ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলের গদ্য-সাহিত্যের বন্ধ দরজা

প্রকাশিত: ০৯:৪৬, ২৯ মার্চ ২০১৯

নজরুলের গদ্য-সাহিত্যের বন্ধ দরজা

কাজী নজরুল ইসলাম গদ্য লিখেছেন-বেশ। তার গদ্যের এলাকাটা কম বিস্তৃত নয় এবং গদ্যের সঙ্গে তার সৃজনশীলতার কর্ম বিশেষভাবে সম্পর্কিত হয়ে আছে। তার লেখক জীবনের প্রথম রচনা ছিল- ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ যা গল্প, তার লেখক জীবনের শুরুতে লেখা। শুরু থেকে লেখা এসব গদ্য তার লেখক সত্তার অনেকটা অংশ অধিকার করে রেখেছে। নজরুলের লেখক সত্তার পরিপূর্ণ দিককে আবিষ্কার করতে হলে- তার গদ্যকে অবহেলার চোখে দেখলে চলবে না বরং সম্পূর্ণ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। অথচ নজরুলের গদ্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শুধু উপেক্ষিত হয়নি- এক্ষেত্রে এক ধরনের সীমাবদ্ধতাও লক্ষ্য করা যায়, যার জন্য তার গদ্য পাঠকের কাছে অপরিচিত হয়ে আছে অনেকাংশে। কাজী নজরুল ইসলামের লেখক জীবনের স্বল্প পরিসরে সৃষ্টিশীল তিনটি উপন্যাস-‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যু-ক্ষুধা’, ও ‘কুহলিকা’। গল্প গ্রন্থ তিনটি- ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদ’ ও ‘শিউলী মালা’। নাটক তিনটি-‘ঝিলিমিলি’, ‘আলেয়া’ ও ‘মধুমালা’। এছাড়া কিশোর নাটক দুটি। প্রবন্ধ গ্রন্থ পাঁচটি। এছাড়াও আরও গদ্য লেখা রয়েছে কয়েকটি স্তরে। উল্লিখিত এতগুলো গদ্য লেখা কি একেবারে সংখ্যায় কম? অবশ্য নয়। কিন্তু শুধু সংখ্যা পরিমাপ করা নয়, সামগ্রিক দিক থেকে তার উল্লিখিত গদ্য লেখা বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বল। নজরুল যে সময়টায় লিখেছেন এবং সে সময়ের সামাজিক অবস্থানে থেকে যা দেখেছেন, যা বুঝেছেন- তাই লেখার মধ্যে টেনে এনেছেন। নিজের সময়কে অস্বীকার করেননি বলেই মানুষকে গ্রহণ করেছেন মুখ্যরূপে এবং সকল অন্যায়, সকল অবিচার, সকল অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি আপোসহীন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বিদ্রোহ সত্তার সেসব বৈশিষ্ট্য- তা তার লেখার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে আছে। সেই কারণে তাঁর সাহস ও আবেগ, অকৃত্রিম গতিশীলতা ও নিজস্ব চেতনা বিশেষভাবে তার গদ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এই সব বৈশিষ্ট্য ক্ষুদ্র পরিসরে সীমাবদ্ধ করা যায় না। এই সব বৈশিষ্ট্যের জন্য তার গদ্য লেখা স্বকীয় এবং আলাদাভাবে চিহ্নিত হতে পারে। বস্তুত একেকজন সৃজনশীল লেখকের লেখা একেক রকম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে থাকে। এসব দিক থেকে বিচার-বিবেচনা করে তার গদ্য লেখার মূল্যায়ন স্থির হওয়া দরকার বলে মনে হয়। নজরুলের তিনটি উপন্যাস এবং এই তিনটি উপন্যাসের তিনটি চরিত্র-‘বাঁধনহারা’র নুরুল হুদা, ‘কুহেলিকা’র জাহাঙ্গীর ও ‘মৃত্যুক্ষুধা’র আনসার নজরুলের প্রতিকৃতি হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে যেন। নজরুল চরিত্রের যে রোমান্টিকতা-স্বাদেশিকতা-মানবতাবোধ রয়েছে, তা এই তিনটি চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘বাঁধনহারা’য় যে সৈনিক-জীবনের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে-তা উল্লেখযোগ্য এবং বিরল। ‘কুহেলিক’ার কাহিনী সন্ত্রাসবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এসব উপন্যাসে আঙ্গিকগত দুর্বলতা রয়েছে ঠিক কিন্তু কিছু চরিত্র এবং সামাজিক অবস্থানকে যেভাবে উপন্যাসে উপস্থাপন করা হয়েছে-তা একবারে মূল্যহীন নয়। কেননা, যা কিছু বৈশিষ্ট্য এসব লেখায় রয়েছে তা সময় ও নজবুলের চেতনা মূল্যায়নে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়। নজরুলের আঠারোটি গল্প। এসব গল্পের বেশিরভাগই প্রেমের গল্প। গল্পে অতি করুণ রস সঞ্চারিত হয়েছে। ‘রাজবন্দীর