ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

প্রকাশিত: ০৮:২১, ১৫ মে ২০১৯

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

শ্যামল বাংলার নৈসর্গিক বৈভবে গড়ে ওঠা মানুষরা প্রকৃতির সঙ্গে নিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকে। সভ্যতা সূর্য মধ্য গগনে সারা পৃথিবীতে আলো ছড়ালেও নির্মম প্রকৃতি এখনও তার নিষ্ঠুর নিয়মের অপরিহার্য গতিতে ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে সময় নেয় না। প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো আধুনিক সময়েও যে মাত্রায় সভ্য মানুষের ওপর তাণ্ডব চালায় তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ যাই থাকুক না কেন উপস্থিত বিপর্যয় জানমালের ওপর নৃশংসভাবে থাবা বসিয়ে দেয়। মনে হয় সেই প্রকৃতির কাছে মানুষ আজও কত অসহায়। এক সময় গুহাবাসী বন্য মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকাটা সার্থক করত। প্রকৃতির অফুরন্ত দানে তার কোলের সন্তানরা যেমন নিজেদের আশ্রয় খুঁজে নিত, পাশাপাশি বিরূপ প্রতিবেশকেও সামলিয়ে নিজেদের ঠিকানা নির্বিঘ্ন করত। তবে নিষ্ঠুর প্রকৃতির অনিবার্য গতি নির্ণয় গুহাবাসী অসহায় মানুষদের আয়ত্তের বাইরে ছিল। আজও আমরা অনিয়ন্ত্রিত প্রকৃতির ভয়াল রূপকে কোনভাবেই নিজেদের আয়ত্তে আনতে পারিনি। আদিম গুহাবাসী মানুষের নিত্যদিনের জীবন প্রবাহে প্রকৃতির স্নেহ আর শাসনের ছিল এক অমোঘ পরিণতি। তেমন অসহায়ত্ব কাটাতে মানব সভ্যতাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। সভ্যতা সূর্য যখন আদিম বন্য মানুষদের জীবন আলোকিত করতে তার কিরণ অবারিত করল তখনও অনেক অজানা প্রাকৃতিক সঙ্কট জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল। নিয়মিত জ্ঞানচর্চা আর নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বিশ্বময় যে অবিস্মরণীয় জয়যাত্রা তার সুফল ও সম্মিলিতভাবে সবাই উপভোগ করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধুনিক অগ্রযাত্রায়ও প্রকৃতির নিষ্ঠুর আগ্রাসন আজও মানব সভ্যতাকে বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়। নতুন করে অনুধাবন করতে হয় প্রকৃতির রুদ্ররোষ, রুষ্টতার এক ভয়াবহ মূর্তি যা কিনা সভ্য মানুষ আগাম বলে দিতে পারলেও আধুনিক বিজ্ঞানের এমন কোন শক্তি আবিষ্কৃত হয়নি যা বিগড়ে যাওয়া নিসর্গকে শান্ত স্নিগ্ধ করে দিতে পারে। আধুনিকতার বিস্তৃত বলয় সেও এক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সফল অভিগমনে নিরন্তর সমৃদ্ধ হওয়া। সাত সমুদ্র তেরো নদী অতিক্রম করা সভ্য মানুষ আকাশেও তার অগ্রযাত্রাকে সফলতায় শীর্ষে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয় চাঁদে অবতরণ করা, মহাকাশে দুঃসাহসিক অভিযানে নিজেদের অব্যাহত সফলতার গ্রহ নক্ষত্রের সীমারেখাও সভ্য মানুষদের মনন ও জ্ঞান চর্চায় প্রতিনিয়তই অভিষিক্ত হচ্ছে। সভ্যতার মধ্যাহ্নে বিশ্বজয়ী মানুষরা পৃথিবীর সীমানাকে অতিক্রম করে অন্য জগতকেও স্পর্শ করার যোগ্যতম প্রমাণ করেছে। তার পরেও সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় প্রাকৃতিক বীভৎসতাও মানুষের জীবনকে নানামাত্রিকে সঙ্কটময় করে তুলছে। ভৌগোলিক তারতম্যের কারণে পৃথিবীতে নানামাত্রিকে প্রাকৃতিক বৈপরীত্যও লক্ষণীয়। কোন দেশ তুষার ঝড় আর বরফের আচ্ছাদনে প্রতিদিনের জীবনযাত্রা থমকে যাওয়ার অবস্থা। বৃহৎ বৃহৎ বনাঞ্চলে এখনও অগ্ন্যুৎপাতের মতো ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা চারপাশের মানুষদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। আর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের বেসামাল তা-বে আক্রান্ত অঞ্চলের দুরবস্থা সবসময়ই সংবাদমাধ্যমের রসদ যোগায়। সেভাবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশ ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে একেবারেই আলাদা। