ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনায় এ পর্যন্ত ৫৩ ডাক্তারের মৃত্যু

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ২৯ জুন ২০২০

করোনায় এ পর্যন্ত ৫৩ ডাক্তারের মৃত্যু

নিখিল মানখিন ॥ প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন রেকর্ড সংখ্যক চিকিৎসক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোভিড ও নন কোভিড রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। তাদের অনেকেই কয়েক মাস ধরে পরিবারের অন্য সদস্যদের কথা ভেবে বাসায় না গিয়ে হোটেলে অবস্থান করছেন। সেবা করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন অনেকে। করোনা জয় করে বাসায় অবস্থান না করে কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন এমন চিকিৎসকের সংখ্যাও অনেক। গত ২৭ জুন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৩১ জনে এবং মৃত্যু ঘটেছে ৫৩ জনের। বিএমএর কাছে আক্রান্ত চিকিৎসকের হালনাগাদ হিসাব থাকলেও তাদের মধ্যে কতজন চিকিৎসাধীন আছেন এবং কতজন সুস্থ হয়ে কাজে ফিরেছেন, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে বিএমএ বলছে, আক্রান্তদের অর্ধেকের বেশি ইতোমধ্যেই সুস্থ হয়েছেন এবং তাদের প্রায় সবাই আবার কাজে যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) জানায়, গত ২৭ জুন পর্যন্ত সারাদেশে ১৪৩১ জন চিকিৎসক, ১২৩৪ জন নার্স এবং অন্যান্য ১৭৯৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ঢাকা বিভাগের ঢাকা জেলায় ৬২৫ জন, নরসিংদীতে ৭ জন, গাজীপুরে ৫৮ জন, নারায়ণগঞ্জে ২৮ জন, টাঙ্গাইলে ৩ জন, কিশোরগঞ্জে ৫৯ জন, মানিকগঞ্জে ৩ জন, মুন্সীগঞ্জে ২২ জন, মাদারীপুরে ৪ জন, গোপালগঞ্জে ১৬ জন ও ফরিদপুরে ২ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠিতে ৪ জন, পটুয়াখালীতে ৫ জন, বরিশালে ৩১ জন, ভোলায় ৮ জন ও বরগুনায় ২ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লা জেলায় ৫০ জন, ফেনীতে ৩ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯ জন, রাঙ্গামাটিতে ৪ জন, নোয়াখালীতে ১০ জন, চাঁদপুরে ৪ জন, লক্ষ্মীপুরে ৭ জন, চট্টগ্রামে ৭৪ জন, কক্সবাজারে ৮ জন ও বান্দরবানে ১ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। খুলনা বিভাগে যশোর জেলায় ১৯ জন, সাতক্ষীরায় ২ জন, মেহেরপুরে ১ জন, নড়াইলে ৭ জন, চুয়াডাঙ্গায় ২ জন, কুষ্টিয়ায় ৬ জন, মাগুরায় ২ জন, খুলনায় ১৪ জন, বারেগহাটে ১ জন ও ঝিনাইদহে ১০ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। রাজশাহী বিভাগের সিরাজগঞ্জ জেলায় ৩ জন, পাবনায় ২ জন, বগুড়ায় ১১ জন, রাজশাহীতে ৪ জন, নাটোরে ১ জন, জয়পুরহাটে ২ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১ জন, নওগাঁয় ৫ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। রংপুর বিভাগের পঞ্চগড় জেলায় ১ জন, দিনাজপুরে ১৪ জন, লালমনিহাটে ৩ জন, নীলফামারীতে ২ জন, গাইবান্ধায় ৪ জন, রংপুরে ২৪ জন, কুড়িগ্রামে ৪ জন চিডিকৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সিলেট বিভাগের সিলেট জেলায় ৭১ জন, মৌলভীবাজারে ১৪ জন, হবিগঞ্জে ৮ জন, সুনামগঞ্জে ৭ চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। এভাবে ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলায় ১০ জন, ময়মনসিংহে ৯০ জন, জামালপুরে ২৮ জন এবং নেত্রকোনায় ১০ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মোট আক্রান্ত ১৪৩১ জন চিকিৎসকের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১৯৯ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১২০ জন, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৫৬ জন, আসগর আলী হাসপাতালের ২১ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১১ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালের ৬ জন, এ্যাপোলো হাসপাতালের ৫ জন, বারডেম হাসপাতালের ৭ জন, ইউনিভার্সেল হাসপাতালের ৩ জন, পঙ্গু হাসপাতালের ৯ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ১৮ জন ও কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের ১৭ জন চিকিৎসক রয়েছে। করোনায় অর্ধ শতাধিক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে ॥ ১৫ এপ্রিল সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মঈন উদ্দিন আহমেদ কভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সেটিই বাংলাদেশে কভিড আক্রান্ত হয়ে প্রথম কোন চিকিৎসকের মৃত্যু। এর ১৮ দিন পর ৩ মে করোনা কেড়ে নেয় অধ্যাপক ডাঃ অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মনিরুজ্জামানকে। তারও আট দিন পর এ তালিকায় যুক্ত হয় অত্যন্ত পরিচিত মুখ রেডিওলোজিস্ট অধ্যাপক ডাঃ অবসরপ্রাপ্ত মেজর আবুল মুকারিম। তারপর থেকে দ্রুত বেড়েই চলেছে চিকিৎসক মৃত্যুর সংখ্যা। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ মারা যাওয়া চার চিকিৎসক হলেন ফিরোজা বেগম মিনু, এস এম সাইফুল ইসলাম, ইউনুস আলী খান ও শহীদুল আনোয়ার। তাদের মধ্যে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ফিরোজা বেগম ২৫ জুন ভোরে মারা যান। তিনি রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। স্বাস্থ্য সুরক্ষা সমস্যা ॥ করোনা থেকে বাঁচার জন্য চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও জরুরী। কিন্তু এ দুটিতেই এখনও ঘাটতি আছে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের গবেষণাতেও বিষয়টি উঠে এসেছে। গত ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত দেশের ৩৮টি জেলার ৪৭টি হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র ২২ দশমিক ২ শতাংশ হাসপাতালের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ সবাই করোনা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। আর ২ দশমিক ২ শতাংশ হাসপাতালের কেউই প্রশিক্ষণ পাননি। গবেষণার অন্তর্ভুক্ত ২৫ শতাংশ হাসপাতালের সব চিকিৎসক ও ৩৪ শতাংশ হাসপাতালের সব নার্স ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সামগ্রী (পিপিই) পাননি বলে জানিয়েছেন। জনস্বাস্থ্যবিদ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলছেন, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রীর ঘাটতি ছিল প্রথম থেকেই। আর পিপিই’র মান নিয়ে হয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। আবার এ ধরনের মহামারী মোকাবেলায় যে সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স থাকা দরকার তার এক-তৃতীয়াংশও নেই। স্বাভাবিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য যে পরিমাণ লোকবল এখানে থাকা দরকার সেটিও নেই। তবে সরকারী সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দায়িত্বরত প্রত্যেক চিকিৎসককেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কে সর্বোচ্চ সচেতন থাকতে হবে। শুধু পিপিই পরলেই হবে না, তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। তারা আরও বলেন, বাংলাদেশে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অপ্রতুলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল ঢাকায় সফর করে যাওয়া চীনা বিশেষজ্ঞ দল। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে। আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এমন অবস্থায় শুধু হাসপাতাল এবং আইসিইউ বাড়ালেই চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। শীঘ্রই চিকিৎসক, নার্স এবং টেকনোলজিস্ট সঙ্কট দেখা দেবে বাংলাদেশে। তাই সরকারকে স্বাস্থ্যসেবার লোক বাড়ানোর অনুরোধ করেন চীনা প্রতিনিধি দল। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ এম এ আজিজ বলেন, দেশের করোনা মোকাবেলায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে চলেছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। চিকিৎসা সুরক্ষা সামগ্রীর মানের কথা চিন্তা না করে, সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। সরকার যদি চিকিৎসকদের সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখে এবং জনগণ যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তাহলে আমরা অবশ্যই করোনাযুদ্ধে জয়ী হব বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ এম এ আজিজ। ঢাকায় এত চিকিৎসক আক্রান্ত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিএমএর করোনা প্রতিরোধ ও সহায়তাসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ঢাকায় হাসপাতাল-ক্লিনিক ও রোগী দুটোই বেশি। তাই দেশের অন্য এলাকার চেয়ে ঢাকায় বেশি চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। ডক্টরস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের সমন্বয়কারী ডাঃ অনুপম দাশ বলেন, পর্যাপ্তসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী না হলে বিপর্যয় এড়াতে পারবে না সরকার। প্রথম থেকেই কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো দরকার ছিল। এসব ক্ষেত্রে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক পদায়ন করা না হলে চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি এ্যান্ড রেসপনসিবিলিটির (এফডিআরএস) মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ শেখ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী পদায়ন করা হচ্ছে না। ফলে একটি সঙ্কটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এতে অনেক স্থানে চিকিৎসকরাও সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন। এ সমস্যার সমাধান না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। বিএমএর মহাসচিব ডাঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, মাস্ক, পিপিইসহ সুরক্ষাসামগ্রী সঠিকভাবে না পাওয়ার কারণে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। আর মহামারী মোকাবেলার জন্য দ্রুত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসকরা আইসিইউতে কাজ করেছেন।
×