ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু তাঁর আদর্শে বেঁচে আছেন থাকবেন বাঙালীর হৃদয়ে

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ২১ ডিসেম্বর ২০১৯

 বঙ্গবন্ধু তাঁর আদর্শে বেঁচে আছেন থাকবেন বাঙালীর হৃদয়ে

হাজার বছরের ইতিহাসে পরাধীন বাংলার স্বাধীনতা আসে বঙ্গবন্ধুর তিন মন্ত্রে, ছিষট্টির ছয় দফা, ৭ মার্চের স্বাধীনতার ডাক, আর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণায়। বাঙালী জাতীয়তাবাদকে অন্তরে ধারণ করে স্বাধীন দেশের ভিত রচিত হয় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা- এই তিন আদর্শের ওপর ভিত্তি করে। বিশ্ববাসীর কাছে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন মানবিকতার তিন মন্ত্রে, মানুষের ভালবাসায়, মানুষের প্রতি ভালবাসায়, মানবকল্যাণে তাঁর আত্মত্যাগে। তার পরিচয় তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা, বাঙালী জাতির পিতা। সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু মুহূর্তের জন্যও আদর্শচ্যুত হননি, মানুষের কল্যাণ ভাবনা থেকে সরে আসেননি। ১৫ আগস্ট সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে বিশ্ব হারায় এক মহান নেতা, আমরা হারিয়েছি আমাদের জাতির পিতা। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যাকে অমরত্ম দিয়ে সৃষ্টি করেন তাকে হত্যা করে কে? ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর দেহকে হত্যা করেছে, তার আদর্শকে নয়। এই আদর্শকে ধারণ করেই বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম যেমন একদিনে হয়নি তেমনি তার কোন মৃত্যু নেই। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন তাঁর আদর্শে, প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর সাময়িকভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে এদেশ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। ১৫ আগস্টের পর থেকে স্বাধীন দেশটি নিজ দেশেই পরাধীন হয়ে পড়ে। ’৭১-এর পরাজিত শক্তির আদর্শই তখন এ দেশের আদর্শ হয়ে ওঠে। জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত ছাড়া সবই পাকিস্তানের ধারায় চালিত হয়। সে সময়েও প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করার সাহস কেউ পায়নি। ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু প্রায় পূর্ণ আসন পেলেও ভোট পেয়েছিলেন প্রদত্ত ভোটের প্রায় ত্রিশ শতাংশ কম। সেই ত্রিশ শতাংশ পাকিস্তান সমর্থকরা ’৭৫-এর পর থেকে দেশ শাসন করে এসেছে। আজ ক্ষমতা হারিয়ে চাপের মুখে তারা চরিত্র হরনের রাজনীতিতে সক্রিয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অনুকরণীয় আদর্শের প্রতীক স্বরূপ, একজন মহান নেতা। রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় যেমন তিনি ছিলেন বিশ্বের সকল নেতাদের উর্ধে, তেমনি তিনি সকল মানবিক গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মতো এমন বিচক্ষণ নেতার নেতৃত্ব ছাড়া এত অল্প সময়ে এমন পরিপূর্ণ স্বাধীন একটি দেশ আমরা পেতাম না। বিচক্ষণ নেতৃত্বের গুণে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব নেতাদের সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে আসেন। ছিষট্টির ছয় দফা দাবি ঘোষণা, ৭ মার্চের স্বাধীনতার ডাক আর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর এই তিনটি মন্ত্রে স্বাধীনতা শব্দটি আজ আমাদের। ৭ মার্চের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান চলছিল মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর কাছে নেতার নির্দেশই ছিল সব। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই ছিল আইন। তা সত্ত্বেও আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে পারে এমন কোন পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধু কাউকে নিতে দেননি। তখনও তিনি অপেক্ষায় ছিলেন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে কখন ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। প্রকাশ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের অপেক্ষায় থাকলেও বঙ্গবন্ধু মূলত অপেক্ষা করছিলেন কখন পাক সেনাবাহিনী বাঙালীদের ওপর আক্রমণ শুরু করবে সেই মুহূর্তটির জন্য। পাকিস্তানের সামরিক শাসক তখনও আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে যাচ্ছিল। মূলত তারা বঙ্গবন্ধুকে চাপে রাখতে চাচ্ছিল। আর অপেক্ষা করছিল বঙ্গবন্ধুর কোন একটি ভুল সিদ্ধান্তের জন্য। অপরদিকে বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তান সরকারের ধৈর্যচ্যুতির অপেক্ষা করছিলেন। তাদের ধৈর্যচ্যুতিই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে বৈধতা এনে দিতে পারে। মূলত এক পক্ষ অপর পক্ষকে চাপে রাখাই উদ্দেশ্য। পাকিস্তান সরকার যেমন বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধুও কিছু নিজস্ব এজেন্টের মাধ্যমে এদেশে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সকল কার্যক্রম লক্ষ্য রাখছিলেন। ২৫ মার্চ দিনের বেলায় বঙ্গবন্ধুর কাছে খরব আসে আজ রাতে সেনাবাহিনী ঢাকায় আক্রমণ শুরু করবে। বঙ্গবন্ধুরও প্রস্তুতি নেয়া ছিল। রাতেই সেনাবাহিনী ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতা। তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের সকল জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নেতা। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি আসনেই আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি নাগরিকেরই সমর্থন ছিল। তা সত্ত্বেও দেশের একটি অংশের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার ক্ষমতা বা বৈধতা বঙ্গবন্ধুর ছিল না। কিন্তু যখন তিনি দেখেন তাকে সমর্থন দেয়ার অপরাধে দেশের একটি অংশে গণহত্যা চালানো হচ্ছে তখন সেখানে স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর হাতে অন্য কোন উপায়ও থাকে না। তাই সবার কাছে এমনকি বিশ্ববাসীর কাছেও বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি ছিল বৈধ। স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য বিচক্ষণতার সহিত সঠিক সময় নির্ধারণ করা সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য ছিল একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারও কারও মতে ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করা হলে বিজয় অর্জন আমাদের জন্য সহজ হতো। কিন্তু ৭ মার্চ তো অনেক দূরের কথা, ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিট আগেও যদি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করতেন তাহলে আজও আমরা স্বাধীনতা পেতাম না। তখন আমাদের ওপর তাদের আক্রমণটা হতো আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি বলেই। তারা তখন বঙ্গবন্ধুকে বলত বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করা কোন আইনেই অপরাধ নয়। অপারেশন সার্চ লাইটকে তখন বলা হতো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে এই অপারেশন। তখন তারা বলত, ‘স্বাধীনতা ঘোষণার জন্যই তাদের এই আক্রমণ।’ এখন আমরা বলতে পারি, ‘আক্রমণের জন্যই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা।’ গণহত্যা শুরু হওয়ার আগে যেমন স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া সম্ভব ছিল না, তেমনি আক্রমণের পর বঙ্গবন্ধুর হাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া খুব বেশি সময়ও ছিল না। ঘোষণা দেয়ার পর পরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন তাকে গ্রেফতার করা হবে। তাই বঙ্গবন্ধুকে খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে ঘোষণার সময়টি নির্ধারণ করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যদি ঘোষণা দিতে না পারতেন, তার আগেই যদি বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হতো তখন আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম থাকত না। তখন বলা হতো পাকিস্তান সরকারের আক্রমণের মুখে বাঙালীদের বেঁচে থাকার লড়াই এবং আমাদের সে লড়াই এখনও চালিয়ে যেতে হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচিত হয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করতে না পারলে আজকের রোহিঙ্গাদের মতো অবস্থা হতো আমাদের। পাকিস্তান সামরিক শাসকদের অত্যাচারে আমাদের দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী অন্য কোন দেশে আশ্রয় নিতে হতো। আমাদের সৌভাগ্য স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু আমাদের নেতৃত্বে ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনাও বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই করে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে তখন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজনৈতিক নেতাদের করণীয় কি সেটা আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর ঠিক করা ছিল। মোট কথা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত সম্ভাব্য সবদিক বিবেচনায় রেখে বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই পরিকল্পনায় ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের করণীয় থেকে যুদ্ধ পরিচালনা পর্যন্ত। তাই বঙ্গবন্ধু বন্দী থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতারা স্বাধীনতা যুদ্ধে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন। যেখানেই অন্যায়-অবিচার সেখানেই গর্জে ওঠে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ। ৪৮ সালেই বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালীদের জন্য নয়। তাই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি যে আন্দোলন শুরু করেন তারই ধারাবাহিকতায় ৬৬ সালে এসে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা পেশ করেন। এই ছয় দফা আজ বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সনদ। আর শুধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে নয় পৃথিবীর প্রতিটি নিপীড়িত মানুষকে হৃদয়ে ধারণ করে নিয়ে বঙ্গবন্ধু গর্জে উঠেছিলেন ৭ মার্চে। তাই এই ভাষণটি আজ বিশ্বের প্রতিটি নিপীড়িত মানুষেরই প্রতিবাদী কণ্ঠ। তাই আজ যেখাইে নিপীড়ন সেখানেই গর্জে ওঠে বজ্রকণ্ঠ। সততা আর মানুষে প্রতি ভালবাসা একজন নেতার বড় গুণ। কিন্তু পাশাপাশি বিচক্ষণতা আর নির্ভীক হৃদয় ছাড়া বঙ্গবন্ধু হওয়া যায় না। যিনি নিপীড়িত মানুষের জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারেন তিনিই তো এই বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের নেতা, আমাদের বঙ্গবন্ধু। আমরা গর্বিত বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শই আমাদের মুক্তির পথ দেখাবে।
×