ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদী যোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রসঙ্গে

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ২৭ আগস্ট ২০১৯

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদী যোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রসঙ্গে

১৯৭০ সাল। পুরো পাকিস্তান জুড়েই বাজছে নির্বাচনী ডামাডোল। এরই মধ্যে ডিসেম্বর মাসে ইয়াহিয়া খান প্রদত্ত Legal Framweork Order (LFO)-এর অধীন অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন। এ নির্বাচনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যে ছিল নির্বাচনের ১২০ দিনের মধ্যে জাতীয় পরিষদ কর্তৃক পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করা। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের পাশাপাশি পাকিস্তানের সবগুলো প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে। জাতীয় পরিষদের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের তিন শ’ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ ১৯৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল ছয় দফার ভিত্তিতে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৬৬ সালে রচনা করেন ছয় দফা। এই ছয় দফার প্রথম দফাতেই প্রণীত হয়- ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করত পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন রূপে গড়তে হবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভা সমূহের সার্বভৌমত্ব থাকবে।’ ১৯৭০-এর নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ তার দলীয় মেনিফেস্টো প্রকাশ করে। সেখানেও তাঁরা নির্বাচিত হলে কি ধরনের শাসনতন্ত্র তৈরি করবেন তার উল্লেখ করা হয়। যেহেতু, নির্বাচনটি হয়েছিল LFO-এর অধীনে, মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র চরিত্র ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণের স্বার্থ, এ দুটি বিষয় সামনে রেখেই সেদিন আওয়ামী লীগকে তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করতে হয়েছিল। শাসনতন্ত্র বা সংবিধানে কি কি বিষয় সন্নিবেশিত হবে তা উল্লেখ করা হয়েছিল এই ইশতেহারে। সেখানে এটি স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে, দেশে একটি সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে যার মাধ্যমে দেশের মানুষ সত্যিকারের স্বাধীনতা ভোগ করবে। ন্যায় বিচার ও সাম্যের ভিত্তিতে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠিত হবে। ইশতেহারে ধর্ম সম্বন্ধে বলা হয়, আল কোরান ও সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোন আইন প্রণয়ন করা হবে না। সংখালঘুদের ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে তারা সম্পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর অনুরূপ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবেন। সমতার ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়- ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা নির্বিশেষে দেশের প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে। মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে ওই ইশতেহারে উল্লেখ ছিল, প্রত্যেক নাগরিকের বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারসহ অন্যান্য বেশকিছু মৌলিক নাগরিক অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার বলে নিশ্চিত করা হবে। ইশতেহারে আরও উল্লেখ করা হয়, দেশে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হবে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ আলাদা থাকবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুত ওপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আরও অনেক বিষয়ের প্রতিও আলোকপাত করা হয়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীগণ তাঁদের নির্বাচনী প্রচারণায় সক্রিয় হন মূলত তাঁদের দলীয় ইশতেহার ও ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ও নির্বাচন পরবর্তী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানীদের দৃশ্যমান অনীহা ও সর্বোপরি ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের নজিরবিহীন বর্বর হত্যাযজ্ঞের ঘটনা বর্তমানের ষাটোর্ধ প্রতিটি বাঙালীরই কমবেশি জানা আছে। আর ঐতিহাসিকদের বদৌলতে বাকি জনগোষ্ঠী ইতোমধ্যে এই নৃশংস ইতিহাস অনেকটাই জেনে গেছে। আমি ইতিহাসবিদ নই। তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনা আমার উদ্দেশ্যে নয়। ইতিহাসের অনিবার্য সত্যটুকুই শুধু বলতে চাচ্ছি। নতুন প্রজন্মের ইতিহাসের সত্যকে জানার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করার প্রয়াসে আমার এ লেখা। ১০ এপ্রিল ১৯৭১, মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেন ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধিগণ। একই দিনে অর্থাৎ ১০ এপ্রিল ১৯৭১ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ‘আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়োগ আদেশ’ (Laws Continuance Enforcement Order) প্রবর্তন করেন। এইচটি ইমামের লেখা ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’-এ উক্ত ‘অর্ডার’ এর নিম্নরূপ বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে। মুজিবনগর ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ আমি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমাকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই মর্মে আদেশ প্রদান করছি যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে যেসব আইন ও বিধিবিধান কার্যকর ছিল সে-সমস্তই প্রয়োজনীয় অবস্থাগত পরিবর্তনসহ পূর্বোক্ত ঘোষণা সাপেক্ষে বলবৎ থাকবে এবং সকল সরকারী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসামরিক, সামরিক, বিচারবিভাগীয়, কূটনৈতিক যাঁরা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করবেন তাঁরা সকলেই তাঁদের স্ব-স্ব পদে চাকরিবিধির শর্তানুযায়ী যেভাবে কর্মরত ছিলেন তাঁরা সেভাবেই কর্মরত থাকবেন এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সকল জেলা জজ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যত্র কর্মরত কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা তাঁদের আওতাধীন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুগত্যের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থা করবেন। এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে। স্বাঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ১০ এপ্রিলে জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং একই তারিখের প্রদত্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত ‘আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়োগ আদেশ’ এ দুটি দলিলেরই কার্যকারিতা দেয়া হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকেই। মুজিবনগর সরকার পরবর্তী নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকার পরিচালনার দৈনন্দিন কাজ- এই দুটি ঐতিহাসিক আইনী দলিলের ওপর ভিত্তি করেই অদম্য দৃঢ়তায় এগিয়ে নিয়ে যান। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালী জাতি অবশেষে চূড়ান্ত বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করে। জাতি অর্জন করে স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন বাংলাদেশ। তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানী দখলদার সেনা মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। এরপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা। জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে স্বাধিকার আন্দোলনের পুরোধা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য। প্রতীক্ষার পালা শেষে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশে প্রত্যাবর্তন করেন একটি স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতা জনক হিসেবে। পরদিন ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু জারি করেন বাংলাদেশের সাময়িক সংবিধান আদেশ, ১৯৭২ (Provisional Constitution of Bangladesh Order, 1972)। আর এটিই ছিল বর্তমান সংবিধান না আসা পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ৪ নবে¤¦র আমাদের গণপরিষদ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করে, যা কার্যকারিতা পায় ১৬ ডিসে¤¦র ১৯৭২ সাল থেকে। সেই থেকে এই সংবিধানই হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি ও আইন। সবই ঠিকঠাক চলছিল। বঙ্গবন্ধুর অদম্য নেতৃত্বে এগিয়ে চলছিল দেশ। সদ্য স্বাধীন দেশের সাধারণ মানুষ নানা রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে দিনাতিপাত করছিল। কিছুদিনের মধ্যে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের বিপর্যস্ত আর্থিক অবস্থা কাটিয়ে যখন প্রিয় স্বদেশ ধীরে ধীরে একটু একটু করে এগোচ্ছে, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টায় যখন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকার দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে, ঠিক তখনই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার সহায়তায় বিশ্বাসঘাতক ষড়যন্ত্রকারী একটি রাষ্ট্রদ্রোহী সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে। এটি আসলে দায়িত্ব গ্রহণ ছিল না, এটি ছিল অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জাতীয় চার নেতাসহ অল্প কিছু দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা ছাড়া আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই সেদিন অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। স্বাধীনতার চেতনায় এটি ছিল কুঠারাঘাত। আরও পরিতাপের সঙ্গে বিসি¥ত হই যখন দেখি যে, ৮ নবেম্বর ১৯৭৫ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রধান বিচারপতির পদে আসীন থেকে নিজে রাষ্ট্রপতি এবং মুখ্য সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই নতুন রাষ্ট্রপতি ৭৫-এর ১৫ আগস্টে ঘটে যাওয়া একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে টু শব্দটি পর্যন্ত করেননি। বিষয়টি ভেবে একজন বিচারপতি হিসেবে আমি চরমভাবে লজ্জাবোধ করি। কষ্ট পাই, হতবাক হই। এটি হয়ত সকলেই জানেন যে, প্রধান বিচারপতি বা যে কোন বিচারপতিকে তাঁর পদে যোগদানের পূর্বে তাঁকে একটি শপথ নিতে হয়। শপথ নেয়ার সময় আরও কিছু কথার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়- ‘আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব’ শপথনামায় বিধৃত উল্লিখিত শব্দসমূহ বা বাক্যগুলো মন্ত্রীদের শপথের বেলায়ও উচ্চারণ করতে হয়, শুধু ‘আইনের রক্ষণ’ শব্দসমূহ ব্যতীত। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার যে মন্ত্রীগণ ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীরূপে শপথ নিলেন, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন যে, ‘সংবিধান সংরক্ষণের’ যে শপথে তারা আবদ্ধ ছিলেন পূর্বদিন পর্যন্ত, কি অবলীলাক্রমে পরের দিনই তারা সেই শপথ ভঙ্গ করলেন? শপথ ভঙ্গ করে নতুনভাবে শপথ নিয়ে একটি সাংবিধানিক সরকারের বদলে একটি অসাংবিধানিক সরকারকে সমর্থন করে তারা বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে করেছেন বেইমানি। আর জাতির সঙ্গে করেছেন প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাকতা। এরপর প্রধান বিচারপতি সায়েম ও মোশতাক মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের মতোই একটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন। হায়রে দুর্ভাগা স্বদেশ! জাতির ক্রান্তিলগ্নে যাদের দায়িত্ব ছিল সংবিধানের সংরক্ষণ করা, তারাই সংবিধানকে অবলীলায় পদদলিত করে অসাংবিধানিক পন্থাকে বেছে নেয়- ক্ষমতার শিখরে আরোহনের জন্য। দেশের এগিয়ে যাওয়াকে প্রতিহত করার জন্য। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল ৫ম সংশোধনী প্রণয়নের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পর্যন্ত বন্ধ করা হয়। বিচারহীনতার এই সুযোগে হত্যাকারীরা অব্যাহতি পায়। এ কথা সকলেরই জানা। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর সরকার ছিল একটি সাংবিধানিক সরকার। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে খন্দকার মোশতাক, জিয়া গং আরও একটি অসাংবিধানিক এবং মূলত সামরিক সরকার গঠন করেন। আর সামরিক শাসনকে দৃশ্যমান সমর্থন দিয়েছেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের মতো ব্যক্তি এবং আরও কিছু সুবিধাবাদী চরিত্রের রাজনৈতিক নেতা। ১৫ আগস্ট পরবর্তী যে ঘটনাগুলো স্বল্পপরিসরে তুলে ধরলাম, তা এক নির্মম ইতিহাসের চিত্র। এর বিপরীতেও একটি চিত্র রয়েছে। সেটি হলো, ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে দেশের বেশকিছু জায়গায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠিত হয় গায়েবি জানাজা। সঙ্গত কারণেই তখনকার আকস্মিক বিরূপ পরিস্থিতিতে সেসব খবর জাতীয় পত্রিকায় স্থান পায়নি। স্থান পেতে দেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, দেশের বেশ কিছু অঞ্চল থেকে বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যুব সমাজ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ও প্রতিশোধ নেয়ার মানসে ভারত সরকারের আশ্রয় ও সমর্থন চান। তখন এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম। সম্প্রতি আমি আমার গ্রামের বাড়ি মোহনগঞ্জ ঘুরে এসেছি। আমার সঙ্গে সুকুমার সরকার নামের এক ভদ্রলোক আরও ৩-৪ জনসহ দেখা করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মির্জা আব্দুল গণি, সুবোধ রায়, আক্কেব আলী ও শাহ মাহবুব মুর্শেদ কাঞ্চন। সুকুমার সরকারের বাড়ি নেত্রকেনা জেলার কলমাকান্দা থানায়। কথা হয় সবার সঙ্গেই। জানতে পারি অনেক কিছু। সুকুমার সরকার ’৭১-এর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বদলা নিতে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ভেতরে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি স্থানে যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছিলেন তিনি ও তার দল। তিনি আমাকে জানান, তাদের সঙ্গে আমার বাবা ডাঃ আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদের যোগাযোগ ছিল। আমরা শুধু এটুকু জানতাম যে, ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে আমার বাবা স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর লাশের গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং পরবর্তী করণীয় ঠিক করার জন্য কয়েকটি গোপন বৈঠক করেছিলেন। যার কারণে তাঁকে সামরিক বাহিনীর লোকজন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় এবং বেশ কিছুদিন নিজ বাসায় তাঁকে অন্তরীণ রাখে। সুকুমার সরকার প্রায় ঘণ্টা খানেক আমার সঙ্গে কথা বলেন। সীমান্তের ওপারে সে সময় তাঁদের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা, পরবর্তীতে ভারতে সরকার পরিবর্তনের কারণে তাঁদের দেশে ফেরত পাঠানো এবং দেশে ঢোকার পর সেনা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তাদের নির্যাতনের স¥ৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন সত্তরোর্ধ সুকুমার সরকার। তিনি আরও জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক প্রতিরোধ যোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব। আমি কথাগুলো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, যে সকল লোক ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন, তাদের অনেকেই ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্য হলেন কিভাবে? তাঁদের বিবেক কি নাড়া দেয়নি? বঙ্গবন্ধুর প্রতি কি তাদের এতটুকু মমত্ববোধ ছিল না? দেশপ্রেম ছিল না? অথচ সুকুমার সরকার ও তাঁর সঙ্গীরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন। চলবে...
×