ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাছেরও আছে বিস্ময়!

প্রকাশিত: ১০:০০, ২৪ জানুয়ারি ২০২০

মাছেরও আছে বিস্ময়!

আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগে মাছেরও পা ছিল এবং মাছ পানি ও ডাঙ্গা উভয় স্থানেই বাস করতে পারত। এ রকম একটি তথ্য বেরিয়ে এসেছে বিজ্ঞানীদের গবেষণায়। তারা কানাডার আর্কটিক অঞ্চলের একটি দ্বীপে প্রায় ৪০ কোটি বছর আগের মাছ জাতীয় একটি প্রাণীর ফসিল উদ্ধার করেছেন। ফসিলটির বৈশিষ্ট্য হলো- এটি সম্পূর্ণভাবে মাছও নয়, আবার উভচরও নয়Ñ দু’য়ের মাঝামাঝি। এর শরীরে আঁশ আছে এবং মুখের নিচের চোয়ালটি দেখতে ঠিক মাছের মতো। তবে এর ঘাড় ও কান উভচর প্রাণীদের মতো। এদের হাতের কব্জির মতো অঙ্গও আছে, কিন্তু আঙ্গুলের কড়া নেই। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, দীর্ঘ বিবর্তন প্রক্রিয়ায় মাছের পা গজায় এবং পানির ভেতর থেকে মাথা উঁচু করে শ্বাস নেয়ার জন্য এরা সেই পা ব্যবহার করত। তবে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলেও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, আজ থেকে ৪০ কোটি বছর আগেই পৃথিবীতে উভচর প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। অন্যদিকে পশ্চিম আফ্রিকার গ্রীষ্মম-লের এক কর্দমাক্ত জলাভূমিতে ‘চ্যানেলাবাস ওপাস’ নামে ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার লম্বা এক ধরনের ক্যাটফিসের সন্ধান পাওয়া গেছে। ছোট একটি মাথা এবং নমনীয় দেহের এ মাছটি দেখতে অনেকটা বাইন মাছের মতো। এ মাছটি পানি থেকে লাফ দিয়ে নিজেই ওপরে ওঠে আসতে পারে এবং চোয়াল দিয়ে পোকামাকড় ধরার জন্য মাথা বাঁকাতে পারে। এটি প্রধানত গোবরে পোকা খায় এবং ডাঙ্গা ছাড়া অন্য কোথাও যায় না। বেলজিয়ামের একদল গবেষক আরও ব্যাপক গবেষণার জন্য মাছটিকে নিয়ে যান এবং এ্যাকুরিয়ামে প্রতিস্থাপন করেন। এখানে মাছের জন্য শিকার রাখা হয়। একসময় দেখা যায়, ক্ষুধার তাড়নায় মাছটি পানির ওপর লাফিয়ে উঠছে এবং মাথাটি বাঁকা করে শিকার হিসেবে রাখা পোকাটিকে খুব সহজেই ধরে ফেলছে। মাছটির শরীরে পরিবর্তন উপযোগী শিরদাঁড়া বা মেরুদ- রয়েছে যা মাথা বাঁকানোর জন্য এটিকে অতিরিক্ত নমনীয়তা দিয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা আশা প্রকাশ করছেন, গবেষণার মাধ্যমে অবশ্যই বেরিয়ে আসবে ৪শ’ কোটি বছর আগে মাছের কি সত্যিই পা ছিল অথবা মাছ সত্যিই ডাঙ্গায় বাস করে টেট্রোপতে পরিণত হয়েছিল কিনা। মাছ কথা বলে নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডের সমুদ্র বিজ্ঞানী শাহরিমান গাজালি গবেষণা করে এক চমকপ্রদ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মাছ শুনতে পায় এবং কথা বলতে পারে। আশপাশে কোন শব্দ হলেই মাছকে দৌড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে দেখা যায়। মাছ শব্দ তৈরি করতে না পারলেও সবই শুনতে পায় এবং সাঁতার কাটার সময় পাখনা দিয়ে কম্পন সৃষ্টি করে যোগাযোগ স্থাপন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাছেরা ঘোঁতঘোঁত ও কিচিরমিচিরজাতীয় বিভিন্ন রকম শব্দ করে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিপরীত লিঙ্গের মাছকে আকর্ষণ, শিকার হওয়ার ভয় বা আতঙ্ক, সতর্কতা জারি অথবা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে মাছ আলাদা আলাদা শব্দ ব্যবহার করে। তবে সব মাছই কথা বলতে পারে না, কিন্তু শুনতে পায়। আর সব মাছই শব্দ করতে পারে না। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের মধ্যে কিছু প্রজাতির মাছ শব্দ করে যোগাযোগের কাজটি করে থাকে। যেসব মাছ শব্দ করতে পারে তারা তাদের সুইম ব্লাডার অর্থাৎ সাঁতার সহায়ক থলির পেশিতে কম্পন সৃষ্টি করে শব্দ নির্গত করে এবং এর মাধ্যমেই পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। গারনার্ড প্রজাতির মাছের বড় ধরনের বাগযন্ত্র রয়েছে এবং তারা একে অন্যের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, কড মাছ সাধারণত নীরব থাকে। তবে ডিম ছাড়ার সময় তারা ঠিকই কথা বলে অর্থাৎ শব্দ করে। পুরুষ ও স্ত্রী কড মাছ উভয়েই যাতে একত্রে ডিম ছাড়তে পারে, সেজন্য তারা উভয়েই একত্রে একই সুরে একই ধরনের শব্দ করে। আবার ড্যামজেল ফিশের মতো কিছু প্রবাল জাতীয় মাছ শিকারী বা ভয়ঙ্কর কোন মাছের আগমনের শব্দ শুনলেই শব্দ করে স্বজাতিদের পালাতে বা ডুব দিতে সতর্ক