ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজা সেলিম

প্রযুক্তিসেবার অনুপ্রেরণায় হাজার বছরের বাংলা গান

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ২ জুন ২০১৯

 প্রযুক্তিসেবার অনুপ্রেরণায় হাজার বছরের বাংলা গান

আমরা অনেকেই হয়ত জানি না, বাংলা গ্রামোফোন বা কলের গানের প্রথম রেকর্ডিং স্টুডিও যিনি করেছিলেন তিনি কিশোরগঞ্জের হেমেন্দ্র মোহন বসু। তার গড়া সেই এইচ বোস কোম্পানিই ১৯০০ সালে বাংলা গানের ও কাব্যকণ্ঠ ধারণের জন্য বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাস তৈরি করেছে। ঘটনাচক্রে তাকে ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য যেতে হয়েছিল কলকাতায়। যেমন গিয়েছিলেন কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামের উপেন্দ্রকিশোর চৌধুরী (সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ)। হেমেন্দ্র মোহন বসু উপেন্দ্রকিশোরের বোনকে বিয়ে করেছিলেন। তখনকার পূর্ববঙ্গের আরও হাজার মানুষের মতো কলকাতায় লেখাপড়া বা ব্যবসাবাণিজ্য করতে গিয়ে দেশ ভাগের পরে এরা ভারতের নাগরিক বনে যান। মীর্জাপুরের রণদাপ্রসাদ সাহার মতো অল্প কিছু দামী মানুষ এসবের ব্যতিক্রম। দ্বিখন্ডিত বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি, বাণিজ্য-বসতি কালে কালে দ্বিখন্ডিত হয়। এখন আমরা গানের আলাপ করলে বলি এটা কলকাতার, নাটকের আলাপ করলে বলি এটা কলকাতার, বাংলার বলতে পারি না। নিজেদেরগুলোকে বলি আমাদের, বাংলাদেশের, বাংলার বলি না। বাংলাদেশ যা ধারণ করে আছে সেটাই বাংলা। আর বাংলার গান-বাজনার ইতিহাস বাঙালীর; এটা আমাদের মনে রেখে সামনে এগুতে হবে। দেশ দুটি দুই দেশের মধ্যে থাক, কিন্তু বাংলাটা খাঁটি বাংলার মধ্যে থাকতে দোষ কি! হয়ত সেই অনুপ্রেরণা থেকেই হেমেন্দ্র বসু ভেবেছিলেন একটা প্রেসের চিন্তা, গান-বাজনা ধরে রাখতে যদি বিলেতে যেতে হয় তো যাই, যন্ত্রপাতি নিয়ে আসি। মোটরগাড়ি চালানো শিখে নিজেই কলকাতার রাস্তায় সাদা সাহেবদের পাশে হাঁকাতেন। ‘গ্রেট ইস্টার্ন’ মোটরগাড়ি তৈরির কোম্পানি কিন্তু ওই হেমেন্দ্র বাবুরই! বাংলার সংস্কৃতি যদি গ্রাম থেকে এসে শহুরেই হয়- তো ধরে রাখতে অসুবিধা কি। নাহলে সেই আমলে এই রেকর্ডিং শিল্পের চিন্তা ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামের হেমেন্দ্র মোহন বসু ভাববেন কেন? আর কেনইবা বঙ্গভঙ্গের বেদনাকালে তিনি রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এদের ধরে এনে গান গাইয়ে তা রেকর্ড করে রাখবেন? আর এসবেরই অনুপ্রেরণা ছিল বাংলা মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা, কেবল ব্যবসা নয়। আমাদের এই কালে আসতে আসতে ইতোমধ্যে একশ’ বছর পেরিয়ে গেছে। সেই কালের কলেরগানের শিল্প এখন নিত্যনতুন প্রযুক্তির সেবায় উদ্ভাসিত। বছর দুই আগে ঢাকা সরকারী মিউজিক কলেজের অধ্যক্ষ কৃষ্টি হেফাজের উদ্যোগে ও শিল্পকলা একাডেমির সহায়তায় হাজার বছরের বাংলা গানের একটি গবেষণাধর্মী সঙ্কলিত গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়- যা এখন ইউটিউবেও পাওয়া যায়। যারা এই অনুষ্ঠান দেখেছেন তারা বুঝতে পারবেন বাংলার গানের ঐতিহ্য কত বেশি সমৃদ্ধ। খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের চর্যাপদ থেকে আধুনিক বাংলা গানের বয়স হিসেব করলেও এক হাজার বছর ছাড়িয়ে যায় শুধু আমাদের গানের বয়স যা কৃষ্টি হেফাজের সে উপস্থাপনায় আছে। সংস্কৃতির আর সব মাধ্যম বাদ দিলেও শুধু গান নিয়েই বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। কারণ, এদেশের