর এটা এখন পরিষ্কার যে, কোভিড থাকতে না আসলেও সহসাই যেতেও আসেনি। কাজেই কোভিড সচেতনতা থেকে ব্যবস্থাপনা সব ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাটা জরুরী। মানুষের উদাসীন আচরণ আর মাঝে মাঝে কিছু ম্যানেজমেন্ট বিভ্রাট আমাদের হয়ত সাময়িক আশাভঙ্গের কারণ হয়। কিন্তু মোটা দাগে আমার কাছে মনে হয় যে, আমাদের কোভিড যাত্রাটা আমাদের দেশজ প্রেক্ষাপটে ঠিক পথেই এগোচ্ছে। এর বড় কারণ যে, আমাদের অনুকরণীয় নেত্রী। তা না হয় আরও একবার না-ই বললাম, কিন্তু দিন শেষে বাস্তবতা সেটাই। সামনে বাংলাদেশ কোভিড ভ্যাকসিন উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করবে আর সেই ভ্যাকসিন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমরাও সামনে কোভিডের বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করব। পুরো জাতির সঙ্গে আমি এখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছি। কারণ এটি আজ প্রমাণিত যে, ভ্যাকসিনেই চূড়ান্ত মুক্তি। আর সেই বিজয়ের দিনটি যতদিন না আসছে, অন্তত ততদিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কিন্তু কোন বিকল্প নেই। লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
×