ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিবি রাসেল ॥ বরেণ্য ফ্যাশন ডিজাইনার এবং মডেল

প্রকাশিত: ১৩:৩৯, ২৩ আগস্ট ২০১৯

বিবি রাসেল ॥ বরেণ্য ফ্যাশন ডিজাইনার এবং মডেল

২০১৯ সালের এই সময়ে এসে যদি আমাদের নারী কতটা এগুলো সেই অগ্রগতির হিসাবটি করতে বসেন তাহলে আপনি অবাক হবেন। বাঙালী নারী নেই কোথায়? সেটি খুঁজতে গেলে এক প্রকার ভিমরি খেতে হবে। জলে অন্তরীক্ষে পুরুষের সঙ্গে রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে সমান তালে নারী আজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একটানা তৃতীয়বার বাংলাদেশের মতো একটি দেশে একজন সুযোগ্য নারী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গৌরবের সঙ্গেহ দেশ পরিচালনা করছেন। একই সঙ্গে একটানা দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছেন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর মতো একজন অত্যন্ত মেধাবী নারী। পৃথিবীর ইতিহাসে একই সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দুটি পদে নারীর দায়িত্ব পালন করাটাও এক বিরল ঘটনা। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সামরিক- বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়, ব্যাংক-বীমা, বেসরকারী সংস্থা, বিদেশী সংস্থা সব জায়গায় নারীর দৃপ্ত পদচারণা। এমনকি বিদেশেও বাংলার নারী তাঁর অস্তিত্ব জানান দিয়ে চলেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পর্যন্ত মেধাবী নারী রুশানারা আলী তৃতীয়বারের মতো এবং রুপা হক ও টিউলিপ সিদ্দিকী দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়ে বাংলার নারীর প্রতিনিধিত্ব করছেন। দেশে-বিদেশে এ রকম অসংখ্য অগ্রগামী নারীর মধ্য থেকে একজন নারীর কথা আজকের পর্বে বলতে চাই। যিনি বিশ্বব্যাপী এক অন্য রকম উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গেছেন, খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছেন; বাংলাদেশকে সম্মানের আসনে বসিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশী ফ্যাশন মডেল এবং ডিজাইনার বিবি রাসেল। ১৯৫০ সালের ১৯ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বিবি রাসেল। তবে তার পৈত্রিক বাড়ি রংপুরে। পিতার নাম মুখলেসুর রহমান এবং মাতা শামসুন্নাহার রহমান। এই দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে বিবি রাসেল তৃতীয়। তাঁর স্কুল জীবন কেটেছে রাজধানীর টিকাটুলীর কামরুন্নেসা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখান থেকে ১৯৬৬ সালে ম্যাট্রিক এবং পরবর্তীতে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। যে সময়টিতে নারীর জন্য সাধারণ শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করায় এক প্রকার বাহুল্য ছিল সেই সময়ে ১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশী নারী হিসেবে যুক্তরাজ্যের লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশনে এই অঞ্চলের সম্পূর্ণ অপ্রচলিত একটি বিষয়ে পড়তে যান। সেখান থেকে ১৯৭৫ সালে ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। বিবি রাসেল ওই বছর তার কলেজের ¯œাতক প্রদর্শনীতে নিজের ডিজাইন করা পোশাকে নিজেই মডেলিং করে হৈচৈ ফেলেন। এরপর বাংলাদেশের বিবিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মেধা ও ফ্যাশন নিয়ে ব্যতিক্রমী চিন্তার কারণে বিশ্বের ফ্যাশন বোদ্ধাদের আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসেন ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার বিবি। ¯œাতক শেষের পর পরই তিনি মডেলিংয়ের প্রস্তাব পান ইভস সেন্ট লরেন্ট, কার্ল লেগার ফিল্ড, জর্জিও আরমানির মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের তরফ থেকে। ১৯৭৬ সালে মডেলিং ক্যারিয়ারের সূচনা করেন। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত একটানা ১৬ বছর তিনি ছিলেন ভোগ, হারপারস বাজার এবং কসমোপলিটনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মডেল। বিশ্বের অভিজাত প্রায় সব ব্র্যান্ডের মডেল হয়েছেন। যেমনÑ কোডাক, কোকো শ্যানেল, বিএমডব্লিউ, ইভস সেন্ট লরেন্ট, টয়োটা, কার্ল লেগার ফিল্ড, জর্জিও আরমানি ইত্যাদি। ক্যাটওয়াক করেছেন নাওমি ক্যাম্পবেল, ক্লদিয়া শিফারের মতো বিশ্বখ্যাত সুপার মডেলদের সঙ্গে। তিনি চাইলে ইউরোপ আমেরিকাতেই নিজের স্থায়ী ঠিকানা গড়তে পারতেন। কিন্তু নিরাপদ ও উন্নত জীবনের হাতছানিকে আমলে নেননি। ইউরোপের জনপ্রিয়তকে পেছনে ফেলে প্রিয় মাতৃভূমির টানে বিবি রাসেল দেশিয় বস্ত্র ও হস্তশিল্প নিয়ে কাজ করার একান্ত আকাক্সক্ষা নিয়ে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৯৪ সালে। ১৯৯৫ সালের ১৩ জুলাই দেশে গড়ে তোলেন বিবি প্রডাকশন। বিবি প্রডাকশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ফ্যাশন, বস্ত্রশিল্প ও হস্তশিল্প উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। ইউরোপীয় মডেলিং ও ফ্যাশন ডিজাইনিং জগতের পিছুটান ছেড়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত তাঁতপল্লীতে গিয়ে গামছা, খাদি কিংবা জামদানির মতো দেশীয় বস্ত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নে মনোযোগ দেন। মনোযোগ দেন দেশীয় হস্তশিল্পকে বিশ্ববাজারে পরিচয় করিয়ে দিতে। চেষ্টা চালিয়ে যান মসলিনের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে। দেশের গামছা দিয়ে বিশ্ব মাতিয়েছেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের হস্তশিল্পীদের হাতে জাদু আছে। দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়ে তিনি তাঁতীদের খোঁজখবর নেন। শুধু দেশেই নয়, ভারত, শ্রীলঙ্কা, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ডেনমার্ক ও কম্বোডিয়ার তাঁতীদের নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কম্বোডিয়ায় এইচআইভি পজিটিভ নারীদের সঙ্গে এবং স্পেনের কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দী নারীদের সঙ্গে নিয়ে ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’ থিমে কাজ করেছেন। ইউনেস্কোর সহায়তায় ১৯৯৬ সালে ‘উইভারস অব বাংলাদেশ’ নামে বিবি প্রডাকশন প্রথম ফ্যাশন শো করে প্যারিসে। ইউনেস্কোর সহায়তায় তিনি ইউরোপে অনেক বড় শো করেন। বিবির কাজের একমাত্র লক্ষ্য ফ্যাশনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন। হাতে বোনা খাদি, মসলিন, জামদানি ও উন্নতমানের সুতি কাপড়ের ব্যবহারে তাঁর ডিজাইন ও ফ্যাশন সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে অন্য রকম মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। ইউরোপের বিশ্বসেরা আটটি ব্র্যান্ড আরমানি, ভেলেন্তিও, পলস্মিথ, কেলভিন ক্লেইন, হুগোবস, ম্যাক্স মারা ও লরেন ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ‘বিবি রাসেল’ নামের ব্র্যান্ডও ফ্যাশনপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। এসবের বাইরেও কিছু কাজ রয়েছে বিবির। গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রের পোশাক পরিকল্পনা করছেন তিনি। এছাড়া এতে অভিনয়ও করেছেন। এর আগে তানভীর মোকাম্মেলের ‘লালন’ ছবির পোশাক পরিকল্পনাও করেছিলেন। আরণ্যক নাট্যদলের ‘এবং বিদ্যাসাগর’ মঞ্চ নাটকের পোশাক পরিকল্পকও তিনি। এই সমস্ত নানা কর্মজজ্ঞের জন্য বিবি রাসেল অর্জন করেছেন দেশী-বিদেশী অসংখ্য পুরস্কার, সম্মাননা ও স্বীকৃতি। তিনি বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো।১৯৯৭ সালে ‘এল ম্যাগাজিন’-এর বিবেচনায় বর্ষসেরা নারী হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৯৯ সালে লন্ডন আর্ট ইউনিভার্সিটির কাছ থেকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ পান। একই বছর ইউনেসকো তাঁকে ‘ডিজাইনার ফর ডেভেলপমেন্ট’ খেতাব দেয়। ২০০১ সালে ইউনেস্কো তাঁকে ‘শান্তির শিল্পী’ পদক দেয়। ২০০৪ সালে স্পেনের জাতিসংঘ সমিতির শান্তি পুরস্কার পান। ২০০৮ সালে ইউএনএইডস তাঁকে শুভেচ্ছাদূত মনোনীত করে। ২০১০ সালে স্পেনের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘দ্য ক্রস অব অফিসার অব দি অর্ডার অব কুইন ইসাবেলা’ পদক পান। ২০১০ সালের সেরা চলচ্চিত্র ‘মনের মানুষ’-এর জন্য শ্রেষ্ঠ পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে আমাদের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১৫ সালে নারীর সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারী জাগরণ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত করে। ব্যক্তিগত জীবনে দুই পুত্র সন্তানের মাতা তিনি। বাংলাদেশের হস্তশিল্প, ফ্যাশান তথা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেয়ার পেছনে এই মানুষটির অবদান অসামান্য। যতদিন বাংলাদেশের ফ্যাশান থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে ততদিন তাঁর কর্মের মাঝে এক জ্বলজ্বলে তারকা হয়ে থাকবেন একজন বিবি রাসেল। আজকে এত বছর পর বিবির বাংলাদেশে ফিরে আসার হিসাবটা যদি করা হয় তাহলে বেশকিছু প্রশ্ন এসে যায়। বাংলাদেশী বিশ্ববরেণ্য বিবিকে কী আমরা যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে স্থান দিতে পেরেছি? কিংবা তাকে আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পেরেছি? যদি প্রশ্নগুলোর উত্তর না হয় তাহলে সেটি আমাদের জন্য চরম দুঃখজনক। সম্পূর্ণ তার নিজের চেষ্টায় সেই যে একজন বিবি রাসেলকে আমরা পেয়েছিলাম তার পরে এত বছরে আর একজনও বিবি তৈরি হওয়া তো আমরা দেখিনি। অথচ অনেক সাধনায় গড়া বিবিকে আমরা কাজের উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পেরেছি বলে মনে হয় না। বিবি রাসেল এখন অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালেই ক্ষাণিকটা নীরবেই তার বিবি প্রডাকশনের কাজ করে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে কথা বললেও অনেকটা আক্ষেপের সুর বেজে ওঠে তার কণ্ঠে। তার মতো একজন বিশ্ববরেণ্য মানুষ দেশে আছেন কিন্তু আমরা বুঝতেও পারি না তার অস্তিত্ব। সাধারণ মানুষ ভেবেই বসেন যে বিবি হয়ত বা বিদেশে থাকেন। কিন্তু না। ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি ফুলটাইম বাংলাদেশে বসবাস করছেন। প্রশ্ন এসে যায় এমনটা কেন হবে? যেটি মোটেই কাম্য নয়। অথচ বিবিরই আমাদের ফ্যাশনের নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল এবং তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগামীর দুনিয়া কাঁপানো এক একজন বিবি রাসেল তৈরি হওয়ার কথা ছিল। আমরা সেটি করতে পারিনি। আর সে জন্যই আমরা আর একজনও বিবি রাসেল তৈরি করতে পারিনি। এক্ষেত্রেও এদেশে গুণের যে কদর হয় না সেটি আমরা আবারও প্রমাণ করেছি। এর দায় আমরা কিছুতেই এড়াতে পারব না। গত ১৯ আগস্ট বিবি রাসেলের ৭০তম জন্মদিন গেল অনেকটা নীরবেই। জন্মদিনের এই শুভক্ষণে আমাদের প্রত্যাশা বিবি আরও দীর্ঘদিন নীরবে নয়; অত্যন্ত সরবে আমাদের মাঝে কাজ করে যাবেন। বিবি রাসেলকে আমাদের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
×