ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাবিহা রহমান

মিউজিক থেরাপি

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ২৪ আগস্ট ২০২০

মিউজিক থেরাপি

করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নানা অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি আরও একটা হাতিয়ারকে সঙ্গী করতে পারেন। সুর শুনিয়ে কিছুটা বশ করা যায় নভেল করোনাভাইরাসের কারণে নিউ নর্মাল জীবনের মন খারাপ আর ছোটখাটো শারীরিক অস্বস্তি। দুষ্টু লোকেদের গান গেয়ে যেমন থামিয়ে দিত গুপি বাঘা, তেমনই সুরের জাদুতে পালানোর পথ খোঁজে মনের অসুখের কারণ। কেমব্রিজের এ্যাঞ্জিলা রাসকিন ইউনিভার্সিটির মিউজিক, হেলথ এ্যান্ড ব্রেনের গবেষক জর্জ ফ্যাকনার ও তাঁর সহযোগীরা হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের নানা সুর শুনিয়ে তাঁদের মস্তিষ্কের ইলেকট্রো এনসেফ্যালোগ্রাম বা ইইজি রিপোর্টে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখেছেন। এই গবেষণাপত্রে জানা গেছে যে, মস্তিষ্কের এক বিশেষ নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিনের নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় রোগীদের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট অনেকটাই কমে। মিউজিক থেরাপি গবেষণায় এটি এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলে দাবি প্রফেসর ফ্যাকনারের। মিউজিক থেরাপির বিশেষজ্ঞদের মতে সুরের জাদুতে বিভিন্ন অসুখ-বিসুখের বাড়বাড়ন্তকে আটকে দেয়া যায়। ভারতবর্ষ, মিসর, চিন, গ্রিস আর রোমে সভ্যতার শুরুতে সুরের সাহায্যে অসুখ সারানো হতো। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে বহু দিন তা ধামাচাপা পড়ে ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে চিকিৎসকরা আহত সৈন্যদের ব্যথা-যন্ত্রণা কমাতে মৃদু লয়ের গান-বাজনা ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য ফল পান। গান বাজনা দিয়ে চিকিৎসার সূত্রপাত তখন থেকেই। সৈন্যদের কষ্ট লাঘব হওয়ার সময় থেকেই একদল চিকিৎসাবিজ্ঞানী সমীক্ষা শুরু করে তা লিপিবদ্ধ করা শুরু করেন। দেখা যায়, শরীর ও মন দুইয়ের কষ্ট কমাতেই সুরের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। বস্টনের বার্কলে কলেজ অফ মিউজিকের অধ্যাপক সুজান হ্যানসার সুর-চিকিৎসার সাহায্যে শরীর ও মনের বেশ কিছু সমস্যা নিয়ন্ত্রণের কথা জানিয়েছেন। ? - নির্দিষ্ট কিছু সুর শোনালে রোগীর উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ কমে মন শান্ত হয়। - শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ স্বাভাবিক হতে শুরু করে। - রক্তচাপ কমে। - হৃৎপিন্ডে র অতিরিক্ত স্পন্দন কমতে শুরু করে। - পেশীর কাঠিন্য ও ব্যথার উপশম হয়। - মন-মেজাজের তিরিক্ষি ভাব চলে গিয়ে মন শান্ত হয়। - মাথার যন্ত্রণা, বুকে অস্বস্তি কমে। - ডোপামিন নিঃসরণ হয় বলে ভাল ঘুম হয়। - শারীরিক অস্বস্তি ও কষ্টের বোধ কমে যায়। - হজমের অসুবিধা ও পেটের সমস্যা চলে যায়। - রাগ চলে গিয়ে মন ভাল থাকে। - ডিপ্রেশন ও অকারণ মন খারাপের হাত থেকে রেহাই মেলে। তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, মিউজিক থেরাপি কিন্তু কোন ম্যাজিক ওষুধ নয়, ধীরে ধীরে কাজ করে। সুর চিকিৎসা খুব ভাল কাজ করে বাচ্চা ও বয়স্কদের ওপরে। কলকাতার অর্থোপেডিক সার্জন ও মিউজিক থেরাপির গবেষক সুমন্ত ঠাকুর জানালেন, দুর্ঘটনায় ভয়ঙ্করভাবে আহত রোগীর কানে হেডফোন লাগিয়ে মৃদুলয়ের সেতার, সরোদসহ হাল্কা