ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

বাংলাদেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনাÑ২০২১-২০৪১ মুজিববর্ষে শেখ হাসিনার শ্রেষ্ঠতম উপহার

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ২২ মার্চ ২০২০

বাংলাদেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনাÑ২০২১-২০৪১ মুজিববর্ষে শেখ হাসিনার শ্রেষ্ঠতম উপহার

গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দেশের ২০২১-২০৪১ সালের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল অনুমোদন করেন। সাম্প্রতিক বছর সমূহে অর্জিত বলিষ্ঠ আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির বাড়ার হার ২০২০ এর বার্ষিক ৮.২% হতে ২০৩১ সালে বার্ষিক ৯% এ এবং ২০৪১ সালে বার্ষিক ৯.৯% এ উন্নীত করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এরূপ উন্নয়নের সঙ্গে এবং তার ফলশ্রুতিতে দেশে ২০২০ সালে বিদ্যমান চরম দারিদ্র্য ৯.৪% থেকে ২০৩১ সালে ২.৫% এ এবং ২০৪১ সালে ০.৭% ভাগে নামিয়ে আনা যাবে। ফলত দেশের মাথাপিছু আয় ২০৪১ সালে ২০২০ এর মূল্য মাত্রায় ১২৫০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে এবং দারিদ্র্য ইতিহাসের স্মৃতিতে পর্যবসিত হয়ে বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যতম উন্নততম ও বিত্তশালী অর্থব্যবস্থায় রূপান্তরিত করবে। এই উন্নয়নের ভিত্তি হবে ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীল সক্ষমতা, পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান, ঈপ্সিত আর্থিক ও সামাজিক সমতা, উদ্ভাবনশীল জ্ঞানভিত্তিক অর্থব্যবস্থা ও জীবনের উৎকর্ষ বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ। এইসব অর্জনের জন্য ৪টি প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভ হবে : (১) সুশাসন, (২) গণতন্ত্রায়ন, (৩) প্রশাসন ও উন্নয়নের বিকেন্দ্রায়ন এবং (৪) আর্থিক ও সামাজিক উৎপাদনশীলতা ও নিপুণতা বাড়ানোর সক্ষমতা সৃজন ও বর্ধন। সমৃদ্ধি সমভাবে ভোগ করণের জন্য প্রয়োজন হবে সুশাসনের বিস্তৃতি। এই বিস্তৃতি রূপ পাবে বিচার বিভাগের নিপুনতায়, সুশীল প্রশাসনের গণমুখী কার্যকরণে, নিপুণ ভূমি ব্যবস্থাপনায় এবং অর্থব্যবস্থার সম্পদের উন্নয়ন ও সর্বোত্তম ব্যবহারক্ষম সুপরিচালনে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনের পথে ভিত্তি হিসেবে প্রয়োজন হবে অর্থব্যবস্থার প্রাজ্ঞ সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা। এরূপ ব্যবস্থাপনার উপকরণ হিসেবে প্রয়োজন হবে নিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি, সরকারের বাজেটে নিম্নতর আর্থিক ঘাটতি, বৈদেশিক দেনা পাওনায় স্থিতিশীলতা এবং সরকারের পরিমিত দেশী ও বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনা। এই লক্ষ্যে আর্থিক নীতির সঙ্গে সুসমন্বিত করতে হবে মুদ্রানীতি। প্রয়োজন হবে প্রক্ষেপিত রফতানির বহুমুখীকরণে বাণিজ্যিক অবকাঠামোর প্রসারন এবং বাণিজ্য নীতি ও বিশেষত রফতানি ভর্তুকির যথাপ্রয়োজন ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীল সংস্কার। তেমনি উৎপাদন ও রফতানি অনুগামী সংস্কার প্রয়োজন হবে বিনিময় হারে। বিনিময় হার কৃত্রিম ভাবে উপরের পর্যায়ে ধরে রেখে সময়ব্যাপ্ত প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক পরিসরে নিট রফতানি আয় বাড়ানোর কার্যক্রমে আসবে সমযোপযোগী সংস্কার। ২০২১-২০৪১ সালের প্রক্ষেপিত উন্নয়ন অর্জন করতে হলে প্রয়োজন হবে ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের। এই লক্ষ্যে ২০২০ সালের মোট বিনিয়োগের হার জাতীয় আয়ের ৩২.৭৬% থেকে ২০৩১ সালে ৪৩.১৫% এবং ২০৪১ সালে ৪৬.৯% এ উন্নীত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে ২০২০ সালের মোট জাতীয় আয়ের ৩১.৩১% থেকে জাতীয় সঞ্চয়ের হার ২০৩১ সালে ৩৭.