ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার ম্যারাডোনা

প্রকাশিত: ২০:৪২, ২৮ নভেম্বর ২০২০

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার ম্যারাডোনা

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার দিয়াগো ম্যারাডোনা চলে গেলেন মাত্র ৬০ বছর বয়সে। বিশ্বের অগণিত ভক্তের মতো আমরাও ভীষণ শোকাহত এবং কোনভাবেই তার এই অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা এবং এই জনপ্রিয় খেলার মাঝে জাদুর ছোঁয়া লাগিয়ে যে ব্যক্তি বিশ্বব্যাপী ভিন্ন মাত্রার ফুটবলনৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন, তিনি হলেন এই ম্যারাডোনা। ফুটবলের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই কিংবদন্তি ফুটবলার ম্যারাডোনার নাম। ম্যারাডোনা যে মাত্রার ফুটবল নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তা অতীতে আর কোন ফুটবলার দেখাতে সক্ষম হননি। ভবিষ্যতে ম্যারাডোনার মতো এমন অসাধারণ ফুটবল খেলা দেখতে হলে আর কতদিন অপেক্ষা করতে তা কেউ বলতে পারবে না। ফুটবল গোলের খেলা। তাই অনেক নামী-দামী খেলোয়াড় গোলের পর গোল করে অনেক বিশ্বরেকর্ড করলেও, কেউই ম্যারাডোনার মতো ফুটবল নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হননি। এখানেই ম্যারাডোনার সার্থকতা এবং বিশেষত্ব। ম্যারাডোনা ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ খেলা দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল অঙ্গনে পদার্পণ করেন। শুরুটা খুব একটা সুখকর না হলেও, ১৯৮৬ এর বিশ্বকাপ আসরে তিনি সদর্পে আবির্ভাব হন। সেই বিশ্বকাপ আসরে ম্যারাডোনা ফুটবল নৈপুণ্য প্রদর্শনে একেবার তুঙ্গে ছিলেন এবং বলা যায় একক প্রচেষ্টায় বিশ্বকাপ জয় করেছিলেন আর্জেন্টিনার পক্ষে। সেই বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা যে শুধু তার সেরা ফুটবল নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন তাই নয়, সেই আসরে তিনি অনন্য মাত্রার এক ফুটবল খেলা উপহার দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান। সেই বিশ্বকাপ আসরের প্রতিটা খেলায় ম্যারাডোনা ছিল প্রতিপক্ষের জন্য এক আতঙ্ক। ম্যারাডোনা বল ধরা মানেই নিশ্চিত প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে ঢুকে যাওয়া, যা থেকে গোল হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। সে কারণে প্রতিপক্ষকে সবসময় দুতিনজন খেলোয়াড়কে নিয়োজিত রাখতে হতো শুধু ম্যারাডোনাকে নিবৃত করার জন্য। বল নিয়ে ছুটে চলার ক্ষেত্রে ম্যারাডোনার যে অপ্রতিরোধ্য দৌড় তা আগে আর কোন খেলোয়াড় কখনও দেখাতে সক্ষম হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। অনেক ফুটবলারই অন্যদের তৈরি করা বল গোলপোস্টে ঠেলে দিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু কয়জন খেলোয়াড় মধ্যমাঠ থেকে বল নিয়ে একক প্রচেষ্টায় প্রতিপক্ষের সব খেলোয়াড়কে পাশ কাটিয়ে গোলপোস্ট পর্যন্ত চলে যাওয়ার নৈপুণ্য দেখাতে পেরেছেন তা কেউ বলতে পারবে না। ফুটবল খেলায় এমন বিশেষ নৈপুণ্য একমাত্র ম্যারাডোনাই দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৮৬ এর বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলায় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যারাডোনা একক প্রচেষ্টায় এরকম একটি গোল করে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বসেরা ফুটবলের খেতাব পেয়ে যান। গোলটি এতটাই চমৎকার ও দর্শনীয় ছিল যে সেই গোলকে শতাব্দীর সেরা গোলের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ম্যারাডোনা নিজে সেরা খেলা প্রদর্শনের পাশাপাশি ছিলেন একজন দক্ষ টিম মেকার। কিভাবে সম্মিলিতভাবে ভাল খেলা উপহার দেয়া যায়, কিভাবে টিমকে দিয়ে সেরা খেলা খেলানো যায়, এ ব্যাপারে ম্যারাডোনা ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। ম্যারাডোনা যখন তার সেরা ক্রীড়ানৈপুণ্যের কারণে প্রতিপক্ষের ক্রমাগত আক্রমণের শিকার হচ্ছিলেন তখন তিনি এক চমৎকার বিকল্প কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। প্রতিটা খেলায় ক্যানিজিয়া নামের এক খেলোয়াড়কে তিনি তৈরি করেছিলেন এবং তাকে দিয়ে অনেক গোল করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ম্যারাডোনা যখন বল নিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে ঢুকে যেতেন তখন বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় তাকে এমনভাবে ঘিরে ধরত যে ম্যারাডোনার পক্ষে আর গোল করা সম্ভব হয়ে উঠত না। এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য ম্যারাডোনা তখন নিজে গোল করার ঝুঁকি না নিয়ে, উল্টো কয়েকজন খেলোয়াড়কে এদিকে ব্যস্ত রেখে সুকৌশলে বলটা ক্যানিজিয়াকে দিয়ে দিতেন, আর ক্যানিজিয়া অনায়াসে বল প্রতিপক্ষের জালে ফেলতে পারত। এভাবে খেলেই ম্যারাডোনা ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। এমনকি সেই ফাইনালেও