ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রহিম আবদুর রহিম

অভিমত ॥ বন্দী জীবনের মুক্তির স্বাদ আশা-নিরাশার ৪ বছর

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩০ জুলাই ২০১৮

  অভিমত ॥ বন্দী জীবনের মুক্তির স্বাদ আশা-নিরাশার ৪ বছর

বহুদিনের সীমান্ত জটিলতা। বাংলাদেশ-ভারতের অভ্যন্তরে থেকে যাওয়া ভূ-খ-ের অধিবাসীরা ছিল রাষ্ট্রীয় অধিকার বঞ্চিত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের ভূমির পরিমাণ ১৭১৫৮.১৩ একর। যেখানকার সর্বশেষ লোক সংখ্যা (২০১০-২০১৫ হিসাব অনুযায়ী) ৩৪ হাজার। অপরদিকে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলের সংখ্যা ৫১টি ছিটমহলের জমির পরিমাণ ৭১১০.২ একর। লোকসংখ্যা ১৭ হাজার। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সারা পৃথিবীতে ছিটমহলের সংখ্যা ২৭৬টি। এর মধ্যে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশগুলোর ছিটমহলের সংখ্যা ১১৫টি। যে সমস্ত ছিটমহলের সমস্যা এ যাবত সমাধান হয়নি। শুধু ভারত উপমহাদেশের ছিটের সংখ্যা ছিল ১৬২টি। তৎকালীন এই ১৬২টি ছিটমহলের ৫১ হাজার জনমানুষ সকল প্রকার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিল। এই ভূ-খন্ডের মানুষরা কারণে-অকারণে, সময়ের ব্যবধানে তাদের জীবন হারিয়েছে দুর্বৃত্তদের কষাঘাতে। ৬৮ বছরের ব্যবধানে প্রায় ৩শ’ জন খুন হয়েছে। বিচার হয়নি কোন হত্যাকান্ডের। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় এই হতভাগ্যদের। নীরব সবর আন্দোলন চলে রাজপথ, মাঠে, ময়দানে এবং সাংস্কৃতিক মঞ্চে। সমষ্টিগত দাবি চাই রাষ্ট্রীয় অধিকার চাই মানবতা। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে উভয় দেশের ১৬২টি ছিটমহলের জনমানুষেরা রাষ্ট্রীয় অধিকার আদায়ের জন্য অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশের কৃষ্টিকালচার, রাজনৈতিক, সামাজিক আচার-আচরণ সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতীয় সকল প্রকার অনুষ্ঠানাদি পালন করা শুরু করেন। এর মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় দিবসসমূহ পালন করা। অপরদিকে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে বসবাসরত জনমানুষেরা ভারতের সাংস্কৃতি লালন করে তারাও ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস, ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে ওই দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে মূলধারায় মিশে যাওয়ার বহির্প্রকাশ ঘটান, যা এক প্রকার অভিনব আন্দোলনের ধারা বলে অনেকের বিশ্বাস। ২০১১ খ্রিস্টাব্দ সেপ্টেম্বরে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, ঢাকা সফরে এসে সীমান্ত জটিলতা নিরসনে প্রটোকল স্বাক্ষর করেন। স্বাক্ষরিত প্রটোকল বাস্তবায়নে উভয় দেশের ছিটমহলবাসীরা কোমর বেঁধে মাঠে নামেন। দেশ বিদেশের মানবাধিকার কর্মী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গগণ ছিটমহলবাসীদের দাবি-আন্দোলনের পক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার হাত বাড়ান। এতে করে তাদের আন্দোলনের সারসংক্ষেপ উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় মগজে সাড়া পড়ে। ’৭৪-এর মুজিব ইন্দিরা চুক্তি হাওয়ার পর পরবর্তী কোন সরকারই চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক না থাকায় যা দীর্ঘ ৪৪ বছরের ব্যবধানে আলোরমুখ দেখেনি। ফলে অর্ধলাখ মানুষকে যেমন খেসারত দিতে হয়েছে; তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিবেকের রক্তক্ষরণ ঘটেছে অহরহ। গত ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের শেষে দিকে নিউওয়ার্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘বিশ্ব মানবতা রক্ষা’য় ছিটমহল তথা স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হন। ফলে ২০১৪ সালে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার ৬৮ বছরের ঝুলে থাকা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরই সূত্র ধরে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ৬ মে ভারতের পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে স্থল সীমান্ত চুক্তি পাস করে বিশ্ব মানবতায় উভয় দেশের সরকার নতুন মাত্রা যোগ করে। ওইদিন থেকে মাত্র ৮৫ দিনের ব্যবধানে ৩১ জুলাই দিবাগত রাত ১২টায় দীর্ঘ ৬৮ বছরের বন্দী জীবনের মুক্তি ঘটে অর্ধলাখ জনমানুষের। ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা পূর্ণ হচ্ছে মুক্তি জীবনের ৪ বছর। এই চার বছরের আশা-নিরাশার খ-কাহিনীর শতসহস্র, দুঃখ-বেদনা, ঘাত প্রতিঘাতের জনবসতিদের চাওয়া-পাওয়ার নিঃসন্দেহে পূরণ হচ্ছে। ১৯৯৬ সালের তালিকা অনুসারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ছিল ৫৯টি। পঞ্চগড় জেলায় ছিল ৩৬টি। পক্ষান্তরে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহল ৫১টি। যেগুলোর অবস্থান ভারতের কুচবিহার জেলায়। বাংলাদেশ ভারত সরকারের চুক্তি অনুযায়ী জায়গা জমি বিনিময়ের প্রাক্কালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহলগুলো থেকে মোট ৯২১ জন ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। ভারত থেকে কোন জনমানুষই বাংলাদেশে আসেনি। উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় অধিকারপ্রাপ্ত জনমানুষদের জীবন চলার আগডাল-আপডালের খ- কাহিনী জানার আগ্রহ বিবেকবানদের। নব্য বাংলাদেশীদের অধিকার কাকে বলে, তা বর্তমান সরকার স্পষ্ট করে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে। বিনিময় পরবর্তী বর্তমান সময়ের সরকার নব্য বাংলাদেশীদের জন্য মাত্র ২শ’ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছিলেন অথচ উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, চিকিৎসা কেন্দ্র, বয়স্ক ভাতা, বিদ্যুতায়ন শতভাগ নিশ্চিত করা হয়েছে। কর্মক্ষম পরিবার গঠনে জিও, এনজিও’র সকল প্রকার প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করতে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে তাদের যথাযথ সম্মান দেখানো হচ্ছে। তবে অতি উন্নয়নে আত্মহারা নব্য বাংলাদেশীদের কর্মকান্ডে। স্কুল-কলেজ করার নামে কিছু মানুষ ডোনেশন ব্যবসায় কোমর বেঁধে নেমেছে। যা নিয়ে হাসি-তামাশা কম হচ্ছে না। অপরদিকে নব্য ভারতীয়দের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ৯৮০ কোটি টাকা উন্নয়ন বরাদ্দ ঘোষণা করার পরও কচ্ছপ গতিতে চলছে উন্নয়নের কাজ। যার ফলে ৪ বছরের ব্যবধানে উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়নি। রাস্তাঘাট সংস্কার ও কিছুটা বিদ্যুতায়ন হলেও গড়ে ওঠেনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড পেয়েছে নব্য ভারতীয়রা। পায়নি স্বাস্থ্য কার্ড। বিনিময় হওয়া জায়গা জমি রাষ্ট্রীয়ভাবে রেকর্ড হয়েছে বটে তবে ভোগদখলকারীদের মাঝে দলিলপত্র এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও যথেষ্ট নড়বড়ে। বাংলাদেশের দাশিয়ারছড়া থেকে ভারতের দিনহাটা পাড়ি জমানো মৃণাল বর্মণের ষোড়শী মেয়ে সম্প্রতি নিখোঁজ হয়েছে। যাকে এখনও পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি। অপরদিকে বাংলাদেশের নব্য বসতিরা রয়েছেন রাজারহালে। নব্য ভারতীয় সাধারণ মানুষদের আশা-নিরাশার গল্প যাই থাকুক না কেন! জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সমর্থনকারী নেতাকর্মীরা। বন্দীদশা থেকে মুক্ত নব্য ভারতীয়দের জন্য ভারত সরকারের আবাসিক ‘ফ্ল্যাটবাড়ি’ প্রকল্প নিয়েছে ভারত সরকার। যা অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে বলে ভারত সরকার সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই প্রকল্পের ভাবী ভুক্তভোগীরা একসময় কাস্তে, কোঁদাল, লাঙ্গল-জোয়ালের সংস্কৃতিতে বড় হয়েছে। হঠাৎ করে ইট-পাথরের আবাসন ভূমি কতটা যুক্তিযুক্ত এ গুঞ্জন সর্বস্তরে। লেখক : শিক্ষাবিদ [email protected]
×