১৮% এবং ২০৪১ সালে ৪৩.৯৫% এ উন্নীত করা। এই লক্ষ্যের সঙ্গে সাযুজ্য করে সরকারের রাজস্ব মোট জাতীয় আয়ের সমকালীন ১০.৪৭% থেকে ২০৩১ সালে ১৯.৫৫% এবং ২০৪১ সালে ২৪.১৫% এ উন্নীত করা হবে। তেমনি সরকারের ব্যয় জাতীয় আয়ের সমকালীন ১৫.৩২% থেকে ২০৩১ সালে ২৪.৫৫% এবং ২০৪১ সালে ২৯.১৫% ভাগে উন্নীত করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় দেশের রফতানি বৃদ্ধির হার ২০২১ এর বার্ষিক ৫% থেকে বাড়িয়ে ২০৪১ সালে ১১% এ উঠিয়ে আনা হবে। তেমনি বাড়ানো হবে উন্নয়ন সহায়ক আমদানি। পরিকল্পনাকারীদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী ২০৩১ ও ২০৪১ সালে সর্বক্ষেত্রে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের প্রক্ষেপিত ব্যাপ্তি বাড়াতে হলে প্রয়োজন হবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনের এবং বিতরণের প্রসারন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের মোড়কে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালে দেশের বিদ্যুত উৎপাদন ৫০০০ মেগাওয়াট হতে ২১০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়েছে। ২০২১-৪১ সালের মধ্যে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ২০৩১ সালে ৫৪,৯৫০ মেগওয়াট ও ২০৪১ সালে ১১৫,৫১৪ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে। এর মধ্যে ব্যক্তি খাতে উৎপাদিত হবে ২০৩১ সালে ৪০০০ মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালে ৯০০০ মেগাওয়াট। ২০৪১ সালে উৎপাদিত সব বিদ্যুতের ২৫% গ্যাস, ২৫% কয়লা, ১০% পরমাণবিক এবং ৩৫% নবায়নযোগ্য উৎসভিত্তিক হবে। ২০৪১ সালে দেশ ১০০% বিদ্যুত ও জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জন করবে বলে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে প্রক্ষেপিত উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে (১) অসহায়ক কৃষি পরিবেশ ব্যবস্থাকে উৎপাদনশীল ও টেকসই কৃষি কার্যক্রমের আওতায় আনয়ন, (২) ভূমি-স্বাস্থ্য রক্ষণক্ষম উৎপাদনশীল কৃষি জমিতে ফসল চাষের নিবিড়তা বাড়ানো, (৩) নতুন জমি প্রযুক্ত না করে ইতোমধ্যে চাষের আওতায় আনীত জমির টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেয়া, (৪) জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে ফসল, মাছ ও গবাদী পশুর উৎপাদন বাড়ানো, (৫) কৃষি ও পশু পালনে এবং মাছ উৎপাদনে বহুমুখিতা আনয়ন ও প্রসারন এবং (৬) জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি নিরোধক কার্যক্রম বিস্তারনকে লক্ষ্য করে কৃষি ও সামাজিক ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় গ্রহণ করা হয়েছে। এই সকল ক্ষেত্রে উচ্চ ফলনশীল বীজ, উৎপাদনধর্মী প্রক্রিয়া, লাগসই প্রয়োগশৈলী এবং ফলপ্রসূ বিপণনের অবকাঠামো উদ্ভাবনের ও প্রয়োগকরনের জন্য গবেষণায় যথার্থ গুরুত্ব দেয়া হবে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় ২০২০ এ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৩৩% থেকে শিল্প উৎপাদন ২০৩১ এ ৪০% ভাগে উন্নীত হবে বলে প্রক্ষেপিত হয়েছে। ২০৩১ থেকে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদে সেবা খাতের অংশ বেড়ে ৬২% এ উন্নীত হবে এবং ফলত শিল্প উৎপাদন পরিমাণের নিরিখে ক্রমাগত বাড়বে, কিন্তু শতকরা হিসেবে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে শিল্পের অবদান ৩৩% নেমে আসবে বলে ধরা হয়েছে। শিল্প খাতে এরূপ উন্নয়ন ও বিবর্তনের জন্য প্রয়োজন হবে (১) অনুকূল আন্তঃশিল্প সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যক্তি খাতে শিল্প উৎপাদন ক্ষমতা সৃজন ও বাড়ানো, (২) এ ধরনের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে মেয়াদী ঋণ ও সমমূলধন সরবরাহ (৩) যথাসংখ্যক শিল্প এলাকা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা, (৪) বিদ্যুত