ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাঁর জন্মদিনে ফিরে পাই বাংলাদেশকে

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 তাঁর জন্মদিনে ফিরে পাই বাংলাদেশকে

কত বছর অপেক্ষা, একা পথচলা, স্বপ্ন বোনা, স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়া, আবার নতুন করে স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা, আবার অপেক্ষা, আবার পথচলা। এই অনুভূতিগুলো আমাদের সব শহীদ পরিবারের। একেকটা পরিবারের বেঁচে থাকার যুদ্ধ, বেঁচে থাকার গল্প একেক রকমের। ছোটবেলায় রংতুলির সঙ্গে গড়ে ওঠার সখ্যে রংতুলির মধ্যে বাবাকে খুঁজতাম। সেই সবুজ আর লাল, সেই দিগন্তের সবুজ অথবা নীল গাঢ় অথবা পাল তোলা নৌকায়। অথবা, মার আঁচলে গন্ধ নিতাম বাবার। সেই তিন তলা দাদির বাড়িতে প্রত্যেক ছুটির দিন মা আমাদের নিয়ে যেতেন। আমার ফোলা আঙ্গুলগুলোয় চোখ বুলিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতেন দাদি। খুঁজতেন বাবাকে। আমিও রংতুলির মাঝে অথবা কায়েৎটুলির সেই দিনটিতে অথবা দাদির গায়ের গন্ধে বাবাকে খুঁজে পেতাম। বড় হতে হতে খেলাঘরের হয়ে গান গাওয়া, নাচ করা অথবা সাহিত্য বাসরে নিজের লেখা– এর মধ্যেও অনুভব করতাম বাবার উজ্জ্বল উপস্থিতি। কিন্তু এই আমি যখন দেখতাম বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হয় না, যখন নৌকা কেন এঁকেছি বলে স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের লোকজন বাড়িতে এসে প্রশ্ন করে... সেই ৭৭/৭৮ সালের কথা... তখন যেন বাবাকে হারিয়ে ফেললাম। এই দেশে বঙ্গবন্ধুর কথা বললে অপরাধ হবে অথবা নৌকা আঁকলে একটি অবুঝ শিশুকেও ভয় দেখানো হবেÑ এই দেশ তো বাবার না! তাহলে? কিন্তু যখন এই আমি বাংলাদেশের পালতোলা নৌকা আর গ্রামের ছবি এঁকে শঙ্কর পুরস্কার পেয়েছিলাম- তখন আবার মনে হলো বাবাকে খুঁজে পেলাম আমার আঁকা ছবিতে। আরেকটু বড় হয়েÑ ১৯৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে মিছিলে যাওয়া, গণতন্ত্র অভিযাত্রায় যাওয়া, ডাঃ মিলন হত্যার প্রতিবাদে টিএসসি চত্বরে কবিতা আবৃত্তি করাÑ আবার বাবাকে খুঁজে পাওয়ারই প্রয়াস। ১৯৯১ সালে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আয়োজনে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ডাকে বায়তুল মোকাররমের সেই বিশাল জনসভায় বক্তৃতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামাÑআবারও বাবাকে খোঁজার চেষ্টা। ১৯৯৩ সালের ১৫ আগস্ট ভাষাসৈনিক গাজিউল হকের হাত ধরে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে প্রথম বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চাওয়ার মধ্যেও বাবাকে খোঁজার চেষ্টা। বক্তব্যের পর সেদিনের বিরোধীদলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার অপার স্নেহে আবার বাবাকে খুঁজে পাওয়া। এভাবেই চলে আমার বাবাকে হারানো আর খুঁজে পাওয়ার বিরামহীন পথচলা। সেদিন খালেদা জিয়ার সরকারে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী মন্ত্রী হয়, সংখ্যালঘুদের ওপর ন্যক্কারজনক অত্যাচারÑহত্যা হয়, কবি হুমায়ুন আহমদকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হয়। আমার অভিনয় নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়। তখন বাংলাদেশ আমার চোখে ঝাপসা হয়ে আসে। আমি বাবাকে হারিয়ে ফেলি। লাল-সবুজ আর লাল সবুজ থাকে না আমার কাজে। সেদিন সত্যিই বাবাকে খুঁজে পেলাম যেদিন বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায় হলো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো, গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল ঘোষণা হলো। সেদিন বাংলাদেশ আর আব্বু আমার কাছে সুস্পষ্ট। আমি তখন স্পষ্ট দেখতে পাই বাবাকে। আমি দেখতে পাই মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর গল্প বলার মধ্য দিয়ে, আমি দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু কন্যার চোখ দিয়ে, আমি দেখতে পাই শহীদ পরিবারগুলোর যুদ্ধে দাঁড়াবার গল্প দিয়ে, আমি দেখতে পাই সত্য ইতিহাস পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। আমাদের গানে, কবিতায়, চলচ্চিত্রে, নাটকে আবার আমি খুঁজে পাই বাংলাদেশকে। আমি খুঁজে পাই বাবাকে। তাঁর চুরানব্বইতম জন্মদিন পর্যন্ত কত অপেক্ষা ছিল এই খুঁজে পাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিরামহীন ...