ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাহবুব আলী

গল্প ॥ চাল চোর

প্রকাশিত: ০০:৪৯, ১০ জুলাই ২০২০

গল্প ॥ চাল চোর

ভোর সকালে দক্ষিণ ঘরের একপাল্লা দরজা ঠেলেই চোখ-মুখ কুঞ্চিত করে সুলতান। ছেলে এত সকালে গেল কোথায়? এখন তো সব বন্ধ। খন্দকারের লেদ কারখানাও। আজও কি তবে রিলিফের জন্য গেছে? সে সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘মিরনের মা, ব্যাটা কি রিলিপ আইনবার গেইচে? ঘরোত্ নাই।’ জামিলা তখন উনুন ধরায়। হাতের ডানদিকে একগাদা কার্টন ছেঁড়া কাগজ। বাঁশের কতগুলো টুকরো। এসব দিয়েই কখনও রান্নার কাজ চলে। সে চারপাশে ধোঁয়ার মধ্য থেকে পিটপিট তাকায়। বাঁশের টুকরোগুলো ভেজা। এখনও জ্বালাতে পারেনি। একপাশে গামলায় আটা আর রুটি তৈরির পিঁড়া-বেলনা। উৎসুক দৃষ্টিতে কোন কথা নেই। সুলতানের কথা কানে গেছে কি না বোঝা যায় না। আজকাল অবশ্য মুখে খই ফোটে না তার। তাই হয়ত মুখ নামিয়ে কাজে মন দেয়। ফু-ফু করে ফুক মারে উনুনে। সুলতান ধরে নেয়, মিরন রিলিফ আনতে গেছে। তার বিমর্ষ মন। সংসারে কোনকিছু দিতে পারে না বলে গুরুত্ব বোধকরি কমে গেছে। সে না থাক। মিরন গেল কোথায়? এদিকে ক্ষুধা পুনরায় খুব জোর মাথা চাড়া দিতে শুরু করে। কী খাবে? খাওয়ার কিছু নেই। মাস কয়েক আগে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে কোমরব্যথা। খবরের কাগজ নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাওয়া হয় না। আজ যেন অবসরপ্রাপ্ত হকার। সেদিন রুবেল মিয়া খোঁজ নিতে এসে বলে, Ñ ‘মিয়া সংবাদপত্র তো বন্ধ হয়নি। তুমি ঘরে বইসা আছো? পেপার দিব কেডায়?’ ‘কী করুম? চার্জার রিক্সাওয়ালা এমন ধাক্কা দিছে, পইড়া গেলাম। এ্যালায়ও কোমর ঠিক হয় নাই।’ ‘ও আইচ্ছা, ঠিক হইলে কামে আইস। তবে সাবধানে থাইকো মিয়া। করোনা আইছে। খুব খারাপ ব্যামো। ওষুধ নাই। চিকিৎসা নাই। দেশে দেশে হাজার হাজার মানুষ সাবাড় হইতাছে।’ ‘এইটা ফির কী অসুখ?’ ‘ভাইরাস... ভাইরাস।’ সেই থেকে আজ প্রায় একুশ-বাইশ দিন চলে যায়। খাওয়া-না-খাওয়া দিনরাত। পেটে দানাপানি তেমন নেই। জামিলা দুই বেলা রুটি তৈরি করে। সকাল আর রাত। দুপুরে উপোষ। বুড়ো শরীর কিছুতেই মানে না। গতকাল দুপুরের আগে আগে কয়েকটি শিঙ্গাড়া হাতে করে আনে মিরন। রিলিফ আনতে গিয়েছিল। সুলতান তখন থেকেই স্বপ্ন দেখে, দুই দিন ভাত খায় না; আজ ভাত খাবে। জামিলার হাতে মসুর ডালভর্তা বেশ স্বাদের হয়। উনুনের পাশে দেয়ালে ঝোলানো তাকে কাঁচামরিচ দেখেছে। একটু ঝাল বেশি দিলেই হয়। সেই স্বপ্ন শিঙ্গাড়া মুখে দিতে দিতে দপ করে নিভে গেল। মিরন রিলিফ পায়নি। আশপাশের মানুষজন একটি-দুটি করে লাল-সাদা ডোরাকাটা দাগের ব্যাগ পেল। পাঁচ কিলো চাল। সেই চালও বেশ ভাল। ব্যাগে আরও আছে মসুর-তেল-মরিচ-পেঁয়াজ-লবণ আর কী কী? কেউ কেউ টাকাও পেয়েছে শোনা যায়। মিরন খালি হাতে এসে বলে, Ñ ‘রিলিপ পাওয়া যায়নি বা। আগত্ কার্ড নেয়া নাগবে। মোর কার্ড নাই। তাই লাইন থাকি ঘুরি আয়নো।’ ‘কাড ফির কাঁয় দিবি?’ ‘চেয়ারম্যান-মেম্বারের ঠে নিবা হবি নাকি। কিছু খায়া ও-বেলাত যাইম এ্যালা।’ ‘সাঁঝের আগোত ফির আসিবা হবি বা।’ ‘হয় হয়।... রিলিপ দিবি না চুরি করিবি? সরকার চাল দেছে, আর ওমরাহ ঘরোত তুলি রাখোচে।’ ‘কাঁয় কী করে বা তোক দেখা নাগিবি না। কুনো কাথা কবু না।’ ‘হয়।’ জামিলা মানুষের বাড়ি কাজ করে। সেই কাজ বন্ধ। ভাইরাস শেষ হলে যেতে বলেছে। তার আগে নয়। সেই বাড়ি থেকে পাওয়া কয়েক কেজি আটা রুটি বানিয়ে খাওয়া চলে। মিরন তার সকালের ভাগের দু-খানা রুটি খেয়ে বের হয়। বিকেলে এসে দাঁড়ালে তার খুশি চোখ-মুখ দেখে অনেক কিছু বুঝে নেয় সুলতান। ছেলে দেখতে দেখতে সতেরোয় পা দিল। কাজ গুছিয়ে নিতে জানে। সুলতান ছেলের বুকচাপা আনন্দ দেখে নিজের সেই বয়স খুঁজে পায়। সেই চোখ সেই নাক আর নিচে হালকা গোঁফ। গলার স্বরেও যেনবা যুবক সুলতান। ছেলে তার গর্ব। কলিজার টুকরা। তার মতোই দায়িত্বশীল। অন্ধের যষ্টি। বুড়োকালের ভরসা। দেওয়ান খন্দকারের লেদ মেশিনে কাজ শেখার জন্য ঢুকিয়ে দিয়েছিল। শিখতে শিখতে কেটে গেল চার-পাঁচ বছর। এখন বেতন পায়। মাস শেষে আড়াই হাজার টাকা অনেক শক্তি। সুলতানের অহঙ্কার। একদিন ছেলে নিজের দোকান দেবে। সেই দোকানের এককোনায় বসে বসে খবরের কাগজ পড়বে সুলতান। এতদিন খবরের কাগজ হকারি করল... তার খবর নেয় কে? ‘কাড পালু বা?’ ‘হয়। কাল নহায় মঙ্গলবার পামো। খন্দকার চাচার ঠে কিছু টাকা চানু। কাল দিবা চাইলে।’ ‘আল্লাহ ভরসা বা। তুই এতি-উতি বেশি বেড়াই না। কী-বা কয় কোরনা না ভাইরাক্স আইছে। খুবে সাবধান।’ ‘মুই তো মাক্স পরি যাও। বার বার হাত ধোও। সবার হাত ধুবা হবি। তুইও বা বাইরাবু না। তোর তো ফির মাক্স নাই।’ ‘মোর যা কোমরের বিষ। ক্যাংকরি যাইম? ’ ‘তোর বাপর তনে কটা ট্যাবলেট আনি দিস বা মিরন।’ ‘কাইল খন্দকার চাচা টাকা দিলি তো।’ জামিলা আরও একটি রুটি তুলে দেয় পাতে। যোয়ান ছেলে পেটভরা না খেলে শক্তি পাবে কোথায়? কাজ করবে কীভাবে? সে তো মা। ছেলের খাওয়াই তার শান্তি। তারপর মিরন অনেক দূর থেকে এসেছে। মেম্বারের বাড়ি কি এখানে? জামিলা জানে, মিরন সকাল সকাল রিলিফ নিতে যাবে। জামিলা আজ ভাত রাধবে। রুটি খেতে খেতে আর ভাল লাগে না। কবে যে সবকিছু আবার খুলবে কে জানে। মন বড় অস্থির হয়ে থাকে। কাকে কী বলে। সে আটার ম- ডলে। টুকোর টুকরো