ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাকুরিয়া গণহত্যা

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ২৮ আগস্ট ২০১৯

পাকুরিয়া গণহত্যা

১৯৭১ সালের ২৮ আগস্ট দিনটি ছিল শনিবার। নওগাঁ শহরতলী থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, আত্রাই নদীর তীরবর্তী মান্দা উপজেলার পাকুরিয়া গ্রাম। সকালে পাকহানাদার বাহিনী পায়ে হেঁটে পাকুরিয়া গ্রামে প্রবেশ করে মিটিংয়ের কথা বলে ধরে আনতে থাকে। একই সঙ্গে বাড়িঘর লুটপাট ও আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রায় ৩০০-৪০০ গ্রামবাসীকে স্কুল মাঠে ধরে আনার পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। অল্প বয়সী ছেলেদের এবং বয়োবৃদ্ধ লোকজনকে ছেড়ে দেয়। পাশর্^বর্তী বাঁশের ঝাড় থেকে কঞ্চি কেটে এনে সবাইকে বেধড়ক মারধর করে। সবাইকে কালেমা পড়তে বলে। তারপর পাক হানাদাররা সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে মেশিনগান ফিট করে এক মুহূর্তের মধ্যে সবাইকে হত্যা করে। স্কুল মাঠে তারা ১২৮ জনকে হত্যা করে। তাদের মধ্য থেকে ১৭ জন জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন। এই দিন ৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে বহন করে ৩টি নৌকা পশ্চিম দিক থেকে নয়নপুরের দিকে আসছিল। মুক্তিফৌজ তিনটি নৌকাকেই ডুবিয়ে দেয় এবং ঐ ৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্যই ঘটনাস্থলে মারা যায়। ব্রাহ্মণপাড়া থেকে পাঁচটি নৌকায় পাকসেনারা শালদা নদী দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পথে মুক্তিবাহিনী এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে পাকসেনাদের পাঁচটি নৌকা বিধ্বস্ত হয়ে পানিতে ডুবে যায় এবং একজন ক্যাপ্টেনসহ ৩০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের নদী পথে অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোতে সরবরাহ পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ৯ টার দিকে ৩০ জন পাকিস্তানী সৈন্যসহ ২ টি নৌকা সামনের দিকে এগোতে চাইলে মুক্তিফৌজের আক্রমণের মুখে পরাস্ত হয় এবং এতে ঐ ৩০ জন সৈন্যের সকলেই মারা যায়। নৌকা দুটিও ডুবে যায়। সর্বোপরি কুমিল্লার শালদা নদী এলাকায় শত্রুপক্ষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ২৬ আগস্ট একজন ক্যাপ্টেনসহ শত্রুপক্ষের ৮১ জন, ২৭ আগস্ট ৪৫ জন এবং ২৮ আগস্ট ৮৬ জন সৈন্য নিহত হয়। সালদানদী এরিয়ায় শত্রুর ওপর অতর্কিত আক্রমণ করা হয়েছে; যেখানে শত্রুপক্ষের অনেক কর্মকর্তা বিভিন্ন অপারেশনে নিহত হয়েছে। সেখানে শত্রুপক্ষকে বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন স্থানে বারবার পালাতে হয়েছে। ২নং সেক্টরে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানির অধীন মুক্তিসেনাদের টহলদার দল মাধবপুর গ্রামের বাইরে কাঁচারাস্তায় পাকসেনাদের বহরে এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। এগারোটার সময় পাকসেনাদের জীপ এবং ট্রাকটি অ্যামবুশের আওতায় আসলে আক্রমণ চালিয়ে গাড়ি দুটির মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এই এ্যামবুশে ৯ জন পাকসেনা নিহত এবং ৬ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা নিজামের নেতৃত্বে এফ এফ ১৫ গ্রুপ মিরসরাইয়ের কাছে একটি রেলওয়ে ট্র্যাকে মাইন সেট করে। সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে একটি পাকসেনা ও রাজাকারবাহী ট্রেন সেখান দিয়ে যাবার সময় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে প্রায় ৩৫ জন পাকসেনা আহত হয়। সিলেটের তাজপুরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা দল পাকসেনাদের একটি দল শাহবাজপুর রেলস্টেশন ঘাঁটি থেকে তাজপুরের দিকে অগ্রসর হলে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে ৪ জন রাজাকার ও একজন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়। রংপুর ভূরুঙ্গমারী পাক অবস্থানে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে ২ জনকে আহত হয়। সিলেট জেলায় লামুকাটায় রাজাকার চৌকি সমেত অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। কুমিল্লা জেলায় মুক্তিবাহিনী মাইজবার গ্রামে পাকসেনা তল্লাশি অভিযান চালায়। এই অভিযানে ৩৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থেকে রাজাকার ও পাকসৈন্য মিলে ১৫০ জনের একটি দল মহেশপুর লুটপাট করতে আসে। খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী পুরো গ্রামের চারদিকে অ্যামবুশ করে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকি সৈন্যরা পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী সিলেটের জগন্নাথপুর থানার দিরাই ও শাল্লা এলাকা শত্রুমুক্ত করে সেখানে বেসামরিক প্রশাসন চালু করে। সালেহ চৌধুরী ঐ এলাকার আঞ্চলিক অধিনায়ক নিযুক্ত হন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য মনোনীত হন। জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশ মহাসচিব উ’ থান্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানান, পূর্ব পাকিস্তানের মার্কিন সাহায্য সমন্বয়ের জন্য ‘মার্কিন টাস্ক ফোর্স’ গঠন করা হয়েছে। সিনেটর এ্যাডওয়ার্ড কেনেডি ও ভারতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোলস বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে শাস্তি দেয়া হলে পাকিস্তানের সব ধরনের মার্কিন সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য দাবি জানিয়ে প্রচার অভিযান শুরু করেন। হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ও আনন্দ বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০ থেকে ২৫ আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশর বিভিন্ন খ-ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে দুজন সামরিক অফিসারসহ চার শতাধিক পাকিস্তানী সৈন্য এবং প্রায় ৪০ জন রাজাকার নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গের জমিয়তে উলামার কনভেনশনের অভ্যর্থনা কমিতির সভাপতি মওলানা মোহাম্মদ তাহের বলেছেন : বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সেই উগ্র ক্ষমতালিপ্সা এবং স্বার্থপরতারই ক্রমপরিণতি। ধর্মের নামে, ইসলামের নামে, দেশের ঐক্য সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার নামেই এই শোষণ এবং অবিচার চলেছে। অথচ যে পবিত্র ইসলাম এবং ধর্মের নাম নিয়ে এই শোষণ সেই পবিত্র ইসলাম ধর্মে কিন্তু তার অবকাশ মাত্র নেই। প্রিয় নবী (দঃ) স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সরকার তার প্রজা সাধারণের কল্যাণ প্রচেষ্টা করেন না, তাদের সঙ্গে বিশ^াসঘাতকতা করেন। নরকের আগুনেই তার নিশ্চিত ঠাঁই। অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষ কাপুরুষতা প্রদর্শন না করে যাতে সৎ সাহসে এগিয়ে আসে সেজন্য উৎসাহ দান হুজুর (দঃ) ঘোষণা করেছিলেন : ‘জালিম রাষ্ট্রনায়কের সম্মুখে সত্য কথা ঘোষণা শ্রেষ্ঠতম জেহাদ’। তাই দেখা যায়, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হতে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নানাভাবে এবং জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় এবং ঘোষিত বা অঘোষিত জেহাদ। আর শেষত ২৩ বছর পর সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ রায় দিয়েছিল ছয় দফার ভিত্তিতে। শেখ মুজিবের নেতৃত্ব হলো এই দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতীক। ইয়াহিয়া খানের বিশ্বাসঘাতকতা ও বুলেটের আঘাতে জন্ম নিল মুক্তিবাহিনী। মানুষ বাধ্য হলো জবাব দিতে। তারা যে যেখানে পারল শোষক সরকারের জালেম সেনাদের প্রতিরোধের প্রয়াস পেল ... তাই তাদের প্রত্যুত্তর সুসঙ্ঘবদ্ধ ছিল না। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না; ক্রমে মাস দুই পড়ে তারা সুপরিকল্পিতভাবে তাদের অভিযান চালাতে থাকে।’ এই মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্যে তাহের হাদিস শরিফ হতে উল্লেখ করে বলেন, ‘নিজেদের প্রাণ, ধন-মান রক্ষায় যে নিহত হয় তার মৃত্যু শহীদের মৃত্যু। ’ এই কনভেনশনে সভাপতি হিসেবে আজাদ হিন্দ বাহিনীর জেনারেল শাহ নেওয়াজ খান, সারা ভারত জমিয়তে উলামার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আসয়াদ মাদানি একটি অনৈসলামিক রাষ্ট্রের স্বরূপ নিয়ে যেমন বলেছেন, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সংগ্রামী জনসাধারণকেও অভিনন্দন জানান। কনভেনশন বাংলাদেশের সংগ্রামকে নিঃশর্ত সমর্থন জানান; ইসলামাবাদ চক্রের ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিকে ঘৃণা প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন করেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং ইসলামাবদের সামরিক চক্রের বিচার, এবং আশা প্রকাশ করে যে, সময় মতো ভারত সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।’ মান্থলী কনটেম্পোরারি বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ওপর ব্রিটিশ এমপি মিঃ আর্থার বটমলীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে রিপোর্ট করে যে, আর্থার বটমলী বলেন, আমি চাই ভারত ও পাকিস্তান কাছাকাছি আসুক। আমি চাই এই দুটো দেশ আবার এক হয়ে যাক। তবে এ ব্যাপারে আমি শুধু আশাই করতে পারি, না হলে আবার তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছি বলে ভুল বোঝার সুযোগ তৈরি হতে পারে। ভারতীয় উপমহাদেশ আরও বিভক্ত হোক তা কোনভাবেই কাম্য নয়, কারণ এ অঞ্চলের রয়েছে এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর গণিত ও পদার্থবিদ্যায় দক্ষ জনবল, যা আধুনিক বিশ্বে উন্নয়নের অপরিহার্য পূর্বশর্ত। আরও বিভক্তি এই জনশক্তিকে কাজে লাগানোর পথে বিশাল অন্তরায়। কিন্তু সামরিক বাহিনী যদি বর্তমান পরিস্থিতি তাদের মতো করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে তবে পাকিস্তানের ভেঙ্গে যাওয়া ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার ছেড়ে দেয়া। পাকিস্তানে আমার সফরের সময় জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলে আমি তাকেও একই কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমার কথায় তার সাড়া খুব একটা আশাব্যঞ্জক ছিল না। আমি তাকে উপমহাদেশে ব্রিটিশদের পরিনতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তা থেকে শিক্ষা নিতে বলি। আমি তাকে এই কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে আজ আমরা যাদের কারাবন্দী করি তারাই কিন্তু পরবর্তীতে জাতীয় নেতায় পরিণত হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×