ম্যারাডোনার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় নিশ্চিতই ছিল যদি না রেফারির অন্যায় আচরণের শিকার না হতেন। সেই বিশ্বকাপের ফাইনাল পর্বের সমগ্র খেলায় প্রতিপক্ষ জার্মানি আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে একটি গোলও করতে সক্ষম হয়নি। অবশেষে খেলার একেবারে শেষ মুহূর্তে রেফারি অন্যায়ভাবে একটি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিয়ে ম্যারাডোনার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। ম্যারাডোনা বিশ্বসেরা ফুটবল খেলা উপহার দিয়ে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মন জয় করলেও প্রতিনিয়ত কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে বিমাতাসুলভ আচরণই পেয়েছেন। বিশ্বসেরা ফুটবল নৈপুণ্য প্রদর্শনের কারণে ম্যারাডোনা কখনই স্বাভাবিক খেলা প্রদর্শন করতে পারেননি। কেননা ম্যারাডোনা বল পাওয়া মাত্রই প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা অন্যায়ভাবে ফাউল করে তাকে থামিয়ে দিত। ম্যারাডোনাকে যতবার ফাউলের শিকার হতে হয়েছে, মনে হয় না আর কোন খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়েছে। এসব ইচ্ছাকৃত ফাউলের বিরুদ্ধে গতানুগতিক হলুদ কার্ড প্রদর্শন ব্যতিরেকে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ফিফাকে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপের এক খেলায় হঠাৎ করেই ম্যারাডোনার ডোপ টেস্ট করে মাদক গ্রহণের অভিযোগে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করা হয়। খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে ড্রাগ নেয়ার অভিযোগ নতুন কিছু ছিল না, অন্তত সেই সময়। তাহলে শুধু ম্যারাডোনার কেন ডোপ টেস্ট করা হলো, অন্য কোন খেলোয়াড়কে কেন ডোপ টেস্ট করা হলো না, সেই প্রশ্ন আজও সকলের মনে দাগ কেটে আছে। সেই ঘটনাই মূলত ম্যারাডোনার জীবনকে তছনছ করে দেয়। সেই ঘটনার পর ম্যারাডোনা আর কখনই ফুটবলে ফেরেনি। ফলে বিশ্ব ফুটবলের উন্নতিকল্পে যে ধরনের অবদান ও ভুমিকা তার মত একজন বিশ্বসেরা ফুটবলারের রাখার কথা ছিল, সেটি আর তিনি রাখতে পারেননি। নানান বিষয়ে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ফিফার সাথে বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন, ফলে ফিফার হয়ে কাজ করার সুযোগ একেবারেই পাননি। একরার আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পেলেও, খুব একটা সফল হতে পারেননি। ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের কোচের দায়িত্ব পেলে সকলেই আশা করেছিল যে কোচ হিসেবে ম্যারাডোনার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয় করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়নি। কেননা আর্জেন্টিনাকে সে বছর কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও ম্যারাডোনা সবচেয়ে জানপ্রিয় ফুটবলার এবং তার রয়েছে অসংখ্য ভক্ত। আমাদের দেশে আজ আর্জেন্টিনার ফুটবল দল যে এত বিপুল জনপ্রিয় তার মূলে আছে ম্যারাডোনা। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের আগে আমাদের দেশে আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের এত সমর্থক ছিল না। তখন মুলত সকলেই ব্রাজিলের সমর্থক ছিলেন। অল্প কিছু সমর্থক ছিল ইংল্যান্ড ও জার্মান দলের পক্ষে। ১৯৮৬ এর বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার এই চমকপ্রদ ফুটবল খেলা দেখেই সকলে যার পর নাই মুগ্ধ হয়ে যায় এবং সেই থেকে আমাদের দেশে রয়েছে ম্যারাডোনার অগণিত ভক্ত এবং আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের সমর্থক। ম্যারাডোনার মতো বিশ্বসেরা ফুটবলার আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দুবার গেলেও আমাদের দেশে কখনও আসেননি। আগামী বছর বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ম্যারাডোনার আমাদের দেশে আসার কথা ছিল বলে জেনেছিলাম। কিন্তু ম্যারাডোনার সাক্ষাৎ পাওয়ার সেই সৌভাগ্য আমাদের দেশের ফুটবলপ্রেমিদের আর হয়ে উঠল না। কেননা এর আগেই তিনি তার কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন পরপারে। একথা সত্যি যে অনেক প্রতিকূলতার কারণে, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিমাতাসুলভ আচরণ এবং ব্যক্তি জীবনে হতাশাকেন্দ্রিক এক ধরনের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে ম্যারাডোনা হয়তো তেমন কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। কিন্তু বিশ্বসেরা ফুটবলার হিসেবে ম্যারাডোনা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মনে যে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন তার মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন দীর্ঘদিন। বিশ্বসেরা ফুটবল মানেই ম্যারাডোনা, আর ম্যারাডোনা মানেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার। আজ তোমাকে জানাই বিদায়। নবেম্বর ২৬, ২০২০ লেখক : ব্যাংকার, টরেনটো, কানাডা [email protected]
×