ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতারক চক্র সক্রিয়

প্রকাশিত: ২৩:০২, ২৫ জুন ২০২০

প্রতারক চক্র সক্রিয়

আজাদ সুলায়মান ॥ মাহবুর রহমান। বাড়ি চাঁদপুুর। মাস চারেক আগে মালয়েশিয়ায় থেকে বাংলাদেশে আসেন। এক মাস আগে তার ফেরারও কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তিনি আর যেতে পারেননি। সম্প্রতি বিমানের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হওয়ার পর তিনি আশকোনায় এলাকায় একটি ক্লিনিকে করোনার পরীক্ষা করান। ফল তার নেগেটিভ আসে। পরে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাকে সার্টিফিকেটও দিয়ে দেন। এই জন্য তাকে দিতে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। ১৮ জুন একটি ফ্লাইটে করে কুয়ালামপুর যান। কিন্তু সেখানে তার সার্টিফিকেটটি জাল প্রমাণ হয়। ওই দেশে করোনায় পরীক্ষায় তার পজেটিভ আসে। পরে তাকে ১৪ দিনের আইসোলেশনে রাখা হয়। রুহুলের এক স্বজন জানান, সার্টিফিকেটটি জাল ছিল। তার সঙ্গে আরও ৫ জন মালয়েশিয়ায় ধরা পড়ে। রুহুল আমিনের মতই অনেকে ওইসব প্রতারকদের জালে আটকা পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন। তারা বিদেশ গিয়ে আটকা পড়ছেন। প্রতিদিনই এমন ঘটনা ধরা পড়ছে। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে রাজধানীর তেজগাঁয়ে বাসায় গিয়ে করোনা পরীক্ষা করার সঙ্গে জড়িত জিকেজি নামের এক ক্লিনিকের মালিক দম্পতিকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ তথ্য। জানা গেছে, করোনার মহামারীকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর প্রতারক ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নেগিটিভ সার্টিফিকেট দেয়ার ব্যবসা করে আসছেন। আর একেকটি সার্টিফিকেট নিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকাও হাতিয়ে নিচ্ছেন। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক প্যাডে দেয়া হচ্ছে করোনাভাইরাসের নেগেটিভ রিপোর্টের ভুয়া সনদ। হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মচারী ও ডাক্তারদের সম্পৃক্ততায় এসব অপকর্ম করছে একটি জালিয়াত চক্র। তাদের বেশি টার্গেট বিদেশ ফেরত লোকদের। আবার অনেক শিক্ষিতও লোকজনও তাদের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এসব প্রতারণা বেড়ে যাওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মাঠে নামে। ইতোমধ্যে সারাদেশে সাত ডজন প্রতারক গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে। একেকটি গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ৭ থেকে আট জন। গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ নামী-দামী হাসপাতালে যোগাযোগ করে রোগী ভাগিয়ে নিচ্ছে বলেও তথ্য পেয়েছে পুলিশ। ওইসব গ্রুপে কিছু নামী-দামী হাসপাতাল ও ক্লিনিকের চিকিৎসকদদের নাম পেয়েছে। প্রতারক চক্রের পুরো বায়োডাটা সংগ্রহ করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। তাদের ধরতে সাড়াশি অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) কৃঞ্চপদ রায় জানান, করোনা মহামারীতেও প্রতারণা থেমে নেই কিছু চক্রের। করোনার পরীক্ষা নিয়েও তারা প্রতারণা করছে। ওইসব চক্রের সদস্যদের ধরতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছে নানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। নির্দিষ্ট হাসপাতাল বা ক্লিনিক ছাড়া অন্য কোথাও করোনার পরীক্ষা না করাতে সতর্ক থাকতে হবে। এ বিষয়ে পুুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, গত মাসে জাপানের নাগরিকদের নিয়ে বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার পর একটি ফ্লাইটে ৪ জনের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তবে তাদের কাছে নেগেটিভ সনদ ছিল। যেটি বাংলাদেশ থেকে নেয়া। একইভাবে বিশেষ ফ্লাইটে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফিরে যাওয়া তাদের ১২ নাগরিকের করোনা ধরা পড়েছিল। তারা সবাই বাংলাদেশ থেকে করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে গেছেন। গত ৩ জুন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া যায়। সেখানে যাওয়ার পরপরই ওই ফ্লাইটে যাওয়া ৫ জনের করোনা ধরা পড়ে। তারা করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ থেকে যারা ওই ফ্লাইটে গিয়েছেন তাদের মধ্যে সেকেন্ড হোমে মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব নেয়া কয়েকজন রয়েছেন। ফিরতি ফ্লাইটে মালয়েশিয়ায় আটকেপড়া ১৪০ বাংলাদেশীকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। ওই