ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যেন মিনিয়েচারের কৌশল

প্রকাশিত: ২৩:৫৩, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

যেন মিনিয়েচারের কৌশল

আশরাফ পিন্টুর অণুগল্প পড়তে পড়তে এক ধাক্কায় অনেক কথা চলে এলো সামনে। জানলা খুললে হঠাৎ যেমন নানা জাতের বাতাস ঢুকে আসে। হেটেরোজিনিয়াস মিক্সচার টাইপ। সেগুলো ক্রমান্বয়ে সাজানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আবারও সেই খানেই ফিরে এলাম। এমনটাই ধারণা সাহিত্য সমাজের প্রতিফলন। এ ভাবনা চলে সে কোন এরিস্টটলের সময় থেকে যে, সব শিল্প নকল বৈ কিছু নয়। আর সে নকলটাও তার চেনাজানা বোধের সীমার গ-ির মধ্যে থাকা জড় জগতকে নিয়েই। জীব যে যুক্ত সে তো বলাইবাহুল্য। পাখির ডাক নদীর ছলাৎ উভয়েই তো বাসা বেঁধেছে শিল্পের বিভিন্ন ধারায়। সময়ের সঙ্গে শুধু বদলেছে সে শিল্পের আকার বা ফর্ম আর মাধ্যম। আকৃতি বদলালেও প্রকৃতিগতভাবে মূলগত পরিবর্তন কি এসেছে? আমি ধরতে পারিনি। অবশ্য সামান্য পরিবর্তন ও তার প্রতিফলনে ভিন্নমাত্রা এনে দেয়; যেন বড় ভাস্কর্য আর মিনিয়েচরের কৌশল। চালের দানায় মহাভারত লেখার মতো। কম্প্যাক্ট। কিন্তু কি। কোন বহিরঙ্গ কি পৃথিবীর? না সেই সমান্তরালে প্রবহমান এক অন্তঃসলিলা ধারা। যা আছে; অথচ তার অনুধাবনের জন্য ভিন্নমাত্রার অনুভূতি শক্তির দরকার। মেদহীন ঋজু চলন গল্পের। প্রত্যাশা অনুযায়ী। চলমান জনজীবন থেকে খাবলে আনা একদৃশ্যের ভিন্নস্তরে বিশ্লেষণ! গভীর জীবনবোধের প্রকাশ কিছুটা তীর্যক, তিক্ত রঙে ডোবানো কিন্তু সসু তুলির আঁচড়, যেখানে অবসরের অবকাশ নেই। তারা যেন জীবনীশক্তির মতো ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে একদিক থেকে অন্যদিকে। হয়তো অন্ধকারই। অন্ধকার মনোজগত আর সমাজের আলো না ঢাকা আদিম রূপ কমবেশি প্রতিটা গল্পে ফুটে উঠেছে। যে কথারা চেতনের নাগাল পায় না পাতাল থেকে উঠে আসা সেই লুকানো সত্যিধারা একত্রিত হয়ে মুক্তি খুঁজতে হাজির হয়েছে, আর্জি জানাচ্ছে। আর লেখক পরম মমতায় তাদের আলো দেখাচ্ছেন দমবদ্ধ শ্বাসরোধকারী নির্মম বাস্তবে তার পাঠককে এনে ফেলছেন। সাবালক হচ্ছে পাঠক। এ বক্তব্য প্রাসঙ্গিক এককভাবে কোন গল্পের ক্ষেত্রে নয়। এই ধারাটিই প্রবাহিত তার সব গল্পেই। আকৃতি প্রকৃতির ভিন্নতা ব্যতিরেকেই। ফলে আপাল রৈখিক সরল চলনের নিরীহ অণুগল্প আদতে এক একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ হয়ে উঠেছে। যেখানে প্রতিটি গল্প একাধিক দিক থেকে আলোচনা এবং বিশ্লেষণ পাবার দাবিদার। মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা তো বটেই। নিচে তার ক্ষুদ্রায়তনের দুটি অণুগল্পের দৃষ্টান্ত দিয়ে আলোচনার ইতি টানব- ৩. সেদিন মাংসপট্রিতে গিয়ে দেখি ঘনা কসাই একজন মানুষকে জবাই করে প্রকাশ্যে মাংস বিক্রয় করছে। অনেকে কানাকানি করলেও কেউ কিছু বলছে না ওকে। আমি ওর কাছে গিয়ে একটু কড়া স্বরেই বলি- কী ব্যাপার, তুমি মানুষের মাংস বিক্রি করছ? তোমার সাহস তো ... আমার কথা শেষ হবার পূর্বেই ঘনা মৃদু হেসে জবাব দেয় ‘ভুল শুনছেন স্যার। আমি পশুই জবো করেছি।’ আমি আশপাশের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই তারা আমার পক্ষেই সায় দেয়। তখন ঘনা বলে, ‘আগের জন্মে হয়তবা ও মানুষ ছিল। কিন্তু আমি ওকে পশু হিসেবেই কিনেছি। কাজেই ওকে আমি আইন মতোই জবো করেছি।’ (ঘনা কসাই) ৫. হঠাৎ এক বটবৃক্ষের মনে ইচ্ছে হলো সে মানুষ হবে। শুধু মানুষ নয়- তরুণ যুবক হতে চায় সে। সে বিধাতার কাছে প্রার্থনায় রত হলো- তাকে যেন মানুষ করে দেয়। বিধাতা বললেন, ইহজন্মে নয়, তোমাকে পরজন্মে মানুষ করা হবে। কিন্তু বটবৃক্ষ নাছোড়। সে ইহজন্মেই মানুষ হতে চায়। সে আর স্থবির জরাগ্রস্থের মতো বাঁচতে চায় না, তরুণ যুবকের মতো তার বাঁচার খুব ইচ্ছে। অনেক প্রার্থনার পর বটবৃক্ষের ইচ্ছে পূরণ হয়। বটবৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় নেয়া এক তরুণীর স্পর্শে সে তরুণ যুবকে পরিণত হয়। (বটবৃক্ষের ইচ্ছে) পরিশেষে বলা যায়; লেখার গুণে ও উপস্থাপনের আপাত সারল্যে মনোগ্রাহী হওয়ায় ভাবনার জটিল চক্রব্যূহে না ঢুকেও যে কোন পাঠক গল্পের রসস্বাদন করতে পারে। আর যে কোন সাহিত্যসৃষ্টির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যর তো তাই। ভাললাগার জন্য ভাললাগা। আর এখানেই নিহিত আশরাফ পিন্টুর অণুগল্পের সফলতা এবং যথার্থ সাহিত্যমূল্য।
×