ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জনির জন্য শোক- রকি আমাদের জেতাল!

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

জনির জন্য শোক- রকি আমাদের জেতাল!

এখন থেকে ছয় বছর আগে মোহাম্মদপুরে জনি, রকি ও তাদের স্বজনদের একটি বিয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মর্মান্তিক একটি ঘটনা ঘটে। তাদের আত্মীয় তরুণীদের উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদে পুলিশের সোর্সকে থাপ্পর মেরে এ ধরনের অন্যায় আচরণ না করতে জানিয়ে ছেড়ে দেয়ার পর এর ঘণ্টাখানেক পর কয়েকজন পুলিশ নিয়ে অনুষ্ঠান স্থলে এসে দুই ভাই জনি, রকিসহ কয়েকজন স্বজনকে মারধর করে থানায় নিয়ে যায়। তারপরের ঘটনা হলো মর্মবিদারক, ভয়াবহ ‘পুলিশ’ নামধারী খুনীদের নির্যাতন। আমরা এখন সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখতে পাই জনি নামের ঐ সুদর্শন তরুণটি গায়ে হলুদের পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা অবস্থায় দাঁড়াতে, হাঁটতে প্রায় অক্ষম হয়ে পড়েছে, যাকে টেনে হিঁচড়ে থানার ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সত্যি বলতে সংবাদপত্রে বেশ কয়েকটি মর্মবিদারক হত্যাকা-ের সত্য ঘটনার প্রতিবেদনের মধ্যে এই জনি নামের তরুণটিকে মারধর করে পুলিশ কাস্টডিতে মেরে ফেলার ঘটনাটি অন্যতম, যেটি কখনোই ভুলতে পারি না। কিছু কিছু শোক আছে, যা চিরঅম্লান, চিরভাস্বর হয়ে থাকে মনের গভীরে। জনির উৎসবের সাজে উৎসবের অনুষ্ঠান থেকে কোন অপরাধ না করেও শুধু পাকিস্তানী হায়েনাদের মতো নিষ্ঠুর পশু হয়ে ওঠা পুলিশের পোশাকে কিছু অমানুষের হাতে মাত্র কয় ঘণ্টায় লাশ হয়ে যাওয়া- কোনমতেই তখনও মেনে নিতে পারিনি, এখনও মানতে পারি না। এরকম শত শত ঘটনাই আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। ফলে অন্যায়ভাবে নিহত মানুষগুলোকে নিয়ে এখন শুধু তাদের পরিবারগুলোই শোক করে। হয়তো জীবনযুদ্ধ তাদের ছাড়া কঠিন হয়ে পড়ায় তাদের জন্য দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারে শোক করার অবসরও মেলে না! এখন ‘জনি’র মৃত্যু, যা ছিল হত্যাকা- একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে শুধু একজন ভাইয়ের ভাই হত্যার বিচার লাভের জন্য অসীম ধৈর্য, পরিশ্রম, একাগ্রচিত্তে ভাই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে শত হুমকি, বাধা অতিক্রম করে একলব্যের মতো থানা থেকে আদালত, এক আদালত থেকে অন্য আদালত, আইনজীবী থেকে আইনজীবীর কাছে ছুটে বেরিয়েছে, যা শুধু আমি নয়, অবশ্যই জনগণকে বিস্মিত, মুগ্ধ ও সেই সঙ্গে প্রায় অসম্ভব একাজটি, এই হত্যার বিচার লাভকে সম্ভব করে অভিনন্দনের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। রকি, ব্রাভো বাবা, এমন একজন ভাই পেয়ে জনি নিশ্চয় ওপার থেকে গর্বিত হচ্ছে। আর তোমার মা’কেও অভিনন্দন জানাব এমন একটি দৃঢ়চেতা অকুতোভয়, ন্যায়বিচার নিশ্চিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ পুত্রের মা হবার জন্য, যে বিচারের ফলটি শুধু পরিবারকে নয়, জনগণ যারা প্রায়ই এমন অন্যায় পরিস্থিতির ফাঁদে পড়ে দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়ে অর্থমূল্যের চেয়েও অত্যন্ত দামী- বিচারের ফল এনে দিতে দেখে আশায় বুক বেঁধেছে। জনি-রকির মাকেই প্রকৃত ‘রতœগর্ভা মা’ বলা যায়, যাদেরকে সরকার নিয়মিত পুরস্কৃত করে। একজন এমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ পুত্রকে, চাচাকে পেয়ে একজন মা ও নিহত জনির পুত্র, কন্যারা, পাড়ার প্রতিবেশীরা কতটা গর্বিত বোধ করছে, আমাদের সবাইকে দেশের আইন ও আদালত এবং বিচারকের নিরপেক্ষতার ওপর আস্থাবান করে তুলেছে- এটি রকির অনেক বড় অবদান। রকি প্রিয় ভাই-এর হত্যাকারীদের উপযুক্ত দ- লাভ করে আরেকবার প্রিয় ভাইকে অন্যায়ভাবে হারানোর জন্য কেঁদেছে। খবরটি পড়তে পড়তে আমিও যেন আমার কোন সন্তান-এর হত্যার বিচার পেলাম- এ বোধে আক্রান্ত হয়ে অনেকক্ষণ কান্নার কাছে আত্মনিবেদন করলাম। প্রতিদিন বিনা অপরাধে কত শিশু, কত তরুণ, কত বধূ, কত কিশোরী ধর্ষিতা হয়ে হত্যার শিকার হচ্ছে- মন তাদের হত্যা, আত্মহত্যায় কিছুই করতে না পারার অক্ষমতায় হতাশার বেদনায় প্রায়ই ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। তার ওপর রয়েছে, হঠাৎ একদিন হারিয়ে যাওয়া তরুণদের নিখোঁজ হয়ে ফিরে আসা বা কোন দিন না আসার আশাহীন যন্ত্রণা, অপহরণকারীদের না পাওয়া ও বিচার না পাওয়ার এক বিপুল ভার! প্রধানমন্ত্রী সংসদে মন্তব্য করেছেন, নিরাপত্তা বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অপরাধ নিয়ে বেশি আলোচনা না করতে। বেশি আলোচনা হলে তারা তাদের পেশার কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারে, সেটি যেন না হয়, তারা যেন তাদের পেশার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে বলব- তারা তো শিশু নয়, বয়স্ক পেশাজীবী। এবার এই জনি হত্যার মামলার রায় একদিকে যেমন আগের সরকারের, এ সরকারের বহু ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, কাস্টডিতে পুলিশি নির্যাতনে হত্যা’র ঘটনার মধ্যে এই বিচার প্রাপ্তিটা সরকার ও দেশের আইন-আদালতের প্রতি জনমানুষের ক্ষয় হয়ে যাওয়া আস্থাকে পুনর্জীবিত করেছে!- অপরদিকে এই বিচারটি প্রমাণ করেছে- যত ক্ষমতাধর হোক আইন সবার জন্য সমান। যেটি ওরাও ভুলে ছিল, আমরাও ভুলে ছিলাম! আরও একটি ইতিবাচক অর্জন এই মাইলফলক রায়টি- খনা বা প্রাচীন প্রাজ্ঞ মানুষেরা তো বলেই গেছেন- ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’। আমার তো মনে হয়, এমন দৃষ্টান্তমূলক রায়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে তাদের স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার আচরণ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। এই ‘লেসন’ কিন্তু এই জনি হত্যার রায়ের মাধ্যমে সমগ্র বাহিনীকে একটি শিক্ষা দিয়েছে। এর প্রয়োজন ছিল, তাই নয় কি? যে কোন অন্যায় সংঘটিত হলে জনমানুষ পুলিশকে ডাকবে- এটা তাদের চাকরির দায়িত্ব। কিন্তু তারা যখন কেউ কেউ দানব হয়ে ওঠে, যেমন সব পেশাজীবীর মধ্যেই ‘দানব’ হয়ে ওঠারা রয়েছে, জনগণ চায় তাদের সবাইকেই বিচারের আওতায় আনা হবে এবং ঐসব দানবের অন্যায়ের শিকাররা ন্যায়বিচার পাবে- দানবেরা দ-িত হবে। এটা নাগরিকের অধিকার- বিচার পাওয়ার অধিকার মাত্র। এই একটি দুটি জনি হত্যার মতো ঘটনায় বিচার পাওয়া গেল বলে সরকারের সন্তুষ্ট হবার কথা। কিন্তু, কোনভাবে আইনশৃঙ্খলা বা প্রশাসক বা ভূমিগ্রাসী সাংসদ-সরকার দলীয় নেতা-পা-া, নদী-বালু দখলকারী ব্যবসায়ী নামের শঠ ব্যক্তিদের, দুর্নীতি করে হাজার কোটি টাকা আয় করা চরম অসাধু বার্গলার ব্যাংকার ব্যবসায়ীদের ক’জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে? এ তো জনগণের একটি বড় প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রীকে বলছি- র‌্যাব যখন তদন্ত করে বলে ঘোড়াঘাট ইউএনও’র বাড়িতে ‘চুরির জন্য’ ঢুকেছিল খুনীরা, তখন সত্যি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এ দিকে শুনতে পচ্ছি সরকারী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে নাকি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করা যাবে না। তাহলে এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন? আইনের কাছে সবাই সমান- এটি পরিহাস হয়ে ওঠে না কি? এই অনুমতি কেউ কি দেবে? অসম্ভব। আমার ব্যাচমেটদের মধ্যে যেহেতু ইউনিভার্সিটির সেরা ছাত্রছাত্রী ছিল, তাই এ ব্যাচের অনেকে সচিব হয়েছিল। তাদের একবার প্রশ্ন করেছিলাম ‘আচ্ছা প্রায় সব সচিব গুলশান-বনানীতে বাড়ি করল কিভাবে? কোন শিক্ষককে তো বনানীতে বাড়ি করতে দেখিনি।’ ওরা ছিল সবাই বিএনপিপন্থী। সুতরাং ওদের আমাদের নিয়ে ঠাট্টা তামাসার মধ্যে একসময় ব্যাচের অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করি। বহু অনুরোধ-উপরোধেও ২০০৮ পর্যন্ত যাইনি। অবশ্য এখন ওরা অবসরে। সত্যি তো, সচিব ও শিক্ষকদের বেতনে খুব পার্থক ছিল না, এখনো নেই। ঐদিকে সিনহা হত্যার মূল আসামিদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা দাবিকারীরা আছে বহাল তবিয়তে। তবে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, প্রাক্তন ওসি মামলার মূল আসামি কাকে ফোনে তার মামলার তথ্য জানাচ্ছে ‘স্যার, স্যার’ করে! তার বিরুদ্ধে বাড়ি থেকে তুলে এনে অর্থ নিয়ে হত্যা করা, অর্থ না দেয়ার কারণে হত্যা করার অভিযোগে ডজনখানেক মামলা হচ্ছে। তাহলে তো ঐ ‘স্যাররা’ও বিপদে পড়বে? এখন, এটাতো ওপেন সিক্রেট যে ঐ ওসি, বা এমন আরও ওসি, কমকর্তা যারা অবলীলায় বাড়ি থেকে নিরীহ মানুষ ধরে এনে চাঁদা দাবি করে যে বিপুল অর্থ অর্জন করেছে, সে অর্থের অংশ অবশ্যই তাদের ছত্রছায়া দেয়া কর্তৃপক্ষের অনেকেই ভাগে পয়েছেন! এখন প্রধানমন্ত্রী হয়তো বলবেন- ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়- তো কাকে দিয়ে কাজ করব? সাত্যিই তাই। তবে, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি কমাতে যখন সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন দ্বিগুণ করেন, তখন আমি লিখেছিলাম, এর ফলে দুর্নীতি কমবে না, বরং বেশি অর্থ লোভী হয়ে উঠবে মানুষ। কেন যেন মনে হচ্ছে, তাই হয়েছে। যা হোক, ঘোড়াঘাটের ভূমিগ্রাসীরা নিশ্চয়ই জনপ্রতিনিধি থাকবে না। তাহলে তারা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আসবে আশা করি এবং প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ইউএনও তার দুঢ়তা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে এবং হামলার শিকার হয়ে নিশ্চয় তার প্রাপ্য বিচার পাবেন। প্রকৃত অপরাধী দ- পাবে। শেষে আরও একবার রকিকে, তার পরিবারের জন্য, নিহত ভাই-এর জন্য, ভাই এর সন্তান-স্ত্রীর জন্য প্রাপ্য বিচার নিশ্চিত করার জন্য অভিনন্দন জানাই। তবে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তরুণটিকে সরকার যেন তার নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় সুরক্ষার প্রতি নজর দেয়- এটিই আমাদের কামনা। আমাদের গভীর শোকের অনেক হত্যার ঘটনা এখনও আমাদের অনিঃশেষ কষ্ট দিয়ে যায়। নিদারাবাদে নিখোঁজ স্বামীর স্ত্রী নিরজাবালা ও তার পাঁচ শিশু সন্তান-এর হত্যাকা-টি জীবনেও ভুলতে পারব না। ভুলতে পারব না পাবনার শিশু অর্নবকে পাখি দেবে বলে ডেকে নিয়ে পাষ- মুসলিম প্রতিবেশীর নির্যাতন করে হত্যা, ভুলব না মেধাবী কিশোর ত্বকী হত্যা, প্রকাশ্য দিবালোকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা সাত হত্যার ঘটনাও। এসব ঘটনার নেপথ্যে আছে প্রতিবেশীর দ্বারা সংখ্যালঘুর ভূমি গ্রাসের উন্মত্ত লোভ। সেই সঙ্গে আছে ধরাকে সরা জ্ঞান করা, কোন পরিবারের ব্যবসার ক্ষতি করতে যাওয়ার কারণে হত্যা, সর্বোপরি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিজেদের আইনের উর্ধে গণ্য করে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে রাতে হত্যা করার চরম বর্বর দৃষ্টান্ত প্রদর্শন- যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল, পেশাকে ক্ষমতা প্রদর্শনের উৎস শক্তি গণ্য করেছিল! তাদের কারও কারও বিচার হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু লক্ষণীয়- মানুষের প্রাণ, তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে মত্ত হয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রদীপ, লিয়াকতসহ অনেকেই এখনও ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, অপরাধী ধরতে গিয়ে গোলাগুলি ইত্যাদির নামে এক ধরনের ইমিউনিটি ভোগ করে চলেছে! হত্যাকারীর কোন ইমিউনিটি অন্তত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী দল ও সরকার দিতে পারে না। এটা তো জিয়া, খালেদা জিয়া, তারেকের জঙ্গীবাদী হত্যাকারীর আমল নয়! এটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক চেতনার সরকার- এটি যেন আমরা না ভুলি কখনোই। লেখক : শিক্ষাবিদ
×