করে দিয়ে থাকে। সমুদ্র বিজ্ঞানী গাজালি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পর্যবেক্ষণ করে এবং নানা ধরনের শব্দ তৈরি করে মাছের যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টির প্রমাণ পেয়েছেন এবং নিশ্চিত হয়েছেন যে, ছোট প্রজাতির অনেক মাছই বিভিন্ন রকম শব্দ করে এবং অব্যাহতভাবে সেই শব্দ চালিয়ে যায়। অন্যদিকে, সমুদ্রের গভীরের বৃহৎ আকারের মাছ প্রজননকাল ছাড়া সবসময়ই নীরব থাকে। মাছেরও উদ্দীপনা আছে মাছের মস্তিষ্কে জিনের দ্রুত পরিবর্তনে এক মিনিটের মধ্যে মাছের উদ্দীপনা তৈরি করে। আফ্রিকার ‘সিচিল্ড ফিশ’ নামে এক ধরনের মাছ স্তরীভূতভাবে বসবাস করে। এদের চলাফেরা এবং দৈহিক সৌন্দর্য রহস্যময় এবং অসাধারণ। এই প্রজাতির একটি পুরুষ সক্রিয় মাছ সহজেই একটি নিকৃষ্ট বা গৌণ পুরুষ মাছকে পুনরায় সক্রিয় করে তুলতে পারে। নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটির মিস সাবরিনা বারমেইস্টার এবং তার সহকর্মীরা বিভিন্ন সময়ে ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং গবেষণা করে তথ্যটি সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়েছেন। তারা এ্যাকুরিয়ামে একটি সক্রিয় এবং একটি নিষ্ক্রিয় পুরুষ মাছকে প্রথমে একত্রে রাখেন। কিছু সময় পরে তারা লক্ষ্য করেন, এ্যাকুরিয়ামে রাখা সেই মাছ দু’টোর মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ্যাকুরিয়াম থেকে সক্রিয় পুরুষ মাছটিকে বের করার পর তারা দেখতে পান যে, মাত্র এক মিনিটের মধ্যে এ্যাকুরিয়ামে থাকা নিষ্ক্রিয় বা নিকৃষ্ট পুরুষ মাছটি নি®প্রভ অর্থাৎ অনুজ্জ্বল সবুজ রং পরিবর্তন করে উজ্জ্বল নীল অথবা হলুদ রং ধারণ করেছে। শুধু তা-ই নয়, দৈহিক রং পরিবর্তনের পাশাপাশি মাছটির মস্তিষ্কও পরিবর্তিত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, মস্তিষ্ক পরিবর্তনের পাশাপাশি মাছটির দৃষ্টিশক্তি বা চোখের দিকের আয়তনও আটবারের বেশি সময় ধরে আগের চেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে অর্থাৎ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। শুধু তাই নয়, একত্রে থাকার কারণে মাছগুলোর উত্তেজক-হরমোনের অভাব পূরণ হয়েছে, বিচারবুদ্ধি পরিপুষ্ট হয়েছে ও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শুক্র উৎপাদন ক্ষমতাও অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে একটি জিনের ওপর। মাছ ঠেকাবে দূষণ বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বিজ্ঞানীরা এ রকম একটি মাছের সন্ধান পেয়েছেন যেটি আগে থেকেই পানি দূষণের তথ্য দিয়ে সতর্ক করে দিতে পারবে। মাছটির সাধারণ নাম হচ্ছে ‘রাইস ফিশ’। হাল্কা কমলা রঙের এ মাছটি দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের পাবদা মাছের মতো। পূর্ণবয়স্ক একটি রাইস ফিশের দৈর্ঘ্য এক থেকে দেড় ইঞ্চি অর্থাৎ আড়াই থেকে তিন সেন্টিমিটার। লোনা পানিতে ঠা-ায় জমে যাওয়া চিংড়ি মাছ এবং যে কোন কিছু এরা খাবার হিসেবে পছন্দ করে। রাইস ফিশ কখনও কখনও মাটির ওপর থেকে এক ধরনের পাতলা পর্দা বা আঁশও খায়। মজার ব্যাপার হলো, এরা সাধারণত ১২ থেকে ১৪ দিন পর পর ডিম পাড়ে। জাপানে অনেকেই এই সুন্দর মাছটিকে বাড়িতে পুষে থাকেন এ্যাকুরিয়ামে। বিজ্ঞানীরা রাইস ফিশ নিয়ে এক বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ করেছেন। যদি কখনও পানি সরবরাহ অনিয়মিত এবং দূষিত হয়, তবে মাছটি কর্তৃপক্ষকে আগে থেকেই সতর্ক করে দিতে পারবে। অর্থাৎ মাছটির মাধ্যমে পানি দূষণের ব্যাপারে সাবধান হয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে। পানি দূষণ সম্পর্কে রাইস ফিশের এই অগ্রিম সতর্ক সংকেত দেয়ার বিষয়টি প্রথমে ধরা পড়ে টোকিওর দক্ষিণে সিজুয়োকো এলাকায়। পানি দূষিত হলে এ মাছটির আচরণে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, দূষিত পানিতে রাইস ফিশ পানির উপরিভাগে নাক তুলে সাঁতার কাটতে থাকে। তাদের নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয়, এমনকি মরেও যেতে পারে। পানি দূষণ রোধে মাছ ব্যবহার প্রকল্পের কর্মকর্তা মিতসুইয়োসি হোরি বলেন, পানি পর্যবেক্ষণের এ প্রক্রিয়া অত্যন্ত কার্যকর। এর কারণ হচ্ছে, মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যেই এই মাছের মাধ্যমে পানি দূষণ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণও সহজ এবং সম্ভব হবে।
×