ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কাঠিরা

প্রকাশিত: ১০:২২, ২ মার্চ ২০১৯

 কাঠিরা

বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের ছোট একটি গ্রাম কাঠিরা। স্বাধীনতার পূর্বে একটি সাধারণ হাটবাজার ছাড়া আগৈলঝাড়ার পরিচয় দেয়ার মতো বিশেষ কিছু ছিল না। কাঠিরা ছিল খুব সাধারণ একটি গ্রাম, যা চারদিক থেকে বিল দিয়ে ঘেরা। তাই কাঠিরাকে প্রত্যন্ত বিলাঞ্চলই বলা যায়, যেখানে বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া চলাচলের আর কোন পথ ছিল না। যদিও পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের সময় কাঠিরায় ফসলের মৌসুম চলছিল, ফলে চাষের জমি পেরিয়ে গ্রামে ঢোকা তেমন কোন কঠিন কাজ ছিল না রাজাকার বা পাকিস্তান আর্মির জন্য। কাঠিরায় গণহত্যা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ৩০ মে। এর একদিন আগে, ২৯ মে শনিবার ছিল গ্রামের সাধারণ হাট বসার দিন। দিনটিতে হাট ছিল লোকারণ্য। জলিল খাঁ নামে এক রিক্সাচালকের কাছ থেকে জানা যায়, সেদিন দুপুর আড়াইটা নাগাদ প্রফুল্লআরিন্দা নামে এক শান্তিবাহিনীর সহায়তাকারী ৪০টি রিক্সা ভাড়া করেছিল গৌরনদী যাওয়ার জন্য। পরদিন রবিবার খুব ভোরে এই রিক্সাগুলোয় মিলিটারিরা গৌরনদী থেকে কাঠিরা গ্রামে আসবে- এমন খবরে সন্ধ্যার আগেই হাট ভেঙে যায়। গ্রামের মানুষ চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে সারা রাত জেগে থাকে। ৩০ মে সকাল আনুমানিক ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে কাঠিরার পূর্ব-উত্তর কোণ বরাবর অবস্থিত ঘোড়ারপাড় গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে কাঠিরা গ্রামে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় পাকিস্তানী মিলিটারি, যাদের প্রধান সহযোগী ছিল প্রফুল আরিন্দা। পূর্ববর্তী দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রফুল আরিন্দার সঙ্গে গ্রামের খ্রীস্টান ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং প্রফুল আরিন্দা তাঁর ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই সে পাকিস্তানী আর্মিকে নানাভাবে সহায়তা করে এবং গ্রামটিতে নিয়ে আসে। সেদিন ‘বাঁচা যাবে’- এই আশায় গির্জাঘরে আশ্রয় নিয়েছিল অগণিত হিন্দু-মুসলিম। তারা আস্থা রেখেছিলেন গির্জায় উপস্থিত মাইকেল সুশীল অধিকারীর ওপর। গির্জার বেদিতে উপাসনা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই গির্জা প্রাঙ্গণের পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর দুটি দল এসে গির্জার চারপাশ ঘিরে ফেলে। আসার পথে তরুণ সেনপাড়ার অনেক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ও অসংখ্য গ্রামবাসীকে হত্যা করে। গির্জার চারকোণে তারা চারটি বড় আকারের মেশিনগান তাক করে রাখে প্রতিরোধ ঠেকানোর জন্য। পাকসেনারা একটি ঘরে এতজন নারী-পুরুষ দেখে ভেবেছিল হয়তো মুক্তিবাহিনীর খোঁজ পাবে। একসময় তারা বেছে বেছে শক্ত সমর্থ তরুণদের লাইনে দাঁড় করায়। কয়েকজন সেনা মহিলাদের গায়ে-তলপেটে লাথি মারে। মাইকেল সুশীল অধিকারীকে লাথি দিয়ে ফেলে দেয় একজন, তার ক্যাসাকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেখে কোন অস্ত্র লুকানো আছে কী না। ‘ইধার হিন্দু হ্যায়?’- পাক সেনাদের এমন প্রশ্নে সুশীল অধিকারী দৃঢ়ভাবে উত্তর দিলেন, ‘এখানে সকলেই খ্রিস্টিয়ান, নমো’। পাকিস্তানী সেনারা কি বুঝেছিল সেদিন এই কথায় তা কারও জানা নেই, তবে এই উত্তরে প্রাণ বেঁচে গিয়েছিল কয়েক শ’ হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টানের। মাইকেল সুশীল অধিকারী বলেন, ‘আমি সবাইকে বাঁচাতে পারিনি। শ্যামকান্ত আহাম্মকের মতো প্রাণ দিল পাটক্ষেত থেকে মাথা উঁচু করে দেখতে গিয়ে। সতীশের বাবাকে নিষ্ঠুরভাবে মারলো, তারপর সতীশ মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিল। এক বৃদ্ধ, যার ঘর থেকে বের হবার মতো শক্তি নেই- তাকে ঘরের সঙ্গে পুড়িয়ে দিল। রাইচরণকে হত্যা করল। ঘরের পর ঘর পোড়াল, কেড়ে নিল মা-বোনের ইজ্জত। পঞ্চাশ জনের ওপর খানসেনা নির্দয়ভাবে হত্যা করল।’ পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতার অন্ত ছিল না, তারা পঞ্চাশটিরও বেশি ঘর পুড়িয়েছিল শুধু কাঠিরাতেই। খোলা জমি দিয়ে পালাতে গিয়ে এক মহিলা গুলিতে নিহত হন, তার কোলে থাকা ৫-৬ মাসের শিশুটি অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর গ্রামবাসী শিশুটিকে মৃত মায়ের বুকের দুধ খাওয়া অবস্থায় উদ্ধার করে। কাঠিরার গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পড়ুন ‘১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ থেকে প্রকাশিত গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘন্ট গ্রন্থমালা সিরিজের ‘কাঠিরা গণহত্যা’ গ্রন্থটি। গ্রন্থটির লেখক হিমু অধিকারী এবং প্রকাশকাল পৌষ ১৪২১/ডিসেম্বর ২০১৪।
×