ভাগ। ছয়খানা রুটি। সকাল হতে হতে সূর্য অনেকখানি উঠে যায়। জামিলার রুটি শেঁকাও শেষ। সুলতান সবে গরম রুটির প্রান্তে কামড় বসিয়েছে, আকস্মিক মন উদাস হয়ে গেল। মিরন থাকলে খেয়ে নিত। কখন রিলিফ পাবে আর কখন খাওয়া। সুলতানের বুড়ো শরীর। কোমরে আঘাত আর ব্যথা। চলতে-ফিরতে ভালই কষ্ট হয়। পিঠের ডানপাশে টান পড়ে। তার পরও একটু বের হবে। কোথায় রিলিফ দিচ্ছে? ইউনিয়ন পরিষদ না কি মেম্বারের বাড়ি? সে দেখেশুনে যেতে চায়। তার মাস্ক নেই। কী করা যায়? মুখে গামছা বেঁধে নেয়া যায়। রুটির শেষ টুকরো মুখে পুরে স্বগতোক্তি নাকি জিজ্ঞাসা ছুড়ে দেয় সে। ‘মিরন কয়া গেল না? সেখন মঙ্গলবার শননু, তো ফির আইজ দিবি? মোক কলি মুইহো যাবা পারনু হয়।’ ‘মিরন মিরন... আয় বা, গরম গরম রুটি খাবু।’ জামিলা উনুনের পাড় থেকে হাঁক দেয়। ছেলে মরিচের চাটনি পছন্দ করে। সেও কাল থেকে মুখে কিছু তোলেনি। কোত্থেকে খাবার আসবে? কাজকাম নাই। দোকানপাট বন্ধ। কোত্থেকে যে কী হলো, মানুষজন অফিস-আদালত সব ছুটি। কবে খুলবে কে জানে। মিরন সকাল সকাল লেদ মেশিন কারখানায় যায়। সারাদিন কাজ করে। রাতে ফিরে শরীর আর কাপড়ের কালিঝুলি পরিষ্কার করে নেয়। জামিলা তখন ভাত বাড়ে। উচ্ছে ভাজা আর মসুরের ডাল। বাপ-বেটা দুজনের পছন্দ। কোনদিন মাছের টুকরো। জামিলার মন ভরে যায়। এই কয়েকদিন সেই জীবনছন্দ নেই। দোকান বন্ধ হয়ে গেল। সরকার বলে বাইরে বেরোন যাবে না। খুব বেশি দরকার না থাকলে ঘরে থাকতে হবে। জামিলা এসব কিছু বোঝে না। কাজের মানুষ ঘরে থাকলে খাবার আসবে কোত্থেকে? জামিলা নির্নিমেষ দক্ষিণের ঘরে তাকিয়ে থাকে। উনুনের আগুন ধীরে ধীরে ছাই হয়। তার মন বড় আনমনা। কী সব ভাবতে ভাবতে আবার দক্ষিণের ঘরে ডাক পাড়ে। ‘মিরন মিরন... ওই মিরন? আয় বাপ।’ ‘মিরন ফির কোঠে? ওঁয় তো ঘরোত্ নাই।’ ‘ওহ হো মোর মাথা খারাপ। ওঁয় তো রিলিপ আইনবার গেইচে। কাইল রাইতোত কইছে মোক।’ জামিলা বুঝি সম্বিত ফিরে পায়। আজ মন বড় উ™£ান্ত। কেন এমন লাগে? রাস্তায় শজনের গাছে আরও দুটো কাক এসে জড়ো হয়েছে। সেগুলো অদ্ভুত চোখে নিচে তাকিয়ে থাকে। কী আছে সেখানে? জামিলা উঠে বসে। সুলতানও মুখে গামছা বেঁধে নেয়ার জন্য আঙিনায় নামে। কী সব চিন্তা করে। আইজ কি রিলিফ দিবি? মিরন কী কইচে তোক?’ ‘হেরা তো কাল দিবা চাইছিল। মিরন পায় নাই। আইজ গেইচে, যদু দেয়।’ ‘মুইও এ্যানা বাইরাও।’ ‘এ্যালায় ফির কুণ্ঠে যাইমেন? শরীর বলে চলোচে না...কুসঠি পড়ি থাকিমেন ফির।’ ‘আ রে নহায়... যদু মুইহো কিছু পাও।’ ‘হয় মেম্বর তোমাক দিবা তনে বসি আছে।’ তারপর অনেকটা পথ। রোদ মধ্য আকাশে উঠে গেছে প্রায়। সুলতানের হেঁটে আসতে একটু অসুবিধে তো হয়। সে ওসব সমস্যা মনে করে না। বেঁচে থাকতে গেলে কত কষ্ট কত ঝড় আসে আর যায়, কতক তার দেখা হয়, কতক অপেক্ষায় থাকে, এসব কিছু নয়। যদি একটি ব্যাগ পাওয়া যায়। লাল-সাদা ডোরাকাটা দাগ। পাঁচ কেজি চাল আর মসুর-তেল-মরিচ-পেঁয়াজ-লবণ। এক-আধ শ টাকা হলে কিছু ওষুধপত্তর কিনতে পারে। এইসব আশা-প্রত্যাশা-স্বপ্নের মধ্যে সারা রাস্তায় তৃষ্ণার্ত দু-চোখ মিরনকে খোঁজে। মেম্বার বাড়ির তো এসেই গেল, তাকে দেখা যায় না। মানুষজনের ভিড়। এই ভিড়ের কোন কোনায় ছেলে আছে কে জানে। সুলতান এগিয়ে যায়। ভিড় বটে। রিলিফ নয়, চালচোর ধরা পড়েছে। সেই কারণে রিলিফ দেওয়া বন্ধ। মানুষজন তামাশা দেখে। সুলতানের খুব ইচ্ছে হয়, এই যে নেতা মানুষ, তাদের আল্লায় দিলে কত সম্পদ কত টাকা। তারা ভোট চায়। মানুষজন ভোট দেয়। তারা চুরি করে কেন? যখন এই চোরেরা ধরা পড়ে কেমন লাগে দেখতে? তাদের চেহারা কেমন হয়? সুলতানের কোমরে টান। অস্থির চঞ্চল ব্যথা। এই গোল হয়ে অস্থির দাঁড়িয়ে থাকা ভিড় ঠেলে সামনে দাঁড়াতে পারবে কি? সে পারবে না। অসম্ভব। তখন ভিড়ের ভেতর থেকে কোনো হট্টগোল, কোনো চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। মানুষের দুদ্দাড় হেঁটে চলা অথবা কে জানে কী। মারধর। উচ্চকণ্ঠ কোরাস। ‘মার শালা রে মার’। সুলতান ভিড়ের কাছে গিয়ে অচেনা কাউকে অথবা সবাইকে জিজ্ঞেস করে, Ñ ‘কিসের গ-গোল মিয়া?’ ‘কেমনে কই? তুমিও যেমন শুনতাছো আমিও। তবে কোনো চোর ধরা পড়েছে।’ ‘দেখি দেখি একটু একটু।’ ‘দূরো মিয়া ঠ্যালো ক্যান?’ সুলতান এগোতে পারে না। মানুষজন চাপাচাপি ভিড় করে আছে। এই ভিড়ের মধ্যে রিলিফ পাবে না মিরন। কে জানি বলে রিলিফ দেয়া বন্ধ। সুলতানের গলা শুকিয়ে আসে। বড় আশা করেছিল, ছেলে চাল-ডাল আনলে ভাত খেত। এই তো একটু আগে কথা বলছিল। জামিলা বলে, Ñ ‘মিরন রিলিপ আইনবার গেইচে। কাল দিবার কথা আছিল না, দেয় নাই, আইজ নাকি দিবি।’ ‘খন্দকার মিয়াও টাকা দিবি বলে।’ ‘হয়। সেদিন কছোলো, কাজ নাই টাকা নাই।’ ‘আইজ যদু গার্মেন্টেসে কাজ করিল হয়, ঘরোত্ বসি বেতন।’ ‘হয় তো।’ ‘ব্যাটায় চাল-ডাল আনলে দুপুরে ডালভরতা দিয়া ভাত খামো। এ্যালায় তুই থাক, মুই এ্যানা বেইরাও।’ সুলতান বাইরে বেরোল। তার মুখে মাস্ক নাই। গামছা বেঁধে নিয়েছে। মনের মধ্যে তবু খুত-খুত শঙ্কা। পুলিশ বা আর্মি দেখলে কান ধরে ওঠবস করা লাগবে। পেটের ভাত নাই। মাস্ক কিনব কোথা থেকে? এইসব ভাবনায় কে যেন বারবার কানে কানে বলে, রিলিফ পাইছ মিয়া? সুলতান অদৃশ্য সেই প্রশ্নকারিকে জবাব দেয়, ‘না ভাই এ্যালাও পাও নাই। তবে পামু ইনশাআল্লাহ।’ মনে আশা রাখা ভাল। এতে বুকে বল বাড়ে। এখন সামনের ভিড়ে হতাশার ছবি আঁকতে অঁাঁকতে কাউকে নির্নিমেষ খুঁজতে থাকে সে। মিরন কই? তখনই বুঝি ভিড়ের মধ্য থেকে আর্তচিৎকার ভেসে আসে। কে? কে? এই স্বর যে খুব চেনা চেনা লাগে। সেই কণ্ঠ বুকের গহীনে চারপাশে বাড়ি মারতে মারতে বাতাসে ছড়িয়ে যায়। সুলতান মরিয়া হয়ে মানুষের পায়ে পায়ে মাথা গলিয়ে ভেতরে চলে আসে। একেবারে সামনে। তখন কেউ একজন তাকে চেপে ধরে। সুলতান বুঝি বমি করে দেয়। মানুষ কোনো একজনকে পেটাচ্ছে। মিরন... মিরন। ছেলে যে গড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তিন নাকি চারজন মানুষ তার বুকে পায়ে মুখে লাথি মারে। একটু দূরে পড়ে আছে লালা-সাদা ডোরাকাটা দুটো ব্যাগ। মাটিতে ছড়িয়ে আছে চাল। আহা! সুলতান কী করে? সে ছুটে যেতে চায়। মিরনের নাকে-মুখে-বুকে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। কোন সমাজের জলছবি মানচিত্রের মতো মনে হয়। মানুষের সভ্যতা। সুলতান গা-ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে। তার কোমরে কোন ব্যথা নাই। আহা তার কলিজার টুকরা! সে চিৎকার দেয়। মিরন কী করছে? কী অপরাধ? সেই চিৎকার সেই প্রশ্ন ভিড়ের কোলাহল-বাতাসে ভেসে ভেসে দূর দিগন্তে হারিয়ে যায়। নিজেকে ছাড়াতে পারে না। তার শরীর আলগোছে ঝুলে পড়ে। চারদিক অন্ধকার। তখন কানের কাছে কে যেন বলে উঠে। ‘মিয়া চুপ কইরা থাকো। মানুষ রিলিফ পায় না, আর হেয় ব্যাডা দুইডা ব্যাগ নিছিল। চোর। চালচোর। একটু খাঁড়াও। মজা দেইখ্যা লও।’ ‘বাবা গো, আমাক ছাড়ি দেন। ছাড়ি দেন বা রে, মোর ছইল...ওইডা মোর ছইল। ...বাবা মিরন মিরন। আহা বাছা মোর কাল থাকি না খাওয়া।’ তাকে কেউ ছাড়ে না ...ছেড়ে দেয় না। সুলতান নিজেকে ছাড়িয়ে নিতেও পারে না। মিরন মাটিতে লুটিয়ে কাত্ দুই হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে থাকে। সেভাবেই একদলা রক্ত বমি করে নিজেকে ছেড়ে দেয়। ভিড় ভেঙে যায়। তিনজন নেতা মোটরসাইকেল আরোহী নীল-সাদা ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যেতে থাকে। একটি ট্রলি কীসব বস্তা ভরতি ধুক-ধুক শব্দ তুলে পেছন পেছন গড়িয়ে যায়। বাজারের দিকে। সুলতান এবার ছড়িয়ে পড়া ভিড় ঠেলে এই অবসরে ছেলের কাছে যেতে পারে। সে তার শুকনো হাড় জিড়জিড়ে পাঁজর দিয়ে ছেলেকে আগলে রাখে। ছেলের রক্তমাখা মাথা কোলে তুলে নেয়। অথবা তার মাথা মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে। মাটিতে নোনাজল। তখন শেষ-দুপুর। বোশেখের গাছে গাছে হাজার ফুলের মাতাল শোভা। মানুষজন যে যার মতো চলে গেছে। সুলতান তার ছেলেকে নিয়ে উঠতে দাঁড়াতে পারে না। তার ছেলে চালচোর। জীবনের এই উপাধি যে বড় ভারি লাগে।
×