সরবরাহ, সড়ক ও রেল যোগাযোগ এবং বন্দরসহ অবকাঠামোমূলক সমর্থন বিস্তারন (৫) ক্ষুদ্র ও উদ্ভাবনশীল শিল্প স্থাপনে ঝুঁকি মূলধন সরবরাহ করা (৬) উৎপাদন অনুকূল রফতানি ও বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন ও অনুসরণ, (৭) শিল্প গবেষণা ও উদ্ভাবন উৎসাহিতকরণ এবং (৮) দক্ষ ও আত্মনির্ভরশীল জনশক্তি সৃজন। প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় উন্নয়নের সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রাপ্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষ্য। ২০৪১ এর মধ্যে দারিদ্র্যকে পূর্ণমাত্রায় পরাভূত করার জন্য এই পরিকল্পনায় (১) সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে উৎপাদনশীল ও দক্ষ জনশক্তির সৃজন এবং মেধা ও অধ্যবসায়ের জোরে আর্থ-সামাজিক সকল ক্ষেত্রে সবার জন্য উপরে ওঠার সিঁড়ি উন্মুক্ত করা, (২) সকল সক্ষম ব্যক্তির জন্য লাভজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাকরণ, (৩) সামাজিকভাবে সাধারণ কর্ম ও সমাজ জীবনের এখনও বাইরে অস্তিত্বমান জনগোষ্ঠী, উদাহরণত উপজাতীয়, দলিত, বেদে, যৌন কর্মীদের মূল জীবনধারায় অন্তর্ভুক্ত করা, (৪) ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে উদ্ভাবনশীল উদ্যোগীদের ঋণ ও সমমূলধন জোগান দেয়া এবং (৫) বৃদ্ধ, বিকলাঙ্গ, অসুস্থ বা স্বাভাবিক আয় অর্জনে অক্ষম সকল ব্যক্তির অনুকূলে ন্যূনতম সহনীয় মানের জীবনযাপনের জন্য অনুদান ও সহায়কী প্রদান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব লক্ষ্য অর্জনে সরকার যথার্থ পুনর্বণ্টনধর্মী রাজস্ব আয় ও ব্যয়নীতি অনুসরণ করবে বলে বিধান দেয়া হয়েছে। ২০২১-২০৪১ এর প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচকতা রোধকরণকে অন্যতম অভীষ্ট হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই অভীষ্ট অর্জন ক্রমে (১) পরিবেশ রক্ষাকরণের ব্যয় বা বিনিয়োগ সামষ্টিক অর্থ-ব্যবস্থার এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে গ্রহণ, (২) ইতোমধ্যে অনুমোদিত বদ্বীপ পরিকল্পনাকে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তকরণ, (৩) দেশের সর্বত্র বায়ু ও পানিকে দূষণমুক্ত রাখা, (৪) জীবাশ্ম তেলের ব্যবহার কমানো এবং (৫) শিল্প উৎপাদন থেকে উৎসারিত বায়ু ও পানি দূষণের ওপর কর আরোপণ এবং এই সকল ক্ষেত্রে ব্যক্তি উদ্যোগকে সংশ্লিষ্টকরণকে শনাক্ত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সমুজ্জল সক্ষম জনগোষ্ঠীর সৃজন উৎসারিত জনমিতিক লভ্যাংশ বা ডিভিডেন্ড অর্জন প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাধীন সত্তায় সকল নাগরিকের সমৃদ্ধি অর্জন রাষ্ট্র সৃজনের মৌল কারণ ও উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে (সংবিধানের প্রস্তাবনা)। এই উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্য হিসেবে পরিকল্পিত বিকাশের মাধ্যমে সকল নাগরিকের অনুকূলে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষার বিস্তারন ও যুক্তিসঙ্গত বিনোদনের ব্যবস্থাকরণকে সুনির্দিষ্টভাবে গ্রহণ করা হয়েছে (সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ)। ২০২১-৪১ এর প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় সংবিধানের এই অনুজ্ঞা ও নির্দেশনা সুনির্দিষ্ট ভাবে রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য ও প্রচেষ্টা হিসাবে গৃহীত হয়েছে। বিশেষত সমৃদ্ধি অর্জনের সঙ্গে আর্থিক ও সামাজিক সমতা স্থাপন এবং সামাজিক নিরাপত্তা অর্জনকে সুনির্দিষ্টভাবে ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বাঁধনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় দেশের ১ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামাজিক ন্যায় ও সমতা স্থাপন অবিচ্ছেদ্য অবয়বে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে স্বৈরশাসনের অশুভ প্রভাবে ১৯৯৬ পর্যন্ত এই দিকে যথা ঈপ্সিত দৃষ্টি দেয়া হয়নি। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সঠিক ও বাস্তবধর্মী নীতি নির্দেশনায় প্রণীত ৫ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এই দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তা আবার দূরে সরিয়ে স্বৈরশাসনের অপরিশীলিত ধনতান্ত্রিক এবং জনকল্যাণবিমুখ তৎপরতাকে স্থান দেয়া হয়েছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় প্রণীত ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক অনুমোদিত আর্থ-সামাজিক সমন্বিত পরিকল্পনার লক্ষ্য ও তা বাস্তবায়নের সংবেদনশীল প্রক্রিয়া আবার স্থান পেয়েছিল। ২০৪১ সালের মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম বিত্তশালী দেশে সার্বিকভাবে জনকল্যাণমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠাকরণের জন্য প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ জাতীর দৃঢ়সংকল্প এবং এই সংকল্প বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিতভাবে কার্যকর আর্থসামাজিক প্রক্রিয়া প্রযুক্তকরণের বিশ্লেষণকামী দলিল। ২০০৮ থেকে ২০২০ সাল অবধি অর্জিত আর্থ-সামাজিক প্রগতির ভিত্তিতে ২০৩১ ও ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে সত্যিকারের পূর্ণাঙ্গ সোনার বাংলায় রূপান্তরের এই হয়েছে জাতিগতভাবে গৃহীত দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। এই পটে ২০২১-৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা দেশের সুদূরপ্রসারী আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বস্তুনিষ্ঠ রূপরেখা হিসেবে মুজিব শতবার্ষিকীতে মুজিব কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির জন্য শ্রেষ্ঠতম উপহার। শেখ হাসিনা প্রদত্ত মুজিববর্ষের এই শ্রেষ্ঠতম উপহারের যোগ্য হিসেবে প্রতিভাত করতে হলে অন্তত ৩টি ক্ষেত্রে জাতিকে সফলতার সঙ্গে ২০২১-৪১ এর প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এক, প্রেক্ষিত পরিকল্পনার দর্শন ও রূপরেখা অনুযায়ী যথাযথ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আন্তঃখাত সম্পর্কসমূহ সুচারুভাবে শনাক্ত করে ১৯টি বার্ষিক ও ৪টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এখন থেকেই হাত দিতে হবে। ইতোমধ্যে প্রণীত বদ্বীপ পরিকল্পনা এই প্রক্রিয়ায় সমন্বিত করতে হবে। প্রক্ষেপিত উন্নয়নের হার বাড়াতে হলে তর্কাতীতভাবে জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগকে প্রক্ষেপিত হারে ও মাত্রায় বাড়াতে হবে। বার্ষিক ৫.৫% হারে বিদ্যমান মুদ্রাস্ফীতির পটে ব্যাংক ব্যবস্থা কর্তৃক সাম্প্রতিক কালেসাধারণ সঞ্চয়ের ওপর প্রদানীয় বার্ষিক ৬% সুদ বা ফিরতি সর্বজনীন সঞ্চয়ের বিপরীতে প্রাপ্য লাভ ঋণাত্মক করে তুলবে। এই পটভূমিকায় দেশের সার্বিক সঞ্চয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় প্রক্ষেপিত হারে উঠানো সহজ হবে না। এই বিবেচনায় সাধারণ সঞ্চয়ের বিপরীতে প্রকৃত ফিরতির ঋণাত্মকতা সংশোধন করতে হবে এবং এর সাথে সমন্বয় করে শেয়ার বা মূলধন বাজার থেকে আহরণীয় সঞ্চয় বাড়ানো, আমদানি-রফতানির অধি ও অধমূল্যায়ন রোধকরণ, দেশ থেকে অবাধে অর্থ পাচার নির্মূলকরণ, বিনিময় হারকে ভর্তুকি বিহীনক্রমে সংশোধন এবং দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যথার্থ পদক্ষেপ নিতে হবে। এসবের সঙ্গে প্রয়োজন হবে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হাতিয়ার সমূহের সংখ্যা ও শৈলী বাড়ানো, খেলাপী ঋণ উৎসারিত শ্লথতাকে সংশোধনের জন্য আরও সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান সৃজন এবং মূলধন বাজার সংস্কার, বিশেষত মিউচুয়াল ফান্ড বা পারস্পরিক তহবিলের ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান। সরকারের