গানের ভাষা চিরন্তন ও মর্ম স্পর্শ করে। বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না-অভিমান-কষ্ট-আনন্দের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ আছে বাংলা গানে, যা কোনদিনও হারিয়ে যাবার নয়। বাংলাদেশের গীতিকার, সুরকার, গায়ক-বাদকের অবিমিশ্র সম্পর্ক আমাদের দেশের মানুষের হৃদয়ে যে সম্মানের আসন গড়ে দিয়েছে সেটা কোনভাবেই দুর্বল নয়। আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীতও একটি গান, একজন বাঙালী কবিরই লেখা, যিনি বাংলার মেঠোগানের সুরের জাদুকর কুষ্টিয়ার গগন চন্দ্র দাসের (গগন হরকরা নামে পরিচিত) সুরের মিশেলে গেঁথেছিলেন, এমন মিলনের সম্পর্ক পৃথিবীর খুব কম দেশেই পাওয়া যায়। কৃষ্টি হেফাজের মতো যারা এ রকম গানের সম্মিলিত ও সমন্বিত গবেষণার দায়িত্ব নেন তারা প্রাণের তাগিদেই নেন। কিন্তু কথা হলো এর পরের কাজটুকু কে করবে? চর্যার আমলে যা হয়েছিল তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী খুঁজে-পেতে না পেলে ‘সহজযান’ ধর্মমতে দীক্ষিত ও সিদ্ধাচার্য চর্যাকাররা কেমন করে দোহা গানের চর্চা করতেন পরের গবেষণাগুলোয় তা বেরিয়ে আসত না। ফলে মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে বিকাশমান প্রকাশনা শিল্প আজ যে ডিজিটাল যুগে এসে পৌঁছেছে তার একটা সমন্বিত উদ্যোগ থাকা দরকার। আর সে দায়িত্ব বাংলার বাংলাদেশকেই নিতে হবে। একালের হেমেন্দ্র বসুরা অনেকেই দেশজুড়ে কলের গানের মতো রেকর্ডিং স্টুডিওর কাজ করেন। ইউটিউবে এদের খোঁজ পাওয়া যায়। আমাদের সংস্কৃতি বিভাগ এ রকম একটি ডেটাবেজের উদ্যোগ নিতে পারে- যে কেউ ইউটিউবে বা ডিজিটাল মাধ্যমে কাজ করুক একটা নিবন্ধনের খাতায় শুধু নামটি লিখিয়ে নিল। দেখা যাবে শত শত হেমেন্দ্র বসু কাজ করছেন কিন্তু তাদের কোন অর্থ নেই, যন্ত্রপাতি নেই, স্বীকৃতি নেই, বাসনা আছে তৃপ্তি নেই। যারা ইউটিউব নিয়ে গবেষণা করেন তারা জানেন কনটেন্ট অসুবিধা কেমন করে সেখানে এক অথর্ব অপশিল্পের জন্ম দিচ্ছে। সেখানে আমাদের সংস্কৃতি রাজন্য সেবা বিভাগের সামান্য মনোযোগ দেশের জন্য বয়ে আনতে পারে এক সুবিশাল গানের আর্কাইভ গড়ার সম্মান। সবচেয়ে বড় কথা দুনিয়াজুড়ে যখন মেধাসম্পদের স্বীকৃতি নিয়ে এত মাতামাতি সেখানে আমাদের মেধাসম্পদও তাতে কিন্তু নিশ্চিত হয়। অনলাইন সম্পদসেবায় যে অরাজকতা এখন বিরাজমান তাতেও রাজকতা প্রতিষ্ঠায় আমাদের সুযোগ বাড়বে। বাংলাদেশের মেধাসম্পদের বাণিজ্য চিন্তা কখনই ছিল না। আর তা নেই বলে নানা কণ্ঠে, নানা সুরে নানারকম প্রচেষ্টায় আমাদের সঙ্গীত জগতের বিকাশ ঘটেছে এটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু বিকৃতি নিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও বাণিজ্যের সঙ্কীর্ণ, অসাধু চিন্তাও আমাদের ক্ষতি করেছে সন্দেহ নেই। ফলে ব্যাকরণ বজায় রেখে গানের শিল্পরূপ স্বরলিপি প্রণয়নের এক অসাধারণ কাজ হয়েছে ও হচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি বিভাগগুলোর উদ্যোগে- যেগুলোর ডিজিটাল রূপ এখন অবশ্যম্ভাবী। তখন আমাদের ধারণক্ষমতা বেড়ে যে স্থানে পৌঁছাবে, পরের হাজার বছর পরে দেখা যাবে বাংলা গানের ইতিহাসের কোথাও কোন অরাজকতা নেই। এখন আমাদের দরকার গায়কী মেধার অনুসন্ধান। সে অনুপ্রেরণা ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্যে জরুরী। বাংলার গ্রামে যে সুরপ্রতিভা আমরা তাদের খুঁজছি টেলিভিশনে। কারণ, সেখানে একটা বাণিজ্য চিন্তা আছে, মেধার স্বীকৃতি থাকুক বা না থাকুক। এতে আর যাই হোক অনুপ্রেরণা সীমিত। এটা করতে পারে