পথ চলার। আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশ আমার কাছে স্পষ্ট। তরুণ প্রজন্ম এখন বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাসকে হৃদয়ে ধারণ করে, জাতির পিতার প্রতিকৃতি তাদের চেতনায় স্পষ্ট। শহীদের আত্মত্যাগে তারা বাংলাদেশকে খুঁজে পায়। তাই এখন আমিও এই বাংলাদেশে বাবাকে খুঁজে পাই। খুঁজে পাই ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে। আজকে শহীদুল্লাহ কায়সারের চুরানব্বইতম জন্মদিনে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, সঠিক অর্থেই নারীর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হচ্ছে। আজ আর সারেং বৌ-এর মতো অথবা সংশপ্তকের হুরমতির মতো নারীকে আগের মতো নির্যাতনের শিকার হতে হয় না। যদিও কিছু কিছু বাল্যবিবাহ এখনও হচ্ছেÑ কিন্তু তা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। পুষ্টির মান বেড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় এসে তরুণ-তরুণীরা নিজের জীবনের মান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশকে নিয়ে ভাবছে- আজকে লাল সবুজ পতাকা সত্যিই শহীদের রক্তের লাল আর দীগন্ত সবুজের মানে খুঁজে পায়। সারেং বৌ-এর সেখানে শেষ। হুরমতি আর সারেং নতুন জীবনের সন্ধানে পথ হাঁটা শুরু করে। অথবা, সংশপ্তকের শেষে যেখানে দেশবাসী জাহেদকে খুনীরা ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় উচ্চারণ করছিল ‘আমি আসবো, আমি আসবো ফিরে, আবার আসবো’ এখন মনে হয় এই সেই বাংলাদেশে আমরা আজ দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার যাত্রায় শামিল। নতুন প্রজন্মের ভেতর দিয়েই ফিরে আসছে শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী অথবা জহির রায়হান। তাই আজ শহীদুল্লাহ কায়সারের জন্মদিন মানে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার আদর্শ উন্মোচিত এবং আলোকিত। ’৭৫-এর পর যে বাংলাদেশ আমার কাছে ছিল অস্পষ্ট, ৮০-এর দশকে সে বাংলাদেশে স্কুলে পড়ার সময় বাবাকে স্পষ্ট করে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। স্কুলের পাঠ্যবইতে কোন রকমে বাবার নাম লেখা হবে। আর বঙ্গবন্ধুর নাম লেখা ছিল মহা অন্যায়। অথবা, ১৯৯২-এর বাংলাদেশকে উল্টোপথে ঘুরিয়ে নিয়ে বাঙালীর সঠিক ইতিহাস বিকৃত করে তার আত্মমর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, জাহানারা ইমামকে দেশদ্রোহী অপবাদ দেয়া, বঙ্গবন্ধু কন্যাকে নিয়ে রাজনৈতিক মিথ্যাচারে ক্ষত-বিক্ষত করা, শহীদ পরিবারগুলোকে করুণার চোখে দেখাÑ সব কিছুতেই অস্পষ্ট ছিল বাংলাদেশ আর বাবা আমার কাছে। আমি বার বার বাবার স্পষ্ট অবয়ব খুঁজেছি। বর্তমানে অশান্তিতে পথ চলি, যন্ত্রণাকাতর রাত্রি আর নেই। নেই অশ্রুসিক্ত ক্লান্ত চোখ। আজ আমার ভাষা, আমার দেশ, আমার পতাকা, আমার গান, আমার চলচ্চিত্র- আমার চোখ অনেক স্পষ্টভাবে দেখতে পায় অনেক বিজয় ও আত্মবিশ্বাস। আজকে বাবার জন্মদিনে আমি তাঁর রেখে যাওয়া সোনার বাংলাদেশে পথ চলি মাথা উঁচু করে। যন্ত্রণা আর কষ্ট জয় করে সামনে পথ চলার শক্তি পাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায়। যে সোনার বাংলার সোনালি দিগন্ত আমার দু’চোখে সুস্পষ্ট। শহীদুল্লাহ কায়সার মৃত, কিন্তু বিমূর্ত। তাঁর অবয়ব আমি স্পষ্টত খুঁজে পাই মুজিববর্ষের প্রতিটি ধ্বনি, প্রতিধ্বনিতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশে। লেখক : অভিনয়শিল্পী
×