বাজনা শুনিয়ে প্রাথমিকভাবে তাদের স্থিতিশীল অবস্থায় এনে তার পর সার্জারি করা হলে রোগীর কষ্ট অনেক কম থাকে। দ্রুত সেরেও ওঠেন। তবে ব্যথার ওষুধ যে একেবারেই লাগে না, তা নয়। যে কোন শারীরিক কষ্ট হলে মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে।? সুন্দর সুর শুনলে ডোপামিন নামে নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণ বেড়ে গিয়ে কষ্ট কমাতে সাহায্য করে। সুমন্ত বাবু আরও জানালেন, মিউজিক থেরাপির সাহায্যে রোগীর নাড়ির গতি (পালস রেট), হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ও শ্বাস-প্রশ্বাসের হার অনেকটাই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে। তবে এটাও ঠিক যে, মিউজিক থেরাপি কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ চিকিৎসা নয়, সহায়ক চিকিৎসা মাত্র। কোভিড-১৯ সংক্রমণে যাঁদের সপ্তাহ দুয়েক হাসপাতালে বা আইসোলেশনে থাকতে হয় তাদের জন্য এটি কার্যকর হবে বলে মনে করেন চিকিৎসক সুমন্ত ঠাকুর। ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি অর্থোপেডিক রোগীদের সার্জারির আগে ও পরে গান শুনিয়ে ব্যথা কমাচ্ছেন। তাই এই থেরাপি আইসোলেশনে বা করোনা নিভৃতবাসে কার্যকর হবে বলে মনে করেন তিনি। ঠাকুরস মিউজিক এ্যান্ড মুভমেন্ট থেরাপি রিসার্চ সেন্টারের পক্ষে ইন্দ্রনীল ম ল জানালেন, ফিমেল ওয়ার্ডে তাঁর গান শুনে অক্সিজেনের মাস্ক খুলে গলা মিলিয়েছেন সিওপিডি আক্রান্ত এক প্রৌঢ়া। আপার লিম্ব সার্জারির সময় জেনারেল এ্যানাস্থেশিয়ার বদলে লোকাল লক করেই অস্ত্রোপচার করেন সুমন্ত বাবু। তিনি কোভিডের নিভৃতবাসে গান শুনে মন ভাল রাখার পরামর্শ দিলেন। গান মনোসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। পড়াশোনায় অমনোযোগী বাচ্চাদের ওপর রীতিমতো সমীক্ষা করে দেখা গেছে, যারা অত্যন্ত চঞ্চল তাদের সুন্দর গান বা বাজনা শোনালে টানা ছয়-সাত মিনিট পর্যন্ত নিবিষ্ট মনে শোনে। সমীক্ষায় প্রমাণিত, ছোট্ট বয়স থেকে যারা গান-বাজনা শোনে তাদের একাগ্রতা তুলনামূলক ভাবে বেশি। এমনকি যে সব বাচ্চা জন্মের সময় থেকেই গান শোনে, তারা অন্যদের থেকে অনেক আগে কথা বলতে শেখে। মস্তিষ্কের কথা বলার অংশকে উজ্জীবিত করে সুর। গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রোক আক্রান্ত বয়স্ক মানুষদের কথা বলার ক্ষমতা চলে গেলে (এ্যাফাসিয়া) ভাল গান শোনালে তাঁরা সহজে কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পান। শরীর-মন দুই-ই ভাল রাখতে সাহায্য করে সুন্দর সুর, জানিয়েছেন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি অব মন্ট্রিলের মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল জে লেভিটিন, নিউরো সায়েন্স অব মিউজিকের ওপর ৪০০টি স্টাডি করে তিনি এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। গুরুতর অসুস্থ কিছু রোগীকে নিয়ম করে গান-বাজনা শুনিয়ে দেখা গেছে যে, কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক ইমিউনোগ্লোবিউলিনের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এই ন্যাচারাল কিলার সেল আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। কোভিড-১৯ থেকে শুরু করে ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার জীবাণুদের বিরুদ্ধেও লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকে আমাদের শরীর। এ ছাড়া স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে মনের চাপ কমায়। সুতরাং করোনা অসুরকে জব্দ করতে সঙ্গী করুন সুরকে।
×