গানের স্কুল আর তা হতে হবে সরকারী উদ্যোগেই। দেশে একটি মাত্র সরকারী মিউজিক কলেজ আছে যা সমন্বিত সঙ্গীত সম্পদে ভরপুর এই বাংলার জন্যে খুবই অসম! সেখানে মেধাসম্পদ সংরক্ষণের চর্চা কি হয়? অবশ্যই হতে হবে। নইলে সঙ্গীতের মেধা চর্চা সঙ্কীর্ণ ভৌগোলিক নিয়তি পাবে ঠিকই কিন্তু জাতীয় ইতিহাসে এক সময় ঠাঁই পাবে না। যদিও এর বিচারের ভার মহাকালের হাতে ছেড়ে দেয়াই ভাল কিন্তু অনুপ্রেরণা আমাদের কালের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হতে হবে। বাংলার নানারকম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুপ্রেরণার ইতিহাস বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। সত্যজিৎ রায়ের জীবনীগ্রন্থে উল্লেখ আছে, তিনি তার ছেলেবেলা নিকট আত্মীয় হেমেন্দ্র মোহন বসুর এইচ বোস কোম্পানির কলের গান শুনে আর তার তোলা ছবি ‘অটোক্রোম স্লাইড’ থেকেই পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রেরণা লাভ করেন। যদিও তার পিতা সুকুমার রায় ও দাদা উপেন্দ্র কিশোর রায় উভয়েই ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক। হেমেন্দ্র মোহন বসুর পুত্র ও কন্যাদের মধ্যে পুত্র নীতিন বোস ছিলেন ভারতীয় খ্যাতনামা চিত্র পরিচালক, কার্তিক বোস ছিলেন ভারতের অন্যতম ক্রিকেটার, কন্যাদের মধ্যে মালতী ঘোষাল ছিলেন ভারতের অন্যতম সঙ্গীত শিল্পী। তিনি ভারতের বেতার, টিভি ও এইচ বোস গ্রামোফোন রেকর্ডে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন। যারা যূথিকা রায়ের গান শুনেছেন বা নাম শুনেছেন তাদের সদয় অবগতির জন্যে আর একটু অনুপ্রেরণার ইতিহাস দেই- জন্মসূত্রে তিনি খুলনার সেনহাটি গ্রামের মেয়ে, শিক্ষা বিভাগে বাবার চাকরি সুবাদে কলকাতা যান। আর ফিরে আসা হয়নি। ঘটনাক্রমে কাজী নজরুল ইসলাম তার গান শুনে মুগ্ধ হন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে নজরুল ইসলামের চেষ্টায় প্রথম তার গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এরপর কমল দাশগুপ্ত তাকে দিয়ে গান করান। এরপর থেকে ধীরে ধীরে তিনি জনপ্রিয় শিল্পীতে পরিণত হন। তার জন্য নতুন গান রচনার জন্য কাজী নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করেছিলেন। সেই অনুরোধে নজরুল ইসলাম রচনা করেন ‘নীল যমুনার জল’ ও ‘হে কৃষ্ণ প্রিয়তমা’। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মদিন উপলক্ষে তার সঙ্গে কমল দাশগুপ্ত দ্বৈতকণ্ঠে গান করেন। তিনি কমল দাশগুপ্তের নির্দেশনায় বহু নজরুল সঙ্গীত রেকর্ডে গেয়েছেন। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তার ভজন শুনে যূথিকাকে ‘মীরাবাঈ’ উপাধিও উপহার দেন। বাংলাদেশের খুলনার যূথিকা রায় ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের পদ্মশ্রী উপাধি পান। এত অনুপ্রেরণা না হলে এটা হতো? সে অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস এখন আমাদের হতে পারে অবিকৃত গানের প্রযুক্তিসমৃদ্ধ জাতীয় আর্কাইভ। আমাদের এই ব্যস্ত জীবনে সাক্ষাত অভিভাবক আর কই? যারা প্রাণের তাগিদে সুরের সাধনা করে চলেছেন তাদের জন্য আমাদের অসীম শ্রদ্ধা। কারণ, বাংলা গানই বাংলাদেশকে অবিকৃত রেখেছে, রাখবে ও এতে আমাদের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার সমুন্নতই থাকবে। কৃষ্টি হেফাজের মিউজিক কলেজের সেই অনুষ্ঠানের পেছনের পর্দায় লেখা ছিল ‘আপনার অপেক্ষায় থাকবে হাজার বছরের বাংলা গান’, নিশ্চয়ই আমাদের প্রযুক্তিসেবা সে অপেক্ষার উপযুক্ত সম্মান দেবে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×