ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

কাশ্মীর কোন পথে

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ১৭ আগস্ট ২০১৯

 কাশ্মীর কোন পথে

॥ পাঁচ ॥ শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেই নতুন সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং রাজন্য প্রথা বিলোপেরও দাবি জানিয়েছিলেন। দাবির কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ, ততদিনে ভারতের সকল দেশীয় রাজ্যের রাজন্যপ্রথা স্বাভাবিক নিয়মেই বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু শেখ আবদুল্লাহ এটাকে রীতিমতো একটা রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে ফেললেন। এরপর রাজ্যে নতুন সংবিধান গৃহীত হলো, যেখানে মহারাজার পরিবর্তে রাজ্যপ্রধানের নাম রাখা হলো ‘সদরে রিয়াসত।’ যুবরাজ করণ সিংকে বানানো হলো ‘সদরে রিয়াসত। ড. করণ সিংকে প্রশ্ন করেছিলাম- আপনাকে কি প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ ‘সদরে রিয়াসত’ বানিয়েছিলেন? করণ সিং বললেন, জম্মু-কাশ্মীরের আইনসভার সদস্যরা আমাকে সদরে রিয়াসত বানিয়েছেন। সদরে রিয়াসত’ মানে তো প্রেসিডেন্ট? স্বাধীন সার্বভৌম দেশে প্রেসিডেন্ট যে রকম হয় সেরকম নয়। কারণ কাশ্মীর ইতোমধ্যে চুক্তিবলে ভারতের অংশ হয়ে গিয়েছে। আমি ছিলাম রাজ্যের প্রধান। কতগুলো বিষয়ে আমার সার্বভৌম ক্ষমতা ছিল। যেমন আমি ইচ্ছে করলে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিতে পারতাম। তো, ’৫২ থেকে ’৬২ পর্যন্ত আমি তিনবার জম্মু ও কাশ্মীরের সদরে রিয়াসত ছিলাম। এরপর আবার পরিবর্তন এলো। প্রধানমন্ত্রী পরিণত হলেন মুখ্যমন্ত্রীতে। আমি সদরে রিয়াসত থেকে হলাম গবর্নর। রিজেন্ট থেকে গবর্নর পর্যন্ত ১৮ বছর আমি জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপ্রধান ছিলাম। এই ১৮ বছর ন্যাশনাল কনফারেন্স ও শেখ আবদুল্লাহর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী রকম ছিল? খুব স্বাভাবিক ছিল বলা যাবে না। নানা ধরনের জটিলতা ছিল। ’৫৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহকে আমি বরখাস্ত করেছিলাম। কী জন্য বরখাস্ত করেছিলেন? অনেক কারণ ছিল। আমার আত্মজীবনীতে আমি বিস্তারিত লিখেছি। এক পর্যায়ে তিনি কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বিরোধিতা করেন, যা সাধারণ মানুষের ভেতর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কারণ, ’৪৭-এ পাকিস্তানী উপজাতি ও সৈন্যদের আগ্রাসন ও নির্যাতনের স্মৃতি মানুষের মন থেকে তখনও মুছে যায়নি। শেখ আবদুল্লাহ যখন তাঁর মন্ত্রিসভার আস্থা হারিয়েছেন তখন তাঁকে বরখাস্ত করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না। এরপর বখশী গোলাম মোহাম্মদ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হন। দশ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ ব্যাপারে নেহরুর প্রতিক্রিয়া কী ছিল? বরখাস্ত করার আগে আমি নেহরুর সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম। নেহরু ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে করণ সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। দিল্লীতে যখনই যেতেন থাকতেন নেহরুর তিন মূর্তি ভবনে। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন কিভাবে তাঁর সঙ্গে নেহরু অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাঁকে নেহরু আদর করে ‘টাইগার’ ডাকতেন। কাশ্মীরের সাম্প্রতিক সমস্যার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, কাশ্মীরের ব্যাপারে পাকিস্তানের একটি অযৌক্তিক বদ্ধ ধারণা রয়েছে যে, যেহেতু জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলমানরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেহেতু কাশ্মীর পাকিস্তানের হওয়া উচিত। তারা পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে কাশ্মীর গ্রাস করতে চেয়েছে। যেমন ’৪৭-এর সেপ্টেম্বর থেকেই তারা প্রথমে উপজাতীয় এবং পরে সৈন্য পাঠিয়ে কাশ্মীরের একটা অংশ দখল করে নেয়। এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ হয়, ’৪৯-এর ১ জানুয়ারি কাশ্মীরকে দ্বিখ-িত করে নির্ধারিত হয় যুদ্ধবিরতি সীমানা। যা মোটামুটিভাবে এখনকার নিয়ন্ত্রণ রেখার মতো। ’৬৫-তে তারা আবার অনুপ্রবেশকারী পাঠায়, যা শেষ পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। ’৮৯ থেকে তারা আবার অনুপ্রবেশকারী পাঠানো শুরু করেছে। ’৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে শিক্ষা নিয়ে পাকিস্তানের উচিত ছিল ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে কাশ্মীরে আসতে পাকিস্তানীদের বাধা কোথায়? সারা বিশ্বের পর্যটকরা আসছে। পাকিস্তানীরাও পর্যটক হিসেবে আসতে পারে। আমি যখন পর্যটনমন্ত্রী ছিলাম তখন একবার বলেওছিলাম পাকিস্তানীরা বন্ধু হয়ে আসুক, ফুলের মালা দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাব। কিন্তু তারা আসবে কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে। এটাতো হতে দেয়া যায় না। আরেকটি বিষয় কাশ্মীরের ব্যাপারে আমাদের মনে রাখতে হবে। আজকের যা বাস্তবতা এটাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। বাস্তবতা হচ্ছে কাশ্মীর আজ দ্বিখ-িত। ভারতে অনেকে মনে করেন আমার পিতার আমলে জম্মু-কাশ্মীরের যে ভৌগোলিক সীমা ছিল তার পুরোটাই ভারতের হওয়া উচিত চুক্তি অনুযায়ী- এটা এখন আর সম্ভব নয়। পাকিস্তানেরও উচিত এই বাস্তবতা মেনে নেয়া। আপনি কি মনে করেন, এখন যেটা নিয়ন্ত্রণ রেখা এটাকে আন্তর্জাতিক সীমারেখা হিসেবে মেনে নিলে সমস্যার সমাধান সম্ভব? আমি এত নির্দিষ্টভাবে বলতে চাই না। আমি সাধারণভাবে বলছি, বিরাজমান বাস্তবতা আমাদের সকলকে মেনে নিতে হবে। পাকিস্তানকে এটা উপলব্ধি করতেই হবে গায়ের জোরে কাশ্মীর দখল করা যাবে না। দখল করতে না পারলেও কাশ্মীরী সমাজের তালেবানিকরণের প্রচেষ্টা তো তারা নিয়েছে। কাশ্মীরে তারা জেহাদ রফতানি করছে। হ্যাঁ, তারা তাই করছে। আফগানিস্তানের দিকে দেখ। কী করেছে তারা দেশটাকে! গোটা দেশটাকে তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। কাশ্মীরে এটা কখনওই হতে দেয়া যায় না। তারা ইসলামের কথা বলছে। গত দশ বছর ধরে কাশ্মীরে যে জঙ্গী তৎপরতা চলছে তাতে কি সেখানকার মুসলমানদের কোন উন্নতি হয়েছে? ভোগান্তি তাদেরও হচ্ছে। এ জন্যেই আমি বলি যুদ্ধ নয়, আলোচনায় এসো। বন্ধুত্ব দিয়ে সব কিছু জয় করা যায়। আমি যদি তোমার বাড়িতে যাই তুমি আমাকে চা খেতে দেবে। আমি যদি বলি এ বাড়িটা আমার, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ধাক্কা মেরে বের করে দেবে। ভারতেও অনেকে বলে পুরো কাশ্মীর আমাদের চাই। এটা আইনত হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এর কোন ভিত্তি নেই। একই কথা পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যত বেশি যুদ্ধ হবে, তত আমাদের ছেলেমেয়েরা অনাথ হবে, মেয়েরা বিধবা হবে- এ রকম চলতে দেয়া যায় না। সম্প্রতি আমি শ্রীনগরে হুরিয়াত কনফারেন্সের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে কথা বলেছি যারা কাশ্মীরের স্বাধীনতার কথা বলছেন। তারা বলতে চান মহারাজা হরি সিং-এর আমলে যে কাশ্মীর ছিল তারা সেই বৃহত্তর কাশ্মীরের স্বাধীনতা চান। তারা আরও বলেছেন, মহারাজা হরি সিং-ও কাশ্মীরের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। আমার পিতার আমলে তাদের জন্মই হয়নি। মৃদু হেসে করণ সিং বললেন, কিভাবে তারা এটা চাইছে আমি বুঝি না। সত্য হচ্ছে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে লেখা চিঠিতে আমার পিতা পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন- ‘আমি বিবেচনা করছি দুই ডোমিনিয়নের ভেতর কোনটির সঙ্গে যোগদান করা যায়, অথবা দুটোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে স্বাধীন থাকা যায়।’ আমার পিতার সামনে তিনটি পথই খোলা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পাকিস্তানী হামলা মোকাবেলার জন্য ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনও পথ খোলা ছিল না। প্রকৃত পক্ষে পাকিস্তান বাধ্য করেছে কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে। এখন নতুন করে সেখানে ফিরে যাওয়ার কোন অবকাশ নেই। তখনকার কাশ্মীরের প্রায় অর্ধেকই আমাদের সঙ্গে নেই। তেত্রিশ হাজার বর্গমাইল পাকিস্তানের দখলে, দশ হাজার বর্গমাইল চীনের দখলে। নতুন করে এগুলো জোড়া দেয়া যাবে না। তুমি কি মনে কর স্বাধীন কাশ্মীর ৪৮ ঘন্টার বেশি টিকে থাকতে পারবে তালেবানদের কালাশনিকভ রাইফেলের সামনে? প্রত্যেক সমস্যা সমাধানের কতগুলো সময়সীমা থাকে। তখন যদি আমার পিতা ব্রিটিশদের সঙ্গে, পাকিস্তানের সঙ্গে এবং ভারতের সঙ্গে ঠিক মতো আলোচনা করতে পারতেন সবাই যদি একমত হতেন, তাহলে হয়তো নেপালের মতো কাশ্মীরও স্বাধীন থাকতে পারত। নেপালের চেয়ে আয়তনে কাশ্মীর অনেক বড়। কিন্তু এটা হচ্ছে ধারণার কথা। এখনও অনেক কিছুই করা যায়, কিন্তু পাকিস্তানকে তো তাদের গোঁয়ার্তুমি ছাড়তে হবে। কাশ্মীর নিয়ে তাদের এই অবসেশনের ফলে তারা নিজেদের যেমন ক্ষতি করছে কাশ্মীরীদেরও ক্ষতি করছে। পাকিস্তানের গোয়ার্তুমির জন্য গোটা কাশ্মীর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তুমি সমস্যার কথা বলছ, কিন্তু শাহরিয়ার, এটা নিছক গাণিতিক সমস্যা নয়, এটা একটা বিশাল মানবিক বিপর্যয়। হাজার, হাজার, লাখ লাখ মানুষের জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। শত শত তীর্থস্থান ধ্বংস হয়েছে। চারার-এ শরীফের কথা ভাব। আলমদার-এ কাশ্মীরের মাজার তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। আমি আর আমার স্ত্রী চারার-এ শরীফ ধ্বংসের পর সেখানে গিয়েছিলাম। আমরা সেখানে হযরত নূরউদ্দিন ওয়ালির মাজারে চাদর উপহার দিয়েছি। কাশ্মীরীরা আমাদের এখনও ভালবাসে, যদিও আমরা ডোগরা। কোন নিরাপত্তা প্রহরী আমাদের সঙ্গে ছিল না। আমি বুঝি না আমাদের দুটি দেশের বাস্তববাদী হতে বাধা কোথায়। শাকিল বাদায়ুনীর একটা কবিতা আমার খুবই পছন্দের- ‘হার চীজ নেহী হ্যায় মার্কায পর/ এক জাররা ইধার এক জাররা উধার/ নফরৎ সে না দেখো দুশমনকো/ শায়াদ উয়ো মুহাব্বত কার ব্যায়ঠে।’ করণ সিংকে আমার শেষ প্রশ্ন ছিল- ‘হাজার বছর ধরে কাশ্মীরীরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তি ভেতর বাস করছে। আপনি কি মনে করেন মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ কাশ্মীরের মাটিতে শেকড় গাঁড়তে পারবে?’ করণ সিং বললেন- মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ ইতোমধ্যে কাশ্মীরের তরুণদের একটা অংশকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। ওরা অনেক মাদ্রাসা স্থাপন করেছে, যেগুলো চালাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীরা। এখনকার জঙ্গী তরুণরা এই মাদ্রাসারই ফসল। প্রবীণদের ভেতর এখনও পুরনো মূল্যবোধ রয়ে গেছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের কথা আলাদা। আমি অবশ্য কাশ্মীরের গোটা তরুণ সম্প্রদায়ের কথা বলছি না। তরুণদের ভেতর অনেকে আছে প্রগতিশীল চিন্তার অনুসারী, যারা ভারতের মূলধারায় যুক্ত হয়ে অবদান রাখতে চায়। কিন্তু তরুণদের একটা অংশ ইতোমধ্যেই ধ্বংসের পথে চলে গেছে, যেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা কঠিন। (ক্রমশ.)
×