ফ্লাইটে শিক্ষার্থী, বাংলাদেশী শ্রমিক ও দেশটিতে ভ্রমণে যাওয়া কিছু বাংলাদেশী ছিলেন। প্রতারকদের জন্য দেশের বদনাম হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিমান যাত্রীদের করোনামুক্ত হেলথ সার্টিফিকেট নিতে হচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে- সরকারী হাসপাতালগুলো করোনা পরীক্ষা করতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে লোকজনকে। আর এই সুযোগে প্রতারক চক্র ঢাকাসহ সারাদেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বিদেশযাত্রা কিংবা কারও চাকরি বাঁচাতে বা অন্য প্রয়োজনে দরকার করোনাভাইরাসের নেগেটিভ রিপোর্ট। আবার অফিসে যোগদান করবেন না অথবা ভ্রমণে যাবেন কিংবা সরকারী ছুটি ও বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধার আশা করছেন, এমন ব্যক্তিরা চাচ্ছেন করোনা পজিটিভ রিপোর্ট। আর এর সুযোগ নিচ্ছে ওই প্রতারক চক্র। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ওইসব তথ্য উদ্ঘাটন করেছে। প্রতারণা ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর মুগদা, ঢাকা মেডিক্যাল, মিডফোর্ড হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালের বহির্বিভাগের আশপাশে সাদাপোষাকে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তারা রোগী বেশে হাসপাতালগুলোতে গিয়ে দালাল চক্র ও পেছনে থাকা হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছেন। সম্প্রতি টাকার বিনিময়ে করোনাভাইরাসের নেগেটিভ-পজেটিভ সনদ বিক্রি করা একটি চক্রের চার সদস্য ফজল হক, শরিফ হোসেন, জামশেদ ও লিয়াকত আলী র‌্যাবের জালে আটকা পড়ে। তাদের কাছ থেকে করোনাভাইরাসের অনেক ভুয়া সনদপত্র, দুটি কম্পিউটার, দুটি প্রিন্টার এবং দুটি স্ক্যানার মেশিন উদ্ধার করা হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় চাঞ্চল্যকর তথ্য। তারা র‌্যাব কর্মকর্তাদের জানিয়েছে, সারাদেশেই তাদের লোকজন আছে। বিশেষ করে গ্রামের লোকজন ও বিদেশ ফেরত লোকজনকে টার্গেট করা হয়। এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম জানান, ধৃতদের কাছ থেকে নানা তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের সহযোগীদের ধরার চেষ্টা চলছে। ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতারকদের ধরতে নজরদারি বৃদ্ধি করতে হয়েছে। র‌্যাবের অপর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতারকদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। ওই তালিকায় কিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কতিপয় চিকিৎসকের নাম রয়েছে। কিছুদিন আগে ৪ প্রতারককে গ্রেফতার করার পর তারা জানিয়েছিল, হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক তাদের সহায়তা করছে। তারা মুগদা হাসপাতাল থেকে দেয়া করোনা রোগীর রিপোর্টের কপি সংগ্রহ করে তা স্ক্যান করে সেখানে নাম বসিয়ে বিক্রি করে আসছিল। যাদের নেগেটিভ সনদ দরকার তাদের নেগেটিভ বা যাদের পজিটিভ সনদ দরকার তাদের তাই দিচ্ছিল টাকার বিনিময়ে। জালিয়াত চক্রটি দেড় শতাধিক মানুষের কাছ থেকে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার করে টাকা নিয়ে করোনার ভুয়া নেগেটিভ ও পজিটিভ সনদ দিয়েছে। আরও শতাধিক লোককে ভুয়া সনদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরও পাঁচ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়েছে চক্রটি। জানতে চাইিলে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, করোনা পরীক্ষা করা হয়-এমন অধিকাংশ হাসপাতালে দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এক একটি চক্রে ৭-৮ জন করে প্রতারক রয়েছে। হাসপাতালে সেম্পল দিতে আসা সাধারণ রোগীদের দ্রুত কাক্সিক্ষত সনদ দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে দেয় এসব চক্রের সদস্যরা। দালাল চক্রের সঙ্গে হাসপাতালের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত রয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে। এ বিষয়ে পাবনার পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম জানান, করোনার পরীক্ষা নিয়ে যাতে কেউ প্রতারণা করতে না পারে সেজন্য জেলার হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। দালাল চক্রদের ধরার চেষ্টা চলছে। একই কথা বলেছেন কুমিল্লার পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম ও কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন। তারা জানান, প্রতারকদের বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। তাদের ধরতে পুলিশ সদস্যরা নরজদারি করছে।
×