ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় আঁশবিহীন, একেক স্তরে ভিন্ন স্বাদ

প্রকাশিত: ২১:৫৯, ১১ জুলাই ২০২০

স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় আঁশবিহীন, একেক স্তরে ভিন্ন স্বাদ

আব্দুর রউফ সরকার ॥ মৌসুমি ফলের ম ম গন্ধে সারা দেশ এখন সুবাসিত। ফলের রাজা আম থেকে শুরু করে জাতীয় ফল কাঁঠাল- কী নেই এখন খোলা বাজারে? আসলে এই সময়টাই ফলের। তাই সব ধরনের মৌসুমি ফলে এখন গোটা দেশ সয়লাব। আর বাজার তো বাজারই- রাস্তা, ফুটপাথ থেকে শুরু করে যেখানে সেখানে ফল নিয়ে বসেছে বিক্রেতারা। আম-জাম-কাঁঠাল ছাড়াও তাল, লটকন, বেল ও কদবেলসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফলের পসরা নিয়ে ভ্যানে বয়ে চলেছে বিক্রেতারা। এই চিত্র বিশেষ কোন অঞ্চলের নয়, সারাদেশের। ইদানীং ঘরের বাইরে গেলে যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই দেখা মেলে নানা ধরনের মৌসুমি ফলের। ফলের মধ্যে সবচেয়ে মজাদার ও সুমিষ্ট ফল আম। তাই একে বলা হয় ‘ফলের রাজা’। এই আমের হরেক রকমের আঞ্চলিক নাম রয়েছে- যেমন ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, আম্রপালি, খিরসাপাতি ও হাঁড়িভাঙ্গা ইত্যাদি। দেশের অন্যান্য জেলার মতো রংপুরেও এখন ফলের রাজা আমের ভরা মৌসুম। ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ আমের কথাই ধরা যাক। রংপুর মহানগরীর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, রাস্তার মোড় এবং হাট-বাজারে এখন আম বেচাকেনার ধুম। শুধু শহরে-নগরেই নয়, রংপুর জেলার গ্রামগঞ্জের হাট-বাজার থেকে শুরু করে প্রতিটি অলিগলি ও সড়কের মোড়ে মোড়ে হাঁড়িভাঙ্গা আমে সয়লাব হয়ে আছে। কেউ সাইকেলে, কেউবা রিক্সাভ্যানে ফেরি করে আম বিক্রি করছে। কেউ আবার বিশাল বিশাল পাইকারি দোকান খুলে বসেছে। বিভিন্ন অঞ্চলে আম পাঠানোর জন্য হাটের পাশেই কুরিয়ার সার্ভিসগুলো অস্থায়ী কাউন্টার খুলে বসেছে। সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে প্যাকেজিং এবং ট্রাক ভর্তি করার কাজ। প্রতিদিন শয়ে শয়ে মণ হাঁড়িভাঙ্গা আম তারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছেন। হাঁড়িভাঙ্গার ব্যাপক চাহিদার কারণে শিক্ষিত বেকার, স্কুল-কলেজের ছাত্ররাও এখন আমের ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। অনলাইনে হাঁড়িভাঙ্গা আম বিক্রি করে তরুণ-যুবকেরা করোনাকালের এই অবরুদ্ধ সময়ে ভাল পয়সা উপার্জন করছেন। এবার হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ, বিক্রি ও বিপণনে প্রায় দশ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় বাংলাদেশের একমাত্র আঁশবিহীন ফল হাঁড়িভাঙ্গা আম। আমের উপরিভাগ বেশ মোটা ও চওড়া, নিচের অংশ চিকন। দেখতে সুঠাম ও মাংসালো, শাঁস গোলাকার ও একটু লম্বা। শাঁস অনেক ছোট, আঁশ নেই। আকারের তুলনায় ওজনে বেশি, গড়ে ৩টি আমে ১ কেজি হয়। কোন ক্ষেত্রে একটি আম ৫০০/৭০০ গ্রাম হয়ে থাকে। চামড়া কুচকে যায়, তবুও পচে না । ছোট থেকে পাকা পর্যন্ত একেক স্তরে একেক স্বাদ পাওয়া যায়। দৃষ্টি নন্দন রং ও আকার এবং নির্ভেজাল মিষ্টি স্বাদের জন্য রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তাই লোকজন এখন বলছেন, ফলের রাজা আম; আর আমের রাজা হাঁড়িভাঙ্গা। স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় জাতের এ আমটির ‘ইতিহাসের’ গোড়াপত্তন করেছিলেন মিঠাপুকুরের খোড়াগাছ নিবাসী নফল উদ্দিন পাইকার নামের এক বৃক্ষবিলাসী মানুষ। শুরুতে এর নাম ছিল মালদিয়া। আমগাছটির নিচে মাটির হাঁড়ি দিয়ে ফিল্টার বানিয়ে পানি দেয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা ওই মাটির হাঁড়িটি ভেঙ্গে ফেলে। ওই গাছে বিপুল পরিমাণ আম ধরে। সেগুলো ছিল খুবই সুস্বাদু। সেগুলো বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন ওই আম সম্পর্কে জানতে চায়। তখন চাষী নফল উদ্দিন মানুষকে বলেন যে, ‘যে গাছের নিচের হাঁড়িটা মানুষ ভাংছিল সেই গাছেরই আম এগুলা।’ তখন থেকেই ওই গাছটির আম ‘হাঁড়িভাঙ্গা আম’ নামে পরিচিতি পায়। বর্তমানে রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আমের মাতৃ গাছটির বয়স ৬৩ বছর। পরবর্তীতে মিঠাপুকুর উপজেলার সর্দারপাড়ার আব্দুস সালাম সরকার বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ শুরু করেন। এতে লাভবান হলে পরের বছরে আরও বেশি জমিতে এই জাতের আমের চাষ করেন তিনি। তার দেখাদেখি প্রতিবেশীরাও হাঁড়িভাঙ্গা আম চাষ শুরু করেন। লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই চাষী এবং চাষের জমি বাড়তে বাড়তে বর্তমানে তা উপজেলার গ-ি পেরিয়ে জেলার সর্বত্র সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে আব্দুস সালাম হাঁড়িভাঙ্গা আমের সম্প্রসারক হিসেবে পরিচিত। জেলার সবচেয়ে বড় আমের বাজার পদাগঞ্জহাটে সকাল ৭টা থেকে মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার চাষিরা হাঁড়িভাঙ্গা আম নিয়ে আসেন। মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জের হাট ছাড়াও রংপুর মহানগরীর কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল, মসজিদ রোড, সাতমাথা, লালবাগ, সিটি বাজার, সিওবাজার, ধাপ ও চেকপোস্টসহ বিভিন্ন এলাকায় আমের পাইকারি বাজার বসেছে। সেখানে পাইকাররা আমের ধরন ও সাইজ দেখে চাষীদের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছেন। খোঁড়াগাছ পদাগঞ্জের আমচাষী রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার কারণে সরাসরি আম কিনছেন এমন ক্রেতার সংখ্যা কম। অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা ক্রেতাদের হাতে আম তুলে দিচ্ছি। এভাবে আমরা আমের অনেক অর্ডার পাচ্ছি। নিজস্ব কুরিয়ারের মাধ্যমে ফরমালিনমুক্ত আম পাঠাচ্ছি। এছাড়াও হোম ডেলিভারিও দিচ্ছি।’ গত কয়েক বছর থেকে এ আমের চাহিদা যেমন বেড়েছে তেমনি ভাল দামও পাচ্ছেন চাষীরা। জুন মাসের ১০ তারিখ থেকে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে হাঁড়িভাঙ্গা আম। জুনের ২য় সপ্তাহের শুরুতে বাগানে ১৮শ’ থেকে ২ হাজার টাকা মণ দরে আম বিক্রি হলেও বর্তমানে শহরের বাজারে বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা মণ দরে। তবে, খুচরা কিনতে গেলে কেজি প্রতি হাঁড়িভাঙ্গা আম ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা গুনতে হচ্ছে। আর রংপুর থেকে ঢাকায় আম পাঠালে কেজি প্রতি কুরিয়ার সার্ভিসের পরিবহন সেবায় খরচ পড়ছে ১২ টাকা, ঢাকার বাইরে হলে তা ১৫ টাকা। জুলাইয়ের ২য় সপ্তাহের পর থেকে আমের দাম বেড়ে যেতে পারে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় চার হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ হয়েছে। উৎপাদন ধরা হয়েছে ৬০ হাজার মেট্রিক টন। হাঁড়িভাঙ্গা আমের কারণে রংপুরকে এখন আমের রাজ্য বলা হচ্ছে। পীরগঞ্জ, মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ, রংপুর সদর উপজেলার সড়ক, মহাসড়ক ও গ্রামের মেঠোপথে সারি সারি হাঁড়িভাঙ্গা আমের