আয় ও ব্যয়ের সংস্কারকরণের প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সরকারের রাজস্ব আয় ও ব্যয় যোগ ও বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সরকার বা রাষ্ট্রের সম্পদ লভ্যতা ও ফলপ্রসূতা বাড়াতে হবে। তেমনি প্রয়োজন হবে সরকারের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক রাজস্বের প্রকৃতি ও হার সংশোধন। এই প্রয়োজন ও প্রক্রিয়া শনাক্তকরণের বিষয়ে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বিস্তারিত বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ভিত্তিক দিক নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন হবে। দুই, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার সমন্বিত যাত্রা ও কার্যক্রম প্রণয়ন ও সফল করার জন্য প্রয়োজন হবে সামাজিক প্রকৌশলীয় বিধানপত্র। এই ক্ষেত্রে দায়িত্ব বিস্তৃত ও বিশদভাবে পালন করার জন্য প্রথাগত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামাজিক পরিকল্পনাকে গ্রন্থিত করে পর্যায়ক্রমিক সমন্বিত পদক্ষেপ সমূহ শনাক্তকরণ এখনই প্রয়োজন। এই পটে প্রথাগত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে গ্রহণীয় সামাজিক পদক্ষেপগুলো সময়বদ্ধভাবে সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টিতে নিয়ে আসতে হবে। এই ক্ষেত্রে অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে প্রয়োজন হবে শিক্ষার সকল পর্যায়ে মানোন্নয়ন এবং কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ এবং শিক্ষা পদ্ধতির আওতায় দেশের ও দশের অনুকূলে কাজ করার মূল্যবোধ সৃজন। এই দায়িত্ব পালনে এখনই অধিকতর সচেতন না হলে ২০২১-৪১ এর প্রেক্ষিত পরিকল্পনার সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও সফলতা সংবিধানে গৃহীত পরিকল্পিত আর্থ-সামাজিক বিকাশের দর্শন অনুগামী পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় বাস্তবায়নক্ষম থাকবে না। তিন, বিচার বিভাগের ব্যবস্থাপনা ও তৎপরতাকে জনগণের সম্পত্তির অধিকার দৃঢ়তার সঙ্গে বলবৎকরণ এবং সম্পত্তি ও আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত বিবাদাদির দ্রুত ও স্বল্পব্যয়িক নিম্পত্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। এ না হলে ব্যক্তি উদ্যমভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকা- ঈপ্সিত মাত্রায় প্রসারিত হবে না। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন, উন্নয়ন ও জনকল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে অধিকতর শাণিত করতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উপজেলা পর্যায়ে (জাতীয়কৃত শিক্ষাব্যবস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক ও চিকিৎসকদের বাইরে) গড়ে ৪০ জন প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা বিদ্যমান। গড়ে একটি উপজেলার আয়তন ৮০ বর্গমাইল ধরে নিলে বলা চলে যে প্রতি ২ বর্গমাইল এলাকায় উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধনে ১জন ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা এদেশে নিয়োজিত আছেন। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের এরূপ ঘনত্ব বা নিবিড়তা নেই। এদেরকে তাদের প্রথাগত বিভাগীয় দায়িত্বের বাইরে সাধারণ ভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বা কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান এবং জনগণকে প্রগতি ও সমতার পথে নিরন্তর সন্দীপনীয় অনুশাসন দেয়ারও দায়িত্ব দেয়া ২০২১-২০৪১ এর প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সাম্যভিত্তিক প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠাকরণে লক্ষণীয় অবদান রাখবে। লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য
×