ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ আনোয়ারুল কাদির

স্মরণ ॥ খান সাহেব আফজাল

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ২৭ অক্টোবর ২০১৮

স্মরণ ॥ খান সাহেব আফজাল

কিছু মানুষ আছেন যারা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকেন। তাঁর কর্মই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। খান সাহেব মোহাম্মদ আফজাল ছিলেন তেমনি একজন। সততা, মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালবাসা, আর্তের সেবা সহায়তার জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। মোহাম্মদ আফজাল নওগাঁ জেলার বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক, সমাজসেবী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর জন্ম নওগাঁ জেলার রানীনগর উপজেলার খট্টেশ্বর-রানীনগর গ্রামে। তিনি আমার শ্রদ্ধেয় পিতা। আমার দাদা সরদার আমিরউদ্দীন আহম্মেদ তখন রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার এবং সাহিত্যিক ছিলেন। আমার দাদা (পিতামহ) কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘বাসনা’ এবং ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। তিনি ১৯১৪ সালে নওগাঁ কৃষ্ণধন হাইস্কুল এবং ১৯১৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে যথাক্রমে এনট্রেন্স (ম্যাট্রিকুলেশন) এবং আইএ উভয়ইতে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি তদানিন্তন বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মিলিটারি কোরে সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ দেন এবং পরে দাদার অনুমতিতে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। ব্রিটিশ শাসনকালে মাগুরায় ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন বাবা যশোহর জেলায় মাগুরা শহরে মাগুরা কলেজ (বর্তমান সরকারী) এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি নওগাঁ কৃষ্ণধন হাইস্কুলের সেক্রেটারি স্বগ্রাম খট্টেশ্বর-রানীনগর প্রাইমারি স্কুলের ও রানীনগর পাইলট হাই স্কুলের সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া তিনি রানীনগর শেরে বাংলা কলেজ এবং ঐতিহ্যবাহী নওগাঁ প্যারীমোহন সাধারণ পাঠাগারে সভাপতি, নওগাঁ ডিগ্রী কলেজ ও নওগাঁ বিএমসি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। উল্লেখ্য, তদানিন্তন পাক-ভারতের বড়লাট জাঁকজকমপূর্ণভাবে বেঙ্গলের রাজধানী সিমলায় গবর্নর হাউসে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে উপধিপ্রাপ্তদের বাবাকে ‘খাঁন সাহেব’ টাইটেল সার্টিফিকেটসহ একটি ভারি সোনার মেডেল দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। তিনি অধুনালপ্ত পূর্ব পাকিস্তান ‘লেখক সংঘের’, পূর্ব পাকিস্তান গ্রন্থাগার সমিতি এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা আকরম খাঁন, কাজী আব্দুল ওদুদ, ‘মুসলিম ভারতের’ সম্পাদক আফজালুল হক, অন্নদা শংকর রায় প্রমুখ প্রবীণ সাহিত্যিকদের সহচার্য এসেছিলেন। সরকারী চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি নওগাঁর ইউনাইটেড প্রেস অব পাকিস্তান (ইউপিপি) সংবাদ সংস্থার নিজস্ব সংবাদদাতা ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বকাল পর্যন্ত তিনি নওগাঁ মহকুমা সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে চিঠি কলামে বিভিন্ন বিষয়ে ইংরেজী ও বাংলায় নিয়মিতভাবে পত্র লিখে বেশ সুনাম অর্জন করেন। তিনি চার বছর যাবত নওগাঁ থেকে প্রকাশিত ‘নব দিগন্ত’ মাসিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫০-১৯৫২ সালে দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ির বাসায় পাক-ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফুটবল খেলোয়াড় জাদুকর আব্দুস সামাদ আমাদের বাসায় বেশ কয়েকবার পরিবারসহ অবস্থান করেছিলেন। ফলে আমাদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে গড়ে উঠেছিল। দিনাজপুরের ঐতিহাসিক বড় মাঠে শত শত দর্শকদের উপস্থিতিতে বাবার সঙ্গে জাদুকর সামাদের ফুটবল খেলা দেখেছিলাম এবং সে দৃশ্য আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। দিনাজপুরে মির্জা গোলাম হাফিজ (পরে জাতীয় সংসদের স্পীকার), কমরেড হাজী দানেশ ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ নূরুল হুদা কাদের বক্স ওরফে ছুটি ভাই বালুবাড়ির বাসায় বেশ বেড়াতে আসতেন। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির ভয়াবহ ঘটনাগুলো বাবা আমাদের শুনিয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে নওগাঁ শহরে শোকের ছায়া পড়েছিল। মৃত্যুর পরে নওগাঁ জেলা প্রশাসন ও রানীনগর উপজেলা প্রশাসন নওগাঁর কৃতী সন্তান মরহুম খাঁন সাহেব আফজালের স্মরণে এ যাবত একটি সড়ক বা প্রতিষ্ঠান নামকরণ করা হয়নি। তাঁকে নওগাঁ গোরস্তানে দাফন করা হয়। আজ ২৭ অক্টোবর, ৪৩তম বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। বাবা নেই। স্মৃতিগুলো আজও অমলিন। লেখক : খান সাহেব আফজালের ছেলে
×