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং সঙ্কটগুলোর মাত্রাও ভিন্ন আঙ্গিকে। নদীমাতৃক বাংলার নরম পলিমাটি যেমন শস্য সম্ভারের নিয়ামক শক্তি একই ভাবে সমুদ্র, নদ-নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা মানুষদের প্রতিদিনের জীবনও এক প্রকার প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র। ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে নৈসর্গিক বৈচিত্র্যও শ্যামল বাংলার বিষয়গত সম্পদ। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড় এসবও মোকাবেলা করতে হয় নানামাত্রিকে। সমুদ্র, পাহাড় আর বনাঞ্চলের সুরম্য প্রাকৃতিক সম্পদের এক সম্ভাবনাময় অঞ্চল এই দেশ। যেখানে সিংহভাগ মানুষ প্রকৃতির কোলে লালিত। তার অবারিত দানে পরিপুষ্ট। প্রকৃতি এবং জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের অপার সম্ভাবনা নিজস্ব নিয়মে তৈরি হয়, গতিময়তা পায় সর্বোপরি মানুষ আর নিসর্গের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে। মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে যে সখ্য এবং নিরবচ্ছিন্নতা সেখানে রুদ্ররুক্ষমূর্তি মানুষের দুরবস্থার কারণ হলেও তার সন্তানরা সেটার মোকাবেলা করতেও পিছপা হয়নি কখনও। বিরূপ এবং ক্ষুব্ধ প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা মানুষগুলো এর নিষ্ঠুরতাকেও সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। আধুনিক বিজ্ঞান, জনগণের সর্বাত্মক সচেতনতা এবং সরকারের বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সমূহ অসহায়ত্ব নিরসনে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এর যথার্থ সুফল আমরা এবারের ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পার হওয়া প্রত্যক্ষভাবে অনুধাবন করেছি। ফণী তার মূল শক্তি উড়িষ্যায় ক্ষয় করে আসলেও কিছুটা দাপট তো ছিলই। কিন্তু সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মানুষদের আগাম সতর্কতায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে। যেসব জেলায় ফণীর সরাসরি অতিক্রম করা দৃশ্যমান হয়েছে সেখানেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে ছিল আগের ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের তুলনায়। ২০০৭ সালে ১৫ নবেম্বরে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব আজও দক্ষিণবঙ্গের মানুষের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। সে সময় না ছিল পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র, সতর্কতা গ্রহণের সুযোগও আয়ত্তের মধ্যে আনা যায়নি। ফলে ক্ষয়ক্ষতি এমন হয়েছিল যা ওই সময়ের এক অসহনীয় দুর্ভোগ ছাড়া অন্য কিছু ভাবাও যায়নি। সিডর নামে চিহ্নিত এই বিধ্বংসকারী ঘূর্ণিঝড়টি খুলনা, বাগেরহাট, মংলা বন্দরের ওপর যে মাত্রায় আঘাতহানে তা অকল্পনীয়। সেদিন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন সুন্দরবন যদি না থাকত তাহলে ঘূর্ণিঝড়টি আরও প্রলয়ঙ্করী হতো। সুতরাং শুধু বিজ্ঞান নয়, প্রকৃতির অবারিত দান শ্যামল বনাঞ্চলও মানুষকে এবং তার পারিপার্র্শ্বিক পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। মানুষ তার অস্তিত্বের প্রয়োজনে, বেঁচে থাকার তাগিদে চার পাশে যে বৈষয়িক প্রতিবেশ গড়ে তোলে সেখানে একটি বিশেষ জায়গা জুড়ে থাকে নৈসর্গিক সম্ভার। সম্প্রতি বাংলাদেশের ওপর বয়ে যাওয়া ফণী ঘূর্ণিঝড় সেভাবে পূর্ণ শক্তি নিয়ে তার দাপট দেখাতে ব্যর্থ হলেও ক্ষয়ক্ষতি যে একেবারে কম হয়েছে তা কিন্তু নয়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সারাদেশে অনেক বৃষ্টিপাত হয়। যা ফসলের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলার আশঙ্কা যেমন প্রকট পাশাপাশি কয়েকটি জায়গায় বিদ্যুত লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ারও দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট মানুষদের। তবে একটা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় যে