ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জ্ঞানের মশাল হাতে বাঙালীর বিদ্যাসাগর

প্রকাশিত: ২০:১৮, ৯ এপ্রিল ২০২১

জ্ঞানের মশাল হাতে বাঙালীর বিদ্যাসাগর

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকালে এক অসামান্য প্রতিভাধর, সমাজসেবক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, বাংলা গদ্যের বিন্যাসকারী, শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত ও লেখক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত বাংলার হুগলি জেলার বীরসিংহ গ্রামে। প্রকৃত পণ্ডিত কে এবং পাণ্ডিত্য কি ও তা কিভাবে জীবন ও সমাজে প্রয়োগ করা উচিত তা বিদ্যাসাগর সারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যে মানুষ কেবল নিজের পরিবার বা নিজের গ্রাম নয় বরং আলোয় ভরিয়ে দিয়েছেন তৎকালীন সময়ে নানা কুসংস্কার, প্রথায় পূর্ণ সামজ, এই ভারতবর্ষকে। একজন দক্ষ নাবিক যিনি একাই তার দক্ষ হাতে নৌকা স্বরুপ সমাজকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে চলার প্রত্যয়ে দৃঢ় ছিলেন। যার ব্রত ছিল পরোপকার, মানব মুক্তি। যে আলো আজও সমাজকে আলোকিত করে চলেছে। যার আন্দোলন ছিল কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলন। পারিবারিক উপাধি বন্দ্যোপাধ্যায় হলেও তার জ্ঞানার্জন, মেধা এবং প্রজ্ঞায় বিদ্যাসাগর বলেই তিনি আজ সুপরিচিত। যে নারী মুক্তির জন্য, নারীর অধিকারের জন্য আজও লড়াই চলছে সেই লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই। সেই দুইশ’ বছর আগেই তিনি বুঝেছিলেন নারী শিক্ষার গুরুত্ব। তিনি জানতেন শিক্ষা ছাড়া এই মুক্তি অসম্ভব। তিনি নারী শিক্ষা প্রসারে ছিলেন পরিকর। বরাবর তিনি নারী শিক্ষা প্রসারে কাজ করে গেছেন। দেখেছিলেন সমাজে নারীদের দুর্দশা। হিন্দু নারীদের বিবাহ এবং বিবাহ পরবর্তী বৈর্ধব্য জীবনের দুর্দশার চিত্র তিনি অনুভব করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে হিন্দু নারীদের স্বামীর মৃত্যুর পর আর বিয়ে করার সুযোগ ছিল না। কঠিন নিয়মের বাতাবরণে আমৃত্যু পার করতে হতো তাদের। বিপরীতে বহুবিবাহ ছিল একটি নৈমিত্তিক বিষয়। বাল্যবিবাহের কুফল সেই দুইশ বছর আগেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আজ অবধি যে সমস্যা সমাজে রয়েছে। সেই লড়াই শুরু হয়েছিল সেই কবেই। তিনি লড়াই করেছেন এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে। বিধবা বিবাহ আইন পাস করতে গিয়ে তাকে বহু সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। রক্ষণশীল সমাজের সমাজপতিদের সঙ্গে তাকে লড়তে হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি একাই লড়াই চালিয়ে গেছেন। সমাজকে করতে চেয়েছেন কুসংস্কারমুক্ত। সংস্কার করে গেছেন সেই সব কুসংস্কার যা সমাজকে অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছিল। তাই তিনি সমাজ সংস্কারক হিসেবেও বেশি পরিচিত। যা কিছু তার পাণ্ডিত্যে ঠিক মনে করেছেন তা প্রতিষ্ঠা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তার জীবনজুড়ে ছিল কেবল মানুষের মুক্তির চিন্তা। আর এই চিন্তার বাস্তবায়নে শিক্ষা প্রসারে কাজ করে গেছেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। তার অগাধ পাণ্ডিত্য, মেধা আর জ্ঞান অতুলনীয়। বিদ্যাসাগর সত্যিই অদ্বিতীয়। বাংলা গদ্যে তার অবদান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন, ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কর্মকুশলতা দান করিয়াছিলেন। মানুষের বিচার তার কর্মে এই বিশ্বাসে প্রতিফলিত হয়েছে তার জীবনধারা। তার চিত্র অতি সাধারণ ছিল। অথচ তিনি জীবনে অর্থ উপার্জন করেছেন প্রচুর। কিন্তু ঐ যে মানব মুক্তি। সেই মানুষের জন্যই তিনি অকাতরে কাজ করে গেছেন। দিয়েছেন দু’হাত ভরে। এক অতি সাধারণ বেশ, সাধারণ জীবন-যাপন এই এক চিত্রই আমরা দেখতে পাই। তার ধুতিচাঁদর-চটি পরা বেশেই তিনি পরিচিত। তার সামাজিক দায়বদ্ধতার তীব্র অনুভব, সমাজ সেবার তীব্র আকাক্সক্ষা, সমাজের অন্ধকারে আলোর পথ দেখানো এসবই তার বৈশিষ্ট্য। তার দ্বার থেকে কেউ শূন্য হাতে ফিরে যেত না। আর্ত ও পীড়িতদের জন্য তিনি তার সামর্থ্য মতো উজাড় করে দিয়েছেন। নারী শিক্ষার প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারতের প্রথম ভারতীয় বালিকা বিদ্যালয়। এটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে তিনি ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে নদীয়া, বর্ধমান ও হুগলী ও মেদেনীপুর জেলায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। স্ত্রী শিক্ষা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা অনুভব করেছিলেন সেই দুইশ বছর আগেই। তিনি চেয়েছিলেন মেয়েদের বাল্যবিয়ে বন্ধ হোক। তিনি চেয়েছিলেন স্বামী মারা যাওয়ার পর যেন হিন্দু নারীরা পুনরায় বিবাহের অধিকার পায়। এই বিধবা বিবাহ আইন পাসের বিপক্ষে অর্থাৎ বিধবা বিবাহের পক্ষেও ছিল প্রবল শক্তি। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন এবং একান্তভাবে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বহু ঘটনার পর ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই ভারতের গবর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন। সেই ছিল এক বিশাল বিজয়। তিনি কেবল আইন পাস করেই স্থির ছিলেন না। আইন পাস করার পর নিজ উদ্যোগে বিধবা বিবাহ দেওয়া শুরুও করেন। এসব বিয়ের কিছু কিছু নিজের উদ্যোগে এমনকি নিজের খরচেও আয়োজন করতেন। নিজের একমাত্র পুত্র ২২ বছর বয়সী নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিয়ে হয় ১৪ বছরের বিধবা নারী ভবসুন্দরী দেবীর সঙ্গে। তিনি নিজে উপস্থিত থেকে এই বিয়ে কার্য সম্পন্ন করেন। যদিও পরিবারের অন্য সদস্যদের এই বিয়েতে মত ছিল না। তিনি বলেছেন, বিধবা বিবাহ আমার সর্বপ্রধান সৎকর্ম। এই সৎকর্ম করতে গিয়ে তিনি অর্থ দিয়েছেন, শ্রম দিয়েছেন এবং ঝুঁকিও নিয়েছেন। সেই সময় গোড়া সমাজের বিরুদ্ধে প্রায় একা দাঁড়িয়ে দীর্ঘ বহু বছরের প্রথা ভাঙতে যে ঝুঁকি নিতে সাহসের দরকার হয় তা সত্যিই অতুলনীয়। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তার কিছু সাহসী শিষ্যও ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়েছিল এক অতি সাধারণ দরিদ্র পরিবারে। তার বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অল্প শিক্ষিত দরিদ্র বাহ্মণ ছিলেন। এই মানুষটিই বিদ্যাসাগরকে কলকাতায় এনে ভর্তি করালেন সংস্কৃত কলেজে। সেখানে তিনি সংস্কৃত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজীও শিখলেন। এই কলেজে অধ্যয়নকালেই ১৮৩৯ সালে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। সেই সঙ্গে ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র ও দর্শন বিষয়েও শিক্ষালাভ করলেন। তার কর্মজীবন শুরু হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের হেড পণ্ডিত হিসেবে। সেখানে কয়েক বছর চাকরি করার পর তিনি যোগদান করেন সংস্কৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারি হিসেবে। পথ পরিক্রমায় তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এর সঙ্গে অধ্যক্ষ পদের অতিরিক্ত সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্বও দেয়া হয়। তিনি নিজেই সংস্কৃতযন্ত্র নামে একটি পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তিনি একের পর এক মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন, অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন। তার বহুল পরিচিত ’বর্ণপরিচয়’ (১ম ও ২য় ভাগ ১৮৫৫) শিশুশিক্ষায় একটি অসামান্য অবদান। তিনি হিন্দী ‘বেতাল পচ্চিসী’ পুস্তক অবলম্বনে রচনা করেন বেতাল পঞ্চবিংশতি। এই গ্রন্থেই তিনি বিরাম চিহ্নের সফল প্রয়োগ ঘটান। বাংলা সাহিত্যকে সুশৃঙ্খল ধারায় আনেন। তার মৌলিক গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ’বিধবা বিবাহ হওয়া চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫)’, ’বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব এর দুই খণ্ড, অতি অল্প হইল এবং আবার অতি অল্প হইল, ভ্রান্তিবিলাস, ব্রজবিলাস, (১৮৮৪), শব্দমঞ্জুরী (১৮৬৪)। তার অনুবাদ গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। সম্পাদনাও করেছেন। সংস্কৃত থেকে বাংলা ’শকুন্তলা’, সীতার বনবাস, মহাভারতের উপক্রমণিকা, ইংরেজি থেকে বাংলা গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন কয়েকটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভ্রান্তিবিলাস, বোধোদয়, কথামালা, নীতিবোধ ইত্যাদি। তাকেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম শিল্পী বলে অভিহিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একজন মানুষ তার মেধা ও সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে সারাজীবন ধরেই শিক্ষা বিস্তার, সাহিত্য চর্চা, নারী মুক্তি পথ দেখানো, সমাজের কুসংস্কারের সঙ্গে লড়াই করেছেন। একজন জনহিতৈষী যিনি সারাজীবন মানুষের পাশে ছিলেন। তার কাজ অক্ষয়। তিনি বাংলার বিদ্যাসাগর, তিনি বাঙালীর বিদ্যাসাগর। তার অবস্থান বাঙালীর অন্তরে।
×