ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পিক টাইম কবে ॥ করোনা সংক্রমণ

প্রকাশিত: ২২:২০, ৮ জুলাই ২০২০

পিক টাইম কবে ॥ করোনা সংক্রমণ

রশিদ মামুন ॥ কোভিড-১৯ সংক্রমণে গত ৩৮ দিন ধরে বাংলাদেশের চিত্র অনেকটা একই রকম। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা পরীক্ষার ২০ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে থাকছে। সংখ্যা বিবেচনায় তিন থেকে চার হাজারের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সাধারণত সংক্রমণের চূড়ায় ওঠার পর উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ধীরে ধীরে সংক্রমণ কমেছে। এক পর্যায়ে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ওইসব দেশগুলো করোনাকে বাগে আনার ঘোষণাও দিয়েছে। বাংলাদেশে এই চিত্র বলছে করোনা সংক্রমণের দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। যা নিয়ন্ত্রণ আনতে না পারলে জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপরদেষ্টা মোস্তাক হোসেন বলেন, এটাতো আর আপনা আপনি নামে না, নামানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে যে যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা নিলেই নামবে। এছাড়া যদি ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১৫ কোটি আক্রান্ত হয় তাহলেও নামবে। ভাইরাসের আয়তন খুব শঠতাপূর্ণ। এটাতে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা না করলে আমরা বিপদে পড়ে যাব। এখন বিশে^ করোনা আক্রান্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টাদশ। প্রতিদিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের ওপরে থাকা ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, পেরু, ব্রাজিল এবং রাশিয়ার চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এসব দেশই করোনা আক্রান্তের চূড়ায় ওঠার পর ধীরে ধীরে সংক্রমণ কমে এসেছে। এখন অনেক দেশের সংক্রমণ একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে। যদিও বাংলাদেশের করোনা বিস্তারের সঙ্গে অনেকটা মিল রয়েছে মেক্সিকো, ভারত, পাকিস্তান, ইরান এবং সৌদি আরবের। দেশগুলোতেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দীর্ঘসময় একই রকম রয়েছে। উন্নত দেশগুলো করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য দুটি কাজ করেছে। একটি কঠোরভাবে লকডাউন করে মানুষের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এরপর ব্যাপকসংখ্যক মানুষকে করোনা টেস্ট করে আক্রান্তদের পৃথক করার পাশাপাশি তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের সঙ্গনিরোধের ব্যবস্থা করেছে। এতে সংক্রমণ একটি সময় পিক বা সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে আস্তে আস্তে নেমে এসেছে। কিন্তু আমাদের এই দুই জায়গাতেই ঘাটতি রয়েছে। সম্প্রতি চীনা বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ ছাড়ার সময় সংবাদ সম্মেলনে করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সচেতনতা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করেও সব থেকে সফল করোনা নিয়ন্ত্রণের দেশের তালিকায় নাম রয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি যুক্তরাজ্য, স্পেন এবং ইতালির। দেশগুলোর প্রতিদিনের মৃত্যু আর আক্রান্তের চিত্র এখন অনেকটাই বদলে গেছে। অনেকটা চীনের পথ অনুসরণ করেই ইউরোপ থামিয়ে দিয়েছে করোনার ধ্বংস লীলা। এই তালিকায় সব থেকে সফল দেশ ইতালি। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে করোনার সংক্রমণ ধরা পাড়ে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া আর মৃত্যুর সংখ্যায় সারা বিশ্বের চোখ এক সময় আটকে ছিল দেশটিতে। প্রতিদিনই বিশ্ব মিডিয়াতে নানাভাবে উঠে আসত ইতালির নাম। চীনের পর সব থেকে বেশি আলোচিত ছিল ইতালি। দেশটিতে ২১ মার্চ ৬ হাজার ৫৫৩ জন এক দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হন। এই দিনটি ছিল ইতালির পিক আক্রান্তের দিন। এরপর ২২ মার্চ ৫ হাজার ৫৫৯ জন, ২৩ মার্চ ৪ হাজার ৭৮২ জন, ২৪ মার্চ ৫ হাজার ২৩৯ জন, ২৫ মার্চ ৫ হাজার ১৯৭ জন আক্রান্ত হন। এখন সেই ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা নেমে এসেছে একেবারে নিচের দিকে। গত ২ জুলাই ২০১ জন ৩ জুলাই ২২৩ জন, ৪ জুলাই ২৩৫ জন, ৫ জুলাই ১৯২ জন এবং ৬ জুলাই ২০৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ইতালিতে ২ লাখ ৪১ হাজার ৮১৯ জন আক্রান্ত হন। আর ৩৪ হাজার ৮৯৬ জন মারা যান। যুক্তরাজ্যে এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ৮৫ হাজার ৭৮৬ জন। মারা গেছেন ৪৪ হাজার ২৩৬ জন। গত ১০ মার্চ দেশটিতে পিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল এক দিনে ৭ হাজার ৮৩৭ জন। এরপর ১১ জুন তা নেমে যায় ৪ হাজার ৭২৭ জনে। এভাবে প্রতিদিনই কমতে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। গত ৬ জুলাই মাত্র ৩৫২ জন আক্রান্ত হয়েছেন। গত দুই জুলাই যা ছিল ৫৭৬ জন। জার্মানি এবং ফ্রান্সও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে। জার্মানিতে ২৭ মার্চ ছিল পিক ওই দিন আক্রান্ত হন ৬ হাজার ৯৩৩ জন আর ৬ জুলাই আক্রান্ত হন ৪৯৯ জন। দেশটিতে মোট করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৯৮ হাজার ৪৬ জন। ফ্রান্সে এক লাখ ৬৮ হাজার ৩৩৫ জন করোনা আক্রান্ত হন। এরমধ্যে মারা গেছেন ২৯ হাজার ৯২০ জন। দেশটির পিক ৩১ মার্চে ৭ হাজার ৫৭৮ জন করোনা আক্রান্ত হন। গত ৬ জুলাই আক্রান্ত হন ৪৯৯ জন। জানতে চাইলে অনুজীব বিজ্ঞানী ডাঃ বিজন কুমার শীল বলেন, উন্নত বিশ্বে করোনা টেস্টের ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে সেটা হচ্ছে না। চাহিদামাফিক টেস্ট করে আক্রান্তদের আলাদা করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ভাইরাস ইতালি, যুক্তরাজ্য এবং আমেরিকাতে যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে ঠিক সেভাবে আমাদের এখানে চালায়নি। আমাদের এখানের ভাইরাস সেই তুলনায় অনেক দুর্বল। কিন্তু এটাকেও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। এজন্য বেশি বেশি টেস্ট করার পাশাপাশি কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের কোন বিকল্প নেই। করোনা সংক্রমণে বিশ্বের দুই নাম্বারে থাকা দেশ ব্রাজিল। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম একজনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। এখন দেশটির মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ লাখ ২৬ হাজার ৭১ জন। পরিসংখ্যান বলছে গত ১৯ জুন দেশটিতে সর্বোচ্চ এক দিনে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার ২০৯ জন। এরপর যথাক্রমে ২০ থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত যথাক্রমে ৩১ হাজার ৫১৭ জন, ১৬ হাজার ৮৫১ জন, ২৪ হাজার ৩৫৮ জন এবং ৪০ হাজার ৩২ জন করে আক্রান্ত হয়। চলতি মাসের ২ জুলাই যা ছিল ৪৭ হাজার ৯৮৪ জন, ৩ জুলাই ৪১ হাজার ৯৮৮ জন, ৪ জুলাই ৩৫ হাজার ৩৫ জন, ৫ জুলাই ২৬ হাজার ২০৯ জন এবং ৬ জুলাই ছিল ২১ হাজার ৪৮৬ জন। তবে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্রাজিল সরকারের অনীহার কথা সবাই জানেন। দেশটির খোদ প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো এর ভূমিকা নিয়ে সরাবিশ্বই সমালোচনা করছে। আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে তিনে উঠে এসেছে ভারতের নাম। প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ পায়। এখন দেশটিতে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা ২১ থেকে ২৪ হাজারের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। যেহেতু সংক্রমণ একই পর্যায়ে রয়েছে। লকডাউন তুলে নিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ভারত। সঙ্গত কারণে প্রতিদিনই মৃত্যু এবং আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত ২ জুলাই ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৯৮৪ জন। এরপর ৩ জুলাই ২২ হাজার ৭২১ জন, ৩ জুলাই ২৪ হাজার ১৫ জন, ৫ জুলাই ২৩ হাজার ৯২৯ জন এবং ৬ জুলাই ২২ হাজার ৫১০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ভারতে এখন মোট ৭ লাখ ২১ হাজার ৩১০ জন করোনা আক্রান্ত। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ২০ হাজার ১৮৪ জন। দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানও করোনা নিয়ন্ত্রণে খুব বেশি সাফল্য দেখতে পারেনি। ভারতের কাছাকাছি সময় ২৬ ফেব্রয়ারি ২ জনের দেহে করোনা সংক্রমণের তথ্য জানায় দেশটি। এরপর মধ্য জুনে সংক্রমণ পৌঁছায় প্রায় সাত হাজারে এখন যা তিন থেকে চার হাজারের মধ্যে প্রতিদিন ওঠানামা করছে। পাকিস্তানের তথ্য বলছে, ১৪ জুন দেশটিতে করোনা আক্রান্ত হন ছয় হাজার ৮২৫ জন। এরপর ১৫ জুন ৫ হাজার ২৪৮ জন, ১৬ জুন ৪ হাজার ৪৪৩ জন, ১৭ জুন ৫ হাজার ৮৩৯ জন এবং ১৮ জুন ৫ হাজার ৩৮৫ জন আক্রান্ত হন। জুলাই এর ২ থেকে ৬ হিসেবে বলছে ২ জুলাই ৪ হাজার ৩৩৯ জন, ৩ জুলাই ৪ হাজার ৮৭ জন, ৪ জুলাই ৩ হাজার ৩৮৭ জন, ৫ জুলাই ৩ হাজার ১৯১ জন এবং ৬ জুলাই ৩ হাজার ৩৪৪ জন আক্রান্ত হন। পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫০৯ জন। ভারত পাকিস্তানের হতাশাজনক চিত্রের ঠিক বিপরীত চিত্র রয়েছে করোনার ধ্বংসযজ্ঞ চালানো অধিকাংশ দেশে। রাশিয়াতে ১৫ ফেব্রুয়ারি দুই জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। রাশিয়ায় করোনা সংক্রমণের পিক ছিল মে মাসের মাঝামাঝি। দেশটিতে গত ১১ মে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৬৫৬ জন করোনা আক্রান্ত হয়। এর পরবর্তী চার দিনও একই রকম সংক্রমণ ছিল। ১৫ মে রাশিয়ার সংক্রমণ ছিল ১০ হাজার ৫৯৮ জন। এখন অবশ্য এক দিনে সংক্রমণের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত ৬ জুলাই রাশিয়াতে করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৬১১ জন। রাশিয়ার পর পেরুও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বেশ ভালই সাফল্য দেখিয়েছে। গত ১৬ মার্চ পেরুতো হানা দেয়া করোনা পিকে ওঠে গত ৩১ মে। ওই দিন দেশটিতে ৮ হাজার ৮০৫ জন করোনা আক্রন্ত হন। এরপর আস্তে আস্তে এই সংক্রমণ কমতে শুরু করে। পহেলা জুন ৫ হাজার ৫৩১ জন, ২ জুন ৪ হাজার ৮৯৫ জন, ৩ জুন ৪ হাজার ৩০ জন, ৪ জুন ৪ হাজার ২৮৪ জন করোনা আক্রান্ত হন। গত পাঁচ দিনের পরিসংখ্যান বলছে ক্রমেই করোনার সংক্রমণ কমছে পেরুতে। দেশটিতে ২ জুলাই ২ জুলাই ৩ হাজার ৫২৭ জন, ৩ জুলাই ৩ হাজার ৫৯৫ জন, ৪ জুলাই ৩ হাজার ৪৮১ জন, ৫ জুলাই ৩ হাজার ৬৩৮ জন এবং ৬ জুলাই ২ হাজার ৯৮৫ জন করোনা আক্রান্ত হয়। এখনও করোনা সংক্রমণে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এখন ৩০ লাখ ৪১ হাজার ১২৯ জন মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। একক দেশ হিসেবে এক লাখ ৩২ হাজার ৯৯৩ জনের সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ডও দেশটির। এক দিনে সর্বোচ্চ ৩ জুলাই ৫৮ হাজার ৯১১ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তবে দেশটির একটি অঙ্গরাজ্যে করোনার সংক্রমণ বাড়লেও অন্য জায়গায় কমছে। প্রসঙ্গত এখন পর্যন্ত বিশ্বে এক কোটি ১৭ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৩ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছে। করোনা আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৫ লাখ ৪১ হাজার ২৪২ জন। সারা বিশ্বের গড় করনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২ জুলাই ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার। সাম্প্রতিক সময়ে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়াচ্ছে। তবে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড ছিল ১৭ এপ্রিল ৮ হাজার ৪৮৫ জন আর ৬ জুলাই ছিল ৩ হাজার ৫৮৫ জন। অর্থাৎ মৃত্যু কিছুটা কমলেও সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে।
×