চিঠি’, ‘স্বামীহারা’, ‘রাক্ষুসী’, ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’, এবং ‘শিউলীমালা’ এই পাঁচটি গল্প ছাড়া অন্য গল্পগুলোতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রেমের দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘ঘুমের ঘোরে’ এবং ‘হেনা’ গল্পে ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হয়েছে প্রেম ও কর্তব্যের সংঘাতের মধ্য দিয়ে। গল্পগুলোর এক ধরনের চমক ও উজ্জ্বলতা পাঠকের মনকে আকৃষ্ট করে। ছোট গল্পে হয়তো নজরুল খুব বেশি সাফল্য অর্জন করেননি তবে গল্পে তার ব্যক্তি মানস, দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনকে দেখার প্রেক্ষাপট আমরা আবিষ্কার করতে পারি। নজরুল ইসলামের নাটকে গভীর বাস্তবধর্মী অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। এক ধরনের গতিময়তার প্রাবল্য তার নাট্যরসকে নিয়ন্ত্রিত করেছে, যদিও গীতিময়তার জন্য তাঁর নাটক বেশ টানে। এটাও একটা গুণ অস্বীকার করা যায় না। রূপক-সাংকেতিক নির্ভর নাটকে ভিন্নমাত্রার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। মোটামুটি নাটকগুলোতে তার সৃজনশীলতার উপস্থিতি অবহেলাপূর্ণ নয়। নজরুল ইসলামের প্রবন্ধের সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবুও প্রবন্ধগুলো উল্লেখযোগ্য এবং বিশিষ্ট। ‘নবযুগ’ ও ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় তাঁর যেসব প্রবন্ধ সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশ পেয়েছিল, সেগুলো প্রবন্ধ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এসব প্রবন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, সাহস, রাজনৈতিক চেতনা, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালবাসা ও বিশ্বাস যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে তা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এবং অনেকাংশে বিরল। এসব প্রবন্ধ শুধু শিল্পগুণে নয় বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য টিকে আছে ও টিকে থাকবে। রুদ্র মঙ্গলের অন্তর্গত ‘রুদ্রমঙ্গল’ প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন-‘জাগো, জনশক্তি! হে অমর অবহেলিত পদপিষ্ট কৃষক আমার মুটে-মজুর ভাইয়েরা! তোমার হাতের ওই লাঙ্গল আজ বলরাম-স্কন্ধে হালের মতো ক্ষিপ্ত তেজে গগণের মাঝে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক। এই অত্যাচারীর বিশ্ব উপড়ে ফেলুক-উল্টে ফেলুক! আন তোমার হাতুড়ি ভাঙ্গ ওই উৎপীড়কের প্রাসাদ-ধুলোয় লুটাও অর্থপিশাচ বলদর্পীর শির। ছাড় হাতুড়ি চালাও লাঙ্গল উচ্চে তুলে ধর তোমার বুকের রক্তমাখা লাল ঝান্ডা !’ এসব প্রবন্ধে রাজনৈতিক চেতনা, স্বচ্ছ ভাবাবেগ ও গভীর মানবপ্রেমের উদ্ভাস পাঠকের মনকে দারুণভাবে আকর্ষণ করে-যা গুরুত্বহীন নয়, বিভিন্ন বিবেচনায়। উল্লিখিত ক’টি স্তবকে নজরুলের উপন্যাস, গল্প, নাটক ও প্রবন্ধের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত দিক তুলে ধরা হলো, কারণ-যে নজরুল তো গদ্যও লিখেছেন, তা যেন কাছে টেনে নিই, এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা করি ও বিশ্লেষণ করি। আর তাহলে তার লেখার আরও বিভিন্ন দিক ও তার অন্তর সাধনার দিকগুলোও বিভিন্ন পরিধি নিয়ে বুঝতে পারবো। বিশেষত নজরুলের গদ্যকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার-বিবেচনা করা দরকার, একবারে অবহেলাার ধুলোয় ফেলে রাখা ঠিক নয়। পুরনো সাহিত্য বিচারে তার গদ্যকে মূল্যায়ন করলে হয়ত অনেক দিকই আবিষ্কার হবে না। নজরুলের মতো প্রতিভাপূর্ণ লেখকের গদ্যকে আবিষ্কার করতে হলে নতুন শিল্প-বিবেচনার শর্ত আরোপ করতে হবে, আর তাহলে নজরুলের গদ্যকে আমরা নতুনভাবে অনেকাংশে আবিষ্কার করতে পারব। আর এভাবেই নজরুলের গদ্য- সাহিত্যের অনেক বন্ধ দরজা খুলে যাবে-চোখের সামনে।
×