ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জলি রহমান

বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক ভাবনা ও আজকের বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২৩:৫১, ২৮ মার্চ ২০২১

বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক ভাবনা ও আজকের বাংলাদেশ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। অসামান্য নেতৃত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মেধা-মমত্ববোধ, সততা এবং দেশপ্রেমের প্রজ্বলিত এক অগ্নিশিখা। যার উত্তাপ এখনও চিরন্তন। মৃত্যুকে পরোয়া না করে তিনি গোটা বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। পাকিস্তানী শোষণের হাত থেকে একটি জাতিকে মুক্ত করে ‘বাংলাদেশ’ নামের এক নতুন সূর্যোদয় এনে দিয়েছে। বাঙালীর আর্থ-সামাজিক মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এদেশের দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিজেকে সপে দিয়েছিলেন। তাঁর উন্নয়ন ভাবনায় বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছে। তাই ১৯৬৬ সালের ‘ছয়-দফা’কে বাঙালীর ‘বাঁচার দাবি’ হিসেবে মুক্তি আকাক্সক্ষী বাঙালীর কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। ওই ছয়-দফার ভেতরেই বাঙালীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির বীজ তিনি বুনেছিলেন। আর সে কারণেই জেলে বন্দী থাকলেও ছয়-দফার মূল কথাগুলো দাবানলের মতো সারা বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও (১৯৭৩-১৯৭৮) গণমানুষের চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সমর্থন ভিত্তিক মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক নীতি কৌশল গ্রহণ করা হয়। সময়ের প্রয়োজনে শুরুতে রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রাধান্য দিলেও ধীরে ধীরে সমবায় ও ব্যক্তিখাতের বিকাশের জন্য উপযুক্ত নীতি সংস্কারেও তিনি হাত দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট, রেল, বন্দর, কেন্দ্র্রীয় ব্যাংক, প্রশাসন, শিক্ষালয়, হাসপাতালসহ ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ার কাজে দিনরাত পরিশ্রম করতেন। দুর্যোগ দুর্বিপাক মোকাবেলা করে খাদ্য ঘাটতি পূরণে বিদেশী সহযোগিতা ও স্বদেশের কৃষি উন্নয়নেও তিনি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। এক ডলারও বিদেশী মুদ্রার মজুদ ছিল না তাঁর হাতে। তবু স্বদেশের অর্থনীতির চাকা ফের সচল করেছিলেন অতি অল্প সময়েই। অনেক পরিশ্রমের ফসল যখন ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত ঠিক তখনই বাংলাদেশের শত্রুরা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট আচমকা আঘাত করে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর প্রিয় দেশবাসী থেকে। কিন্তু তিনি রয়ে গেছেন আমাদের মাঝে। আছেন বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়েই। সারাজীবনই দেশ ও মানুষের উন্নয়নের কথা ভেবেছেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কমিয়ে আনা, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য কমিয়ে আনা, সকল ধরনের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে সাধারণ মানুষের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা, কর্মসংস্থান ও কর্মমুখী মানুষ তৈরি করা, সকল ধরনের সেবা বাড়ানো এসবই তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন ও বাস্তবায়নে স্বচেষ্ট ছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টিভি ভাষণে ‘কেমন বাংলাদেশ চাই?’ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোন অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ব।’ বঙ্গবন্ধু তাঁরই উদ্ভাবিত উন্নয়ন দর্শন বাস্তবে রূপ দিতে অন্যতম মৌল-উপাদান হিসেবে সমবায়ের অন্তর্নিহিত শক্তি পুরোমাত্রায় ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল গ্রামীণ সমাজে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশের প্রতিটি গ্রামে গণমুখী সমবায় সমিতি গঠন করা হবে, যেখানে গরিব মানুষ যৌথভাবে উৎপাদন যন্ত্রের মালিক হবেন, মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীরা গরিবের শ্রমের ফসল আর লুট করতে পারবে না, শোষণ ও কোটারি স্বার্থ চিরতরে উচ্ছেদ হয়ে যাবে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে বাংলার মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে, বেকারত্ব দূর হবে সেই ভাবনাই ছিল তাঁর মনে। এজন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি বলেছিলেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’ বঙ্গবন্ধু নানা বক্তৃতায় সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের কথা, মানমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার মৌল আকাক্সক্ষা পূরণ ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা বারবার বলেছেন। ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীর এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘আমি কি চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কি চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণভরে হাসুক।’ সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা পূরণের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা পূরণের পথেই হাঁটছে আজকের বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে যেসব সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেন তা শেষ করার মতো যথেষ্ট সময় সে পায়নি। তবে ওই উদ্যোগগুলো নিয়েছিলেন বলেই এতদিনে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মজবুত কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াই করে গেছেন। তিনি বাঙালী কৃষককুলের কথা সবসময় ভাবতেন। তার শোষণহীন সমাজ গঠনের অভিপ্রায়ের বড় অংশজুড়ে ছিল কৃষক। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, কৃষির উন্নতি ছাড়া এ দেশের মানুষের মুক্তি আসতে পারে না। কৃষকেরাই এ দেশের প্রাণ। সোনার বাংলা গড়ার কারিগর। স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও সর্বক্ষণ কৃষক-অন্তঃপ্রাণ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বেতার-টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বঙ্গবন্ধু কৃষকদের কথা এভাবে বলেছিলেন, ‘আমাদের চাষীরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে। কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সদ্য স্বাধীন দেশের ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে তাৎক্ষণিক আমদানি, স্বল্প মেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণ সরবরাহ, কৃষি ঋণ মওকুফ, পাকিস্তানী শাসনকালের সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার এবং কৃষকের মাঝে খাসজমি বিতরণ করে কৃষির উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করেন। কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। উচ্চতর কৃষি গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৭৩ সালের মধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি-অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরদিনের জন্য রহিত করেন। শক্তিচালিত সেচ পাম্পের সংখ্যা ১১ হাজার থেকে ৩৬ হাজারে উন্নীত করেন। বিশ্ববাজারে সারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সারে ভর্তুকি দিয়ে কৃষককে রক্ষা করেন। কৃষকদের সততা ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল স্বচ্ছ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। ১৯৭৫ এর ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। বঙ্গবন্ধুর সচেতন ও কৃষকদরদী নীতির ফলে কৃষিতে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল তারই ফলে আজ কৃষি খাত শক্তিশালী হয়েছে। বর্তমান মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার। চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। তবে কোভিড ১৯ সংক্রমণের কারণে প্রবৃদ্ধির হার শিথিল করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। যা এশিয়ার সব দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। রেমিটেন্স, রফতানি সকল ক্ষেত্রে সফলতা এখন ঈর্ষণীয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতির পিতা আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে তিনি অমর, অবিনশ্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে চিরজাগ্রত। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। তাঁর আদর্শ চিরঅম্লান। তাঁর অর্থনৈতিক ভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, দেশের প্রত্যেকটি নাগরিককে প্রকৃত দেশপ্রেমিক, সৎ, নিষ্ঠাবান, সাহসী ও ত্যাগী দেশকর্মী হওয়া উচিত। তাঁর সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গোটা জাতিকে উন্নত করতে একযোগে কাজ করা প্রয়োজন। তবেই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সত্যিকারের ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা’, যেমনটি বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন। আশার কথা হলো, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাজে তাঁরই সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। ফলে দেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে ভিশন ২০২১ কে অতিক্রম করে ২০৪১ এর পথে। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। যা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল।
×