মাত্রায় সব কিছু তছনছ করে দেয় সে তুলনায় ক্ষয়ক্ষতিকে সহনীয় বলা হলেও তার মাত্রা একেবারে কমও নয়। সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সর্বক্ষণিক নজরদারিতে উপস্থিত বিপর্যয়কে সামাল দিতে প্রশাসনিক সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে যায়। যে আশঙ্কা ও বিপদ নিয়ে ফণী কয়েকদিন সবাইকে মাতিয়ে বেড়ায় সে তুলনায় এই ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের উড়িষ্যাকে তছনছ করে দিলেও বাংলাদেশকে সেভাবে করতে পারেনি নিজে দুর্বল হওয়ার কারণে। ভারত সরকারও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে এতটাই তৎপর ছিল মানুষের জানমাল সামলানোর তাৎক্ষণিক পরিকল্পনায় সমূহ বিপর্যয়কে লাগামহীন হতে দেয়নি। মানুষের সচেতনতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, সর্বক্ষণিক নরজদারি, বিধ্বস্ত এলাকার সঙ্গে সমন্বয় সাধন, পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তাÑ সব কিছু মিলিয়ে সঙ্কটময় পরিস্থিতিকে সামলানো এক উল্লেখযোগ্য কর্মপরিকল্পনা। নদীবিধৌত সমুদ্র পাড়ের মানুষরা প্রকৃতির সংহার মূর্তির সঙ্গে যুদ্ধ করেই নিজেদের টিকিয়ে রাখে। এই অব্যাহত সংগ্রামী অভিযাত্রায় নদীকূলের দু’পাশের মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় বয়ে চলে এক অনিশ্চয়তার জোয়ার। দুই কূলই কখনও ভাঙে আবার কোন এক সময় গড়ে ওঠে। ভাঙ্গা-গড়ার এমন দ্বৈত খেলায় মাঝেমধ্যে উপরি পাওনা হিসেবে ভর করে ফণীর মতো এমন কিছু অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগ। সেই অবর্ণনীয় দুঃসময় ও কোন এক পর্যায়ে স্থিত হয়। নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া অসহায়, সাধারণ মানুষ নিজ গৃহের আঙিনায় ফিরে আসে। ঝড়ের তা-বে ক্ষয়ক্ষতিকে সামলিয়ে নতুন করে আবার বসতি গড়ে প্রশাসনিক সহযোগিতায় কিছুটা। বাকিটা নিজের সহায় সম্বলের ওপর নির্ভর করে। এসব অতি সাধারণ নি¤œবিত্তের মানুষ যারা এমন প্রাকৃতিক আক্রমণে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। ভয়ঙ্করী বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার তাদের ভাসিয়ে নেয়। আবার নতুন ঠিকানা খুঁজতে হয়। প্রকৃতির দান কিংবা এর সংহার মূর্তির ওপর এদের কোন ধারণাই থাকে না। ভাগ্য কিংবা বিধতার ওপর নিজেদের সমর্পণ করে নিশ্চিন্তে, নির্বিঘেœ দিন কাটায়। চরম বিপদকে বিধাতার অভিশাপ কোন এক কর্মফলের বলে মেনেও নয়। আবার অনাকাক্সিক্ষত বিপদ কেটে যাওয়াকে বিধাতার আশীর্বাদ বলেও ভাবতে কুণ্ঠিত হয় না। প্রকৃতির এমন বৈরী অবস্থার শিকার হয় অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া মানুষ। যাদের বসতবাড়ি দুর্যোগের অনুকূলে। নিরাপদ জায়গায় নেয়া ছাড়া তাদের রক্ষারও কোন পথ থাকে না। নিজের সামান্য সহায় সম্পত্তিও এক সময় দুর্যোগের করাল গ্রাসে নিপতিত হয়। জানি না এরা কবে সচেতন হয়ে ভাবতে পারবে এমন সব প্রাকৃতিক বিপর্যয় পৃথিবীর এক অলিখিত নিষ্ঠুর নিয়মের অধীন। যে নিয়ম সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে আজ অবধি চলে আসছে। প্রকৃতির অনেক নিয়মবিধি বিজ্ঞান জয় করলেও এখন পর্যন্ত অনেক অজেয় প্রলয়ও প্রকৃতিকে গভীর রহস্যে আবৃত করে রেখেছে। সে সব জানতে বিজ্ঞানকে আর কতদূর যেতে হবে সে জবাব দেবে সময়। তার পরও প্রকৃতি তার নিয়মিত ভৌগোলিক ও পারিপার্শ্বিক গতি নির্ণয়ে যে মাত্রায় আশপাশের এলাকাকে প্রতিনিয়তই আবর্তিত করে রাখে সেখানে সাধারণ মানুষরা নিজেদের অস্তিত্বকে কোনমতে রক্ষা করে পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়। তেমন সমন্বয়েও জীবন এগিয়ে চলে। সঙ্কট আসে আবার কেটেও যায়। নিশ্চিত জীবনের কোন এক সময় ছন্দপতন হয়। নতুন করে গ্রন্থি বাধতেও সময় লাগে না। প্রকৃতির উথাল পাতাল ঢেউয়ে বিবর্ণ মানুষেরা আবারও কোন এক অজানা গন্তব্যে পাড়ি দেয়। শেষ ঠিকানা কোথায় তা কেউ জানে না। লেখক : সাংবাদিক
×