গাছ। মিঠাপুকুর উপজেলাতেই ছোট-বড় মিলে হাঁড়িভাঙ্গা আমের প্রায় পাঁচ হাজার বাগান রয়েছে। মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, এ বছর এ উপজেলায় ১১শ’ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ হয়েছে। গত বছর চাষ হয়েছিল ১০৫০ হেক্টর জমিতে। বদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জোবায়দুর রহমান বলেন, তার উপজেলায় ৪৭০ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ হয়েছে। উঁচু-নিচু ও পরিত্যক্ত জমিতে এ জাতের আম চাষ করে অনেকেই ঘুরিয়েছেন ভাগ্যের চাকা। খিয়ার (লালমাটি) মাটি হওয়ায় এ অঞ্চলে ধান, পাট বা প্রচলিত অন্য কোন ফসল খুব একটা ভাল হয় না। কিন্তু, আমের ফলন খুব ভাল হয়। তাই, প্রতিবছরই বাড়ছে আমের চাষ। চাষীরা আগ্রহ নিয়ে আম চাষে এগিয়ে আসছেন। আম চাষ লাভজনক হওয়ায় শিক্ষিত বেকার যুবকরাও ঝুঁকে পড়েছেন আম চাষে। অনুকূল আবহাওয়া আর ঘূর্ণিঝরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় এ বছর হাঁড়িভাঙ্গা আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। গাছভর্তি থোকা থোকা আমের ভারে ন্যুইয়ে পড়ছে প্রতিটি গাছের শাখা প্রশাখা। গত বছরের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ ফলন বেশি হয়েছে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তারা। দর ভাল হওয়ায় আম চাষেই স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন আম চাষীরা। দাম ক্রেতাদের হাতের নাগালে থাকায় বিক্রি ভাল হচ্ছে বলেও আম বিক্রেতারা জানান। আম চাষীদের আশা, রংপুর জেলায় এবার ২০০ কোটি টাকার আম বিক্রি হবে। হাঁড়িভাঙ্গা আমের সম্প্রসারক আব্দুস সালাম সরকার বলেন, তিনি ১২ একর জমিতে আম চাষ করেছেন। এ পর্যন্ত বিক্রি করেছেন ২০ লাখ টাকার আম। তিনি জানান, রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম গত বছর বিদেশেও রফতানি করা হয়েছে। কিন্তু, করোনার কারণে এ বছর বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি ভাল হলে আগামীতে এ আম বিদেশের আমের আমের বাজারে নেতৃত্ব দিবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তবে মৌসুমের শুরুতে আমের দাম কিছুটা কম থাকলেও আম সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় মৌসুমের শেষের দিকে দাম বেড়ে যায় । গাছ থেকে পাড়ার পর দীর্ঘসময় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে হাঁড়িভাঙ্গা আম হতে পারে রংপুরের প্রধান অর্থকরী ফসল। তাই আম সংরক্ষণে এ অঞ্চলে একটি হিমাগার, প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও গবেষণাগার নির্মাণের দাবি কৃষকদের। মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জ গ্রামের আমচাষী আশরাফুল আলম বলেন, আমি দুই একর জমিতে আম লাগিয়েছি। গতবারের চেয়ে এবারে ফলন অনেক ভাল হয়েছে। আমার অর্ধেক বাগান ঢাকার এক পাইকারের কাছে আগাম বিক্রি করেছি। ভাল দাম পেয়েছি। এ বিষয়ে রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, আম পরিবহন, বিপণন এবং বাজারজাতকরণের কোন সমস্যাই হয়নি। কারণ, কৃষি ও খাদ্যপণ্য পরিবহন, বিপণন এবং বাজারজাতকরণ লকডাউনের আওতামুক্ত। তাছাড়া, ধীরে ধীরে লকডাউন প্রত্যাহার করা হচ্ছে। আম চাষীরা যাতে ন্যায্যমূল্যে আম বিক্রি করতে পারে সে বিষয়ে প্রশাসন সব রকম সহযোগিতা করছে। জেলায় জেলায় আম বিপণন ঠিক রাখতে সরকারী নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চাষীরা কতটুকু উপকৃত হয় সেটি মুখ্য বিষয়।
×