ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জনক ফিরে এলেন

প্রকাশিত: ১০:১২, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

জনক ফিরে এলেন

বর্ষণসিক্ত আগস্ট মাস। থেমে থেমে আগে দুইবার হালকা বৃষ্টি হয়েছে। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। এখন আবার টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের টিনের চালের ওপর পড়ে সেই বৃষ্টির আওয়াজ হাসানের মনটাকে বেশ ভার করে দেয় অজানা কারণে। হাসান শুয়ে শুয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটা পড়ছিল। গতকালই সে বাংলা একাডেমির বিক্রয়কেন্দ্র্র্র থেকে কিনে এনেছে এটি। বেশ আলোড়ন করা বই। এই বইটিই জাতির জনকের জীবন দর্শনের অন্যতম প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা ডায়েরিকে বইয়ের আদল দেয়া হয়েছে। বইটির অর্ধেক পড়া শেষ হয়েছে হাসানের। পাড়ার ক্লাবঘরে বেশ জোরে মাইকে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণটা বাজছে- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম! আর কিছুক্ষণ পরেই ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৫ আগস্ট শুরু হয়ে যাবে! আহা, সেই ১৫ আগস্ট জনকের হত্যা দিবস, জাতীয় শোক দিবস! হাসান কেমন যেন ঘরের ভেতর চলে যায়! মনে হলো কেউ একজন তার শোবার ঘরের জানালায় মৃদু আওয়াজ তুলে ঠকঠক করছে। হাসান ভেবেছে হয়ত বাতাসের আওয়াজ। কিন্তু শব্দটা যখন আরও একবার হলো তখন বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালিয়ে জানালা খুলে বাইরে উঁকি দিল। দেখল আধাভেজা হয়ে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা দীর্ঘদেহী একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটির মুখে মৃদু হাসির আভা। তারপর হাসানকে অবাক করে দিয়ে বেশ ভরাট গলায় তিনি হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন- কী রে, এ রকম হা করে কী দেখছিস? চিনতে পারছিস না? আমি শেখ মুজিব! তাড়াতাড়ি দরোজা খোল, এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ভিজে তো জবজবা হয়ে গেলাম। কিন্তু হাসানের মুখ দিয়ে ভাল করে আওয়াজই বের হচ্ছিল না। বিস্ময়ে সে যেন বোবা হয়ে গেছে! তবু সে অস্ফুট উচ্চারণে বলল- বঙ্গবন্ধু! আপনি বঙ্গবন্ধু! এটা কী করে সম্ভব? আপনি আমার কাছে এলেন! বঙ্গবন্ধু হালকা ধমক দিয়ে বললেন- আরে গাধা, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? আমি কি তোর কাছে, তোর বাড়িতে আসতে পারি না? হা হা হা। দে দে এখন তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দে। হাসান এক লাফে বারান্দায় গিয়ে দরজা খুলে দিল। বঙ্গবন্ধু ভেজা শরীর নিয়ে এক ঝটকায় ঘরের ভেতরে চলে এলেন। হাসানকে বললেন- একটা গামছা দে, শরীরটা ভাল করে মুছে নিই। নয়ত জ্বর চলে এলে আরেক ঝামেলায় পড়ব। জ্বর আমার শরীরে একদম সহ্য হয় না। হাসান তার গামছাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল- ভাল করে গা-মাথা মুছে নিন। আমি লুঙ্গি দিচ্ছি, আপনি ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে আরাম করে বিছানায় উঠে বসেন। আমি আপনার জন্য চুলায় ভাত চড়িয়ে দিচ্ছি। বঙ্গবন্ধু হাতের ইশারায় বারণ করলেন। বললেন- আমার খিদে নেই। ঘরে চা থাকলে কড়া লিকারের এক কাপ আদা চা বানিয়ে আন। শরীরটা চাঙ্গা হোক। দুই রান্নাঘর থেকে দুই কাপ কড়া লিকারের চা বানিয়ে হাসান ঘরে ঢুকল। এদিকে বঙ্গবন্ধু বেশ আরাম করে দুই পা তুলে বিছানায় বসে আছেন। তার কোলের ওপর তারই সেই বইটি। তিনি হাত বাড়িয়ে হাসানের কাছ থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে বেশ লম্বা করে চুমুক দিলেন। বললেন- বাহ, চা’টা বেশ ভাল হয়েছে। আদা চা আমার খুব প্রিয়। হাসু কত যে আমাকে আদা চা বানিয়ে খাওয়াত! তারপর কাপটা বিছানার ওপর রেখে বইটার দিকে তাকিয়ে বললেন- আমার এই লেখা শুধু শুধু পড়ে কী লাভ যদি কেউ তা নিজের ভেতর ধারণ না করে! হাসান চুপ করে থাকে, তারপর অনুযোগ আর অভিমানের সুরে উত্তর দেয়Ñ আমি তো সামান্য একজন। আপনার দলের ভেতরের বড় বড় অনেক নেতাই তো এখন পর্যন্ত এই অমূল্য বইটির পাতা উল্টিয়েও দেখেনি! বঙ্গবন্ধু তার কালো তামাকের পাইপে ছোট একটা টান দিয়ে বলেন- জানি, জানি, আমি সবই জানি! আমি এখন যতটুকু আছি তা কেবল এদের মুখেই আছি, অন্তরে নেই! হাসান খুব সহজ ভঙ্গিতে চেয়ারটা টেনে বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হয়ে কিছুটা ঝুঁকে বসে। বঙ্গবন্ধুও আরাম করে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। হাসান গাঢ় গলায় বলল- আগামীকাল আমাদের জাতীয় শোক দিবস, আপনার শাহাদাতবার্ষিকী! বঙ্গবন্ধু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পাইপে লম্বা টান দিয়ে হাসেন- হুম, জানি! রক্তাক্ত আগস্ট, দুঃসহ বেদনার আগস্ট! তাঁর চোখের কোণ ভিজে গেছে। আনমনে বললেনÑ আবার আসিব ফিরে আমি আমার সোনার বাংলায়! তারপর কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললেন- আমি নেই, আমাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। জানিস, এর জন্য আমার বিন্দু পরিমাণ আক্ষেপ নেই! কিন্তু খুব কষ্ট হয়, আমার বুকটা ফেটে যায় যখন ভাবি- আমার কলিজার টুকরা, সাত রাজার ধন রাসেলকেও ওরা হত্যা করল! এরা কত জঘন্য, কত পাষ-! অথচ এদের চেহারা অবিকল মানুষের মতো, তাই না? ঘরে পিনপতন নিস্তব্ধতা! হাসানের চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। সে নীরবে বঙ্গবন্ধুর হাতের ওপর তার হাতটা রাখে। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। বঙ্গবন্ধু হাসানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন পরম মমতায়। তিন ১৫ আগস্টের সকাল। সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ। ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছে। ক্লাবঘরের মাইকে বাজছে সেই গানটা- ‘যদি রাত পোহালেই শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই......!’ হাসান যেন আবার ঘোরের ভেতর চলে যায়! তার মনে হলো বঙ্গবন্ধু আজ আবার ফিরে এলেন! তিনি বঙ্গভবনে না গিয়ে সরাসরি বত্রিশ নম্বরে চলে এসেছেন। তিনি যে আবার ফিরে আসবেন, আসতে পারেনÑ এটা কারও মাথায় একদমই ছিল না। কিন্তু তিনি আবার ফিরে এলেন এই দেশে, এই বাংলায়, এই মধ্য আগস্টের বৃষ্টিস্নাত ঢাকায়! বত্রিশ নম্বরে সংক্ষিপ্ত গার্ড অব অনার গ্রহণ করে তিনি দোতলায় চলে গেলেন দৃপ্ত পায়ে। পাইপে তামাক পুরে, ড্রয়ার থেকে দিয়াশলাই বের করে আগুন ধরালেন। আহা, কতদিন যে তাঁর এই প্রিয় তামাক আর পাইপ একাকী পড়েছিল এই টেবিলের ওপর! তিনি একে একে সবাইকে লাল টেলিফোন থেকে ফোন করলেন। সবার নম্বর তো তাঁর মুখস্থ। খন্দকার মোস্তাক, জেনারেল জিয়া, জেনারেল শফিউল্লাহ, ফারুক, রশিদ, ডালিম থেকে শুরু করে সবাইকে তিনি ডেকে পাঠালেন বত্রিশ নম্বরে। তিনি আরও যাদের প্রয়োজন মনে করলেন, আরও যারা সেদিনের ঘটনার সঙ্গে ছিল- সবাইকে ডেকে পাঠালেন। বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন পেয়ে প্রথমে কেউ বিশ্বাস করেনি গলার স্বর। কিন্তু ভয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এরা সবাই আসতে বাধ্য হলো বত্রিশ নম্বরে। তিনি দোতলার বারান্দায় সাদা ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবির ওপর মুজিবকোট পরে দাঁড়িয়ে আছেন। একে একে সবাই চোরের মতো, অপরাধীর মতো, বজ্রাহতের মতো, অভিসম্পাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো বত্রিশ নম্বরের বাড়িটির গেটের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল। তিনি এদের সবার এই অসহায় অবস্থা দেখে মনে মনে হাসলেন। তারপর ঘৃণার একদলা থুতু খুব জোরে দোতলা থেকে নিক্ষেপ করলেন এদের দিকে! আরেকবার তিনি কালো তামাকের পাইপে আগুন ধরালেন। তারপর খুব ধীর, শান্ত আর ভারি পদশব্দে সুরভিত তামাকের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সারিবদ্ধ দাঁড়ানো মুখগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ালেন! তিনি প্রথমে মোশতাকের দিকে তাকিয়ে একটা করুণার হাসি দিলেন। মোশতাকের পা কাঁপছে। বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বললেনÑ মোশতাক, মীরজাফরও মনে হয় তোর মতো এত বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক ছিল না রে! মোশতাক বঙ্গবন্ধুর দুই পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে- মুজিব ভাই, আমারে মাফ কইরা দেন, আমারে মাফ কইরা দেন! উফ, কী সেই দৃশ্য! কী সেই মুহূর্ত! তারপর তিনি এগিয়ে গেলেন বাদবাকি খুনীদের দিকে! তিনি তর্জনী নিক্ষেপ করতে লাগলেন সেই আজন্ম বিশ্বাসঘাতকদের অভিশপ্ত মুখগুলোর দিকে রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায়!
×