ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘এক বেলা জমিতে কাজ আরেক বেলা ফুটবল খেলি’

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ২৮ জুলাই ২০১৯

 ‘এক বেলা জমিতে কাজ আরেক বেলা ফুটবল খেলি’

রুমেল খান ॥ ফাইনাল খেলায় অনবদ্য হ্যাটট্রিক। তখনও বোঝা যায়নি পেটে ব্যথা পেয়েছে। খেলা শেষে সতীর্থরা প্রাণভরে উল্লাস করেছে। ব্যথা ভুলে সেও উল্লাসে যোগ দিয়েছে। তারপরই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ‘বাফুফে-ইউনিসেফ অনুর্ধ-১৬ জাতীয় মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপাধারী লালমনিরহাট জেলা দলের ১০ নম্বর জার্সিধারী ফরোয়ার্ড সে। একটু পরেই মঞ্চে তাকে ডাকা হলো টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার (১৫ গোল, এটা চূড়ান্ত পর্বের গোল, আঞ্চলিক পর্বে আরও ১২ গোল) পুরস্কার নিতে। ক্যামেরাম্যানরা তাকে ছবি তোলার জন্য ডাকলেন। হাসিমুখে পোজ দেয়ার জন্য বললেন। কিন্তু পেটে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে কী হাসতে পারে মায়াবী চেহারা কৃষ্ণকলি বালিকাটি? লিভা আক্তারের কথাই বলছি। লালমনিরহাটের পাটগ্রামের টেপুরগাড়ি বিকে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। বাবা কৃষক। নিজেদের এক টুকরো জমি আছে। জনকণ্ঠকে লিভা জানায়, ‘জমিতে বাবার সঙ্গে এক বেলা কৃষি কাজ করতে হয়। এরপর যে সময়টুকু পাই ফুটবল খেলি।’ রংপুরের মিশরাত জাহান মৌসুমী এবং সিরাত জাহান স্বপ্নার খেলা খুব পছন্দ লিভার, ‘ভবিষ্যতে আমি মৌসুমী-রত্না আপুর মতো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ফুটবল খেলতে চাই।’ ২০১৯ সালের ৪ এপ্রিল। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলের ফাইনালে খেলেছিল লিভা টেপুরগাড়ি স্কুলের হয়ে। কিন্তু ফাইনালে তার দল ১-০ গোলে হেরেছিল ময়মনসিংহের পাঁচরুখী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে। তবে সেই আসরে ৬ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিল লিভাই। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিল গোল্ডেন বুট এবং ৩০ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, পেয়েছিল টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও (গোল্ডেন বল এবং আরও ৩০ হাজার টাকা)। এছাড়া অংশগ্রহণ ফি বাবদ আরও পেয়েছিল ১০ হাজার টাকা। এই ৭০ হাজার টাকা নিজের বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল লিভা। মেয়ের টাকায় বাবা নিজেদের ভাঙ্গা টিনের ঘরটি সেমিপাকা করে তৈরি করেছেন। লিভারা চার ভাই-বোন। লিভাই সবার বড়। তার আরেক ছোট বোনও চ্যাম্পিয়ন লালমনিরহাট জেলা দলের ফুটবলার, নাম মৌসুমী আক্তার। লিভা জানায়, ‘আমাদের দলের খেলোয়াড় মরিয়ম খাতুন বাদে দলের আর কোন ফুটবলারের ঘরে কোন টিভি নেই। এবার বাড়ি গিয়ে বাবাকে বলব একটি টিভি কিনে দিতে।’ দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় ফুটবল খেলা শুরু করে লিভা। শুরুতে লিভাকে খেলায় দিতে চাননি তার বাবা-মা। এ প্রসঙ্গে লিভার স্মৃতিচারণ, ‘আমার বাবা মতিউর রহমান, মা মনিফা বেগম, আত্মীয়-স্বজনও বলতো মেয়েদের খেলার দরকার কি, কেন খেলবে, মানুষজন খারাপ বলবে... তারপরও আমি খেলতাম। একদিন বাবা অনেক বকা দিল, মা অনেক মার দিল। তারপর আমার কোচ স্যার (খোকন) আমাদের বাড়ি গিয়ে মা-বাবাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করান। এ বছর যখন বঙ্গমাতা ফুটবল খেলে ৭০ হাজার টাকা পেলাম, আর সেই টাকা বাবা-মায়ের হাতে দিলাম, তখন তারা খুব খুশি হন। এরপর থেকে তারা আমাকে আর খেলতে বাধা দেননি বরং বলেছেন যেন ভালমতো খেলি। আমি খেলা ছাড়া আর কিছু বুঝি না। এটাই আমার সব। ফুটবল খেলেই আমি অনেক ওপরে উঠতে চাই।’
×