অপরাজিতা : আমাদের সমাজে নারীদের অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকে। আপনার উঠে আসার গল্পটা বলুন- রোকেয়া প্রাচী : মিরপুর পল্লবীতে বড় হয়েছি। এমন একটা পরিবেশ ছিল তখন ছেলে মেয়ে পাড়া প্রতিবেশী মিলে সবাই এক সঙ্গে খেলাধুলা করতাম। গোল্লাছুট, হা-ডু-ডু, চোর পুলিশ। তখন ছেলে মেয়ে কোন ভেদাভেদ ছিল না। তবে আমার পরিবারের একটা প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়েছিল আমাকে নিয়ে যে মেয়ের গাঁয়ের রং কালো। পরিবারের সবাই খুব সুন্দর ছিল। আমি কালো হওয়ায় সবার মনে একই প্রশ্ন মেয়ে কেন কালো? নারী হিসেবে নয় আমার প্রথম প্রতিবন্ধকতা শুরু“হয় গাঁয়ের রং কালো। আমার বিয়ে হবে কি করে সকলের একই প্রশ্ন! আমাদের সময় স্কুলে অনেক প্রোগ্রাম করতাম। সেখানে গাঁয়ের রং নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি। ঘরের চার দোয়ালের মধ্য প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। তবে এর জন্য আমার বাবা কোন দিন কিছু বলেনি, যে কন্যাদ্বায়গ্রস্ত পিতা হওয়ার কথা। আমার বাবা সব সময় চেয়েছে মেয়েদের পড়ালেখা করে স্বাবলম্বী হতে হবে। নারীমহলে আত্মীয় মহলে প্রতি মুহূর্তে আমাকে নিয়ে গসিপ হত। এটা আমাকে ভীষণভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। আমি আমার গন্ডিতে আমার মতো করে বেড়ে উঠতে থাকলাম। আমার জায়গা আমি তৈরি করে নিয়েছি। আমাদের বাল্যকালে বিভিন্ন উৎসব পালন করতাম মেয়েরা মিলে। এবং চাঁদা তুলে পাড়ায় লাইব্রেরিও করে ছিলাম। এত কাজের মধ্যে ওই প্রতিবন্ধকতা আমাকে দমাতে পাড়েনি।
অপরