ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির এক দশক

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ১৭ আগস্ট ২০২০

বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির এক দশক

(গতকালের পর) ’৯৬-এর মার্চে আর এন কাওকে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল- ‘১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু আগরতলায় গিয়েছিলেন কিনা?’ উনি চমকে উঠে বললেন- ‘এ তথ্য আপনাকে কে দিয়েছে?’ তখন আমি আবদুর রাজ্জাকের কথা বললাম, কাজী আরেফ আহমেদের কথা বললাম, চিত্তরঞ্জন সুতারসহ আরও কয়েকজনের কথা বললাম। উনি কতক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন- ‘আমি এ প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ বলব না, না-ও বলব না।’ সাংবাদিক হিসেবে আমার বুঝে নিতে অসুবিধা হলো না- এর অর্থ বঙ্গবন্ধু আগরতলা গিয়েছিলেন, কিন্তু এ নিয়ে তিনি নিজে কিছু বলবেন না। আমি বললাম- ‘ঠিক আছে, আমি বুঝতে পারছি তিনি গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা অন্তত বলুন, তাঁর এ মিশন ব্যর্থ হলো কেন? তাঁর তো দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। নেহরুর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা ছিল।’ তখন আর এন কাও আমাকে বলেছেন তিনটা বিষয় সম্পর্কে। প্রথম হচ্ছে- ইন্টেলিজেন্স/গোয়েন্দা সংস্থা সাধারণত দ্বিতীয়/তৃতীয় সারির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কখনোই হাই প্রোফাইল লিডারদের সঙ্গে কথা বলে না। করলে জানাজানি হয়ে যাবে। আগে বঙ্গবন্ধু দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তারাও জানতে পেরেছেন। কিন্তু পরে তারা চিন্তা করে দেখলেন যে ’৬২ সালে বঙ্গবন্ধু সারা পাকিস্তানে একজন পরিচিত নেতা। তিনি যদি দিল্লিতে গোপন মিশনে আসেন পাকিস্তানের কাছে বিষয়টা গোপন থাকবে না। পাকিস্তান জেনে যাবে- এই কারণে তারা বঙ্গবন্ধুর গোপন দিল্লী সফরটা উৎসাহিত করেননি। দ্বিতীয় কারণ যেটি বললেন- তখন ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত নিয়ে একটা বিরোধ চলছিল যা পরবর্তী সময়ে (এপ্রিল, ১৯৬২) চীন-ভারত যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল। উনি বললেন- চীনের সাথে তখন আমরা যুদ্ধের মতো একটা অবস্থায়। সেখানে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে শত্রুতা তৈরি করতে চাইনি শেখ মুজিবকে দিল্লীতে আমন্ত্রণ জানিয়ে। তৃতীয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। কাও বলেছেন, সেই সময়ে, অর্থাৎ ’৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। এই তিনটে কারণে দিল্লী বঙ্গবন্ধুর ওই সফরকে নিরুৎসাহিত করেছে। ফলে বঙ্গবন্ধুর আগরতলা মিশন ব্যর্থ হয়েছিল। এরপরে আমি ঢাকায় ভারতীয় উপদূতাবাসের অশোক রায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। বঙ্গবন্ধু কয়েকবার তাঁকে বলেছেন- ‘আপনি দিল্লীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে শুধু এই বার্তাটি এনে দিন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন করার যুদ্ধে দিল্লী আমাকে সহযোগিতা করবে কিনা। আমি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছি, আমার গেরিলা প্রশিক্ষণের দরকার আছে, অস্ত্র সাহায্যের দরকার আছে- দিল্লীর সরকার সেটা করবে কিনা আমার জানা দরকার।’ অশোক রায় আমাকে বলেছেন- ‘আমি কয়েকবার দিল্লীতে খবর পাঠিয়েছি, দিল্লী আমাকে কোনও উত্তর দেয়নি।’ সর্বশেষ যা বললেন- ’৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ তার দেখা হয়ে গেল ৪ জুলাই ঢাকায় আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে। অশোক রায় বলেছেন- ‘শেখ সাহেবকে দেখে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। জানি যে দেখা হলে তিনি বলবেন দিল্লির কোন খবর পেয়েছি কিনা। আমি তো দিল্লির কোনো খবর পাইনি। আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, কিন্তু তিনি ঠিকই আমাকে ধরে ফেললেন এবং বললেন, ‘আপনাকে শেষ বারের মতো আমি বলছি- আপনি দিল্লির হ্যাঁ বা না জবাবটি আমার জন্যে আনুন। ভারত যদি আমাদের সহযোগিতা না করে আমি তৃতীয় কোন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করব।’ এই বার্তা পাঠানোর পরে অশোক রায়কে দিল্লীতে ডেকে পাঠানো হলো। সেটা ছিল সেপ্টেম্বর মাস। তিনি বললেন- ‘আমি যাওয়ার পরপরই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধের ১৭ দিন আমি দিল্লীতে ছিলাম, ঢাকায় ছিলাম না। ফরেন মিনিস্ট্রি থেকে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে কথা বলে আমাকে বলে দেওয়া হলো- শেখ সাহেবকে বলবেন, এরপর তিনি যেন দূতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ না করেন। প্রয়োজনমতো আমরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করব। তিনি যেন স্বাধীনতার জন্য তাঁর জনগণকে প্রস্তুত করেন। সময় মতো দিল্লী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এই ব্যাপারে আমরা এখন কোন আলোচনা করব না।’ তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। তিনি ফিরে এসে সেটা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছেন। দূতাবাসের বিষয়টা এইখানে চাপা পড়ে গিয়েছিল। ’৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ময়মনসিংহ জেলে তখন তাঁর সহবন্দী ছিলেন চিত্তরঞ্জন সুতার ও অজয় রায়। এটি কমিউনিস্ট নেতা অজয় রায় বলেছেন এবং আরও কয়েকজনের কাছ থেকে আমি সত্যতা যাচাই করেছি। বঙ্গবন্ধু চিত্তরঞ্জন সুতারকে বলেছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যাকে বিশ্বাস করবেন এমন একজনের মাধ্যমে তাকে আমি সরাসরি বার্তা পাঠাতে চাই। ময়মনসিংহের ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী মহারাজ ছিলেন খ্যাতিমান ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি তখন চিকিৎসার জন্য ভারতে যাবেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন- ‘আপনি ভারতে যাচ্ছেন। আপনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এ বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবেন। আমি একটা সবুজ সংকেত পেতে চাই। হ্যাঁ বা না জানতে চাই। যদি তাঁরা সহযোগিতা করেন তবে যেন একটা মেসেজ আমাকে পাঠান।’ মহারাজ ’৬৬ সালে কলকাতা গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাননি। পরে ’৭০ সালে আবার যখন চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গেলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যা আলোচনা হয়েছিল তা বিপ্লবী পান্নালাল দাশগুপ্তকে জানিয়ে বললেন, মুজিব তো এরকম একটা বার্তা দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীকে এটা কিভাবে জানাব তা আমি জানি না। পান্নালাল দাশগুপ্ত তাকে বললেন- ‘আমি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আপনাকে পৌঁছাতে পারব না, কিন্তু তাকে যিনি খুব ভালভাবে চেনেন, যার কথায় ইন্দিরা গান্ধী আপনার সঙ্গে দেখা করবেন তার কাছে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। তিনি হচ্ছেন জয়প্রকাশ নারায়ণ।’ এরপর পান্নালাল দাশগুপ্তকে নিয়ে মহারাজ দিল্লী গিয়ে সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে দেখা করলেন। জয়প্রকাশ নারায়ণ বঙ্গবন্ধুর বার্তার গুরুত্ব বুঝে কালবিলম্ব না করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বললেন- স্বাধীনতা সংগ্রামী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী মহারাজ দিল্লীতে এসেছেন শেখ মুজিবের বার্তা নিয়ে। আরও বললেন, মুজিব একটা সবুজ সংকেত চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সবুজ সংকেত কিভাবে পেলেন? বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ মহারাজকে ’৭০-এর আগস্টে ভারতের লোকসভায় একটা রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে তিনি সেটা পেতেই পারেন। এই সংবর্ধনার দু’দিন পর ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী দিল্লীতে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা পৌঁছে গেল ভারত তাঁর দূতকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। এ বিষয়ে আজও অবাধ কোন লেখা চোখে পড়েনি। এর আগে আগরতলা পর্ব, যা গোটা পরিস্থিতি অনেক বদলে দিয়েছিল, এ নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। আপাতত আমি সেই পর্বে যাচ্ছি না। যেগুলো লেখা হয়নি, যে বিষয়গুলো নিয়ে মতপার্থক্য আছে- সেরকম কয়েকটি ঘটনা শুধু বলছি। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কারণে বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা মামলা থেকে বেরিয়ে এলেন তখন তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল যে কোন ভাবেই হোক তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তিনি দেখলেন সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে লন্ডনে গিয়ে কথা বলা। ১৯৬৯-এর অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু এ্যাপেন্ডিসাইটিসের অপারেশনের জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন। কিছু খবরের কাগজে তখন এটা নিয়ে মশকরা করা হয়েছিল। মুসলিম লীগওয়ালারা বলেছে- এ্যাপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন এমন কী জটিল যেটার জন্য লন্ডন যেতে হবে? কিন্তু বঙ্গবন্ধু লন্ডন গিয়েছিলেন মিসেস গান্ধীর বিশেষ দূতের সঙ্গে কথা বলার জন্য। সেই দূত হচ্ছেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, যিনি ‘নাথ বাবু’ হিসেবে বেশি পরিচিত। নাথ বাবু বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, মিসেস গান্ধী তাঁকে জানিয়েছেন, এই বিষয়ে আলোচনা করবার জন্য বঙ্গবন্ধু যেন তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ একজন ব্যক্তিকে, পলিটিকালি খুব পরিচিত নয় এমন একজনকে দিল্লী পাঠান, যিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। এই প্রসঙ্গটা আমি ’৯৭ সালে জনকণ্ঠে লিখেছিলাম এবং এটা পরে আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাও আমাকে নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি ১৯৯৮-এর জুনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মেলার মঞ্চে আমাকে জনকণ্ঠে প্রকাশিত আমার লেখার উল্লেখ করে বলেছিলেন- আপনি বোধহয় জানেন না হাসপাতালে ওই বৈঠকে আমিও উপস্থিত ছিলাম। আমি বললাম- ‘নেত্রী, আপনি তো বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সেখানে ছিলেন। তখন আপনার রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। আপনি যখন বলছেন- ঠিক আছে আমার লেখায় আপনার কথা অবশ্যই উল্লেখ করব। তার মানে এটা তো প্রমাণ হচ্ছে আমি যা লিখেছি তা মিথ্যা নয়। পরে শশাঙ্ক ব্যানার্জীও এটা বলেছেন। শুধু শশাঙ্ক ব্যানার্জী নন, স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর কন্যাও জানেন তাদের মধ্যে কি আলোচনা হয়েছিল। এরপর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে চিত্ত সুতারকে অনুরোধ করলেন, যার সঙ্গে ৫০-এর দশকে কারাগারে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। চিত্তরঞ্জন সুতার কিন্তু ’৭০ সালে আওয়ামী লীগ করতেন না। প্রথমে করেছেন কমিউনিস্ট পার্টি। ’৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি হয়ে যাওয়ার পর অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের সঙ্গে চিত্ত বাবু ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ৫০-এর দশক থেকেই ছিল। সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে ১৯৬১ সালে। কাজী আরেফ আহমেদ ও চিত্তরঞ্জন সুতার আমাকে বলেছেন, ’৬২-সালে নিউক্লিয়াস’ বা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠনের প্রায় এক বছর আগে বঙ্গবন্ধু চিত্তরঞ্জন সুতার ও রুহুল কুদ্দুসকে (আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত) নিয়ে ‘পূর্ব বাংলা মুক্তিফ্রন্ট’ নামে একটি গোপন সংগঠন গঠন করেছিলেন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে তখন ‘পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার আহ্বান’ জানিয়ে একটি ইশতেহার কাজী আরেফ আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিলি করেছিলেন। ’৬১ সালের নবেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু যে কমিউনিস্ট নেতা মণি সিং ও খোকা রায়ের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন এ বিষয়ে তাঁরা দুজন ছাড়াও অজয় রায় বিস্তারিত বলেছেন। বঙ্গবন্ধু চিত্তরঞ্জন সুতারের সঙ্গে তখন থেকে এ বিষয়ে তাঁর পরিকল্পনা শেয়ার করতেন। তো এখন বলতে অসুবিধা নেই, তিনি মারা গেছেন, আমাকে বলেছিলেন যে তাঁর জীবদ্দশায় আমি যেন এগুলো প্রকাশ না করি। লন্ডন থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু চিত্ত সুতারকে বলেছিলেন- ‘নাথ বাবুর সঙ্গে এই কথা হয়েছে, আপনাকে দিল্লী যেতে হবে।’ ১৯৭০-এর এপ্রিল মাসে চিত্তবাবু বঙ্গবন্ধুর বার্তা নিয়ে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে দেখা করলেন। তারপর তিনি সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে বার্তা পাঠালেন। আমি বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। এটুকু জানাচ্ছি যে, তিনি বার্তা পাঠিয়েছেন- ‘মিসেস গান্ধী গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছেন।’ চিত্তবাবু ভারতে গিয়েছিলেন ইলেকশনের ৮ মাস আগে। তখন বঙ্গবন্ধু তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন- ‘আপনি তিনটে বাড়ি ভাড়া করুন। কলকাতায় একটা, বনগাঁ-বারাসাতের দিকে বর্ডারে একটা, ত্রিপুরায় একটা। আমাদের ছেলেরা গিয়ে গেরিলা ট্রেনিং নেবে, সেখানে গিয়ে তো থাকতে হবে।’ চিত্তবাবু আরও বললেন- তখন তার কাছে অত টাকা ছিল না। তিনি কলকাতায় ২১ রাজেন্দ্র রোডে একটা তিন তলা বাড়ি ভাড়া করেছিলেন। ঢাকার ফরাসগঞ্জের একটা মন্দির থেকে তার স্ত্রীর মাধ্যমে কিভাবে যোগাযোগ হবে সেটাও তিনি জানিয়েছিলেন। এরপর বঙ্গবন্ধু তাকে স্থায়ীভাবে কলকাতা থাকতে বলেন। ’৭০-এর নির্বাচনের আগেই বঙ্গবন্ধু এবং অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক জানতেন- তিনি যত ভোটই পান না কেন, পাকিস্তানীরা কখনও বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এটা পাকিস্তানীদের বিবরণীতেও পাওয়া যাবে। তাদের আমলারা লিখেছেন, রাজনীতিবিদরা লিখেছেন। এটা অবধারিত ছিল। সেই কারণেই বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছেন, ছয় দফার আন্দোলন থেকে ’৭০-এর যে নির্বাচন- তার জন্য সারাদেশ যেমন ছুটে বেড়িয়েছেন, বাঙালীকে এটা বোঝানোর জন্য যে, পাকিস্তানীরা বাঙালীদের কিভাবে বঞ্চিত করেছে, কিভাবে শোষণ-পীড়ন করছে- নির্বাচনে না গেলে সেই সুযোগ হতো না। বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য আইনি সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম- প্রকাশ্য সংগ্রামগুলোর পাশাপাশি সম্পূর্ণ গোপনে ভারতের সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু ’৭০-এর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার এক দশক আগে গ্রহণ করেছিলেন। যে কারণে ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পরে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমেদ সীমান্ত অতিক্রম করবার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে স্বাগত জানানো হয়। তাদেরকে দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয় এবং দশ দিনের মধ্যে সরকারের ঘোষণাও হয়ে গেল। যদিও আকাশবাণী ও আনন্দবাজারে ৫ এপ্রিলেই সেটা লিক করা হয়েছিল। সেটা আরেক বৃত্তান্ত। কিন্তু ১০ এপ্রিল তো আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের ঘোষণা হয়ে গেল এবং ১৭ তারিখে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণও হলো। এরপর মাত্র নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনও হয়ে গেল? চলবে...
×