তিনটি কবিতা
সরকার মাসুদ
পানি
মৃত্যুর একটু আগের বিহ্বল ভাবনার মতো
আলোছায়াদীপ্ত জলাশয়Ñ হায় পানি
শুধু বেঁচে থাকার জন্য মেনে নিয়েছি, মানি
তোমার সব ছলাকলা
তোমার সজল ফণা
সন্ধ্যার মুখে তোমার আপাতসুবোধ রূপ!
ভালো লাগে পানির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ভোরের সূর্য
ভালো লাগে না কারখানার কটুগন্ধী প্রস্রাব
ভালো লাগে দিগন্তের টলটলে পানি থেকে উঠে আসা
সকালের পাখি
এত শান্ত সুন্দর মনোতোষ পানি
দোষ ধরে ধরে আমরাই তাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছি
আমরা তাকে নষ্ট করেছি, পথভ্রষ্ট করেছি;
খাল আর নদীর পারের বন-জঙ্গল কোন সুতায় বাঁধা
তারা কি দিয়েছিল, কি দিতে পারে কিছুই মনে রাখিনি।
** দানবিক সময়ের শস্য
মাসুদ অর্ণব
লাল বললেই বুঝি বাংলার মাটি
কালো বললেই বুঝি বাংলার আকাশ।
খরার ক্ষিপ্রতা কিংবা অতিবৃষ্টির উত্তেজনা
দাঁতাল রোদের দুপুর কিংবা তাগড়া অন্ধকার
সবকিছুই আমাদের দানবিক সময়ের শস্য।
আমরা যেন মহাসমুদ্রে দিকভ্রান্ত নাবিক
স্বপ্নহীন সন্ধ্যায় চড়ে শিশু-সূর্যের হাসিতেও
আমাদের চোখের ক্যানভাসে রুগ্নস্বপ্ন।
সময়ের নিজস্ব কোনো রঙ নেই
আমরাই সময়কে রাঙাতে পারি বোধের রঙে।
** হৃদয় তন্ত্রীতেবাজে শোকের সানাই
নাহার আহমেদ
সেদিন ভোরের পাখিদের কোলাহল কেউ শুনেনি।
শুনতে পাইনি সুরের বন্দনা
কিন্তু শুনেছিল প্রচ- গর্জন কামানের
বুক ঝাঁঝরা করার নিষ্ঠুর আর্তনাদ
আততায়ীদের উল্লাসে সেদিন থমকে গিয়েছিল
ভোরের বাতাস।
সূর্য ওঠাও হয়তো
হত্যাযজ্ঞের নায়করা রেখে গেল
নির্দয় আর নিমর্মতার স্বাক্ষর।
বত্রিশ নম্বরে সেই বাড়িটার অন্দর মহলে
কলঙ্কিত করে গেলে স্বাধীতার পবিত্রতাকে
সাত কোটি বাঙালীর পথ প্রদর্শক, আদর্শের প্রতীক
রক্ত পিপাসু শকুনের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হলো।
জাতি নির্বাক, প্রতিবাদের ভাষা সেদিন হারিয়ে ফেলেছিল
ইতিহাসের কুঠারে দ্বিখ-িত করা হোক, সভ্যতাকে
রক্তের সিঁড়ি বেয়ে সে যেন আজ ক্লান্ত।
নিহত গোলাপের শোকে মূহ্যমান বাঙালী জাতি
পাপড়ির আর্তনাদে হৃদয় তন্ত্রীতে বাজে
শোকের সানাই।
রক্তের কালিতে লেখা হলো নৃশংসতার অভিধান
জাতির জনকের রক্তাক্ত নিথর দেহটা
ইতিহাস লিখে গেল মীরজাফরদের,
তার প্রতিটা রক্তকণায়।
যার যন্ত্রণার ভার বহন করবে
বাংলার এই মাটি, অনন্তকাল ধরে।
** সংকেত
একদিন ক্লান্ত মানুষ উদয়াস্ত যন্ত্রণা যাপন করে
সন্ধ্যাবেলা নিরিবিলি রেডিও খুলেছে খালের ধারে
সে সময় কালভার্টের নিচে পানি চোষে শুকনো ক্ষেত
পানি রহস্য, পানি জীবনের উষা, পানি অন্ধকারে
প্রশ্নবোধক হারিকেন! তার কালো হয়ে আসে শিখা
কালো হয়ে আসে কাচ; চারদিকে টর্নেডৈা-সংকেত।
** ভ্রান্তি
কেন যে এতকাল আমি বউন্না ফলকে ভেবেছি কতবেল
রাজকন্যাকে রিকশা চালকের মেয়ে!
নতুন প্রেমের দাগ লেগে আছে গলায় চিবুকে
তাকে হায়েনার আঁচড় ভেবে দেখেছি চেয়ে চেয়ে
যা মনে হয় আর যা বাস্তব
তার ভেতরের পার্থক্য বুঝতে পেরেছি হুল ফোটার দিন
নতুনত্বপ্রিয় লোক এক ভুল থেকে যায় আরেক ভুলের দিকে
যতক্ষণ-না কাশফুল মেঘ থেকে ঝরে কান্নাফোঁটা!
রেলপথের দুটি রেল দিগন্তরেখার কাছে এক হয়ে যায়
কতবেলের মুখোস পরে বউন্না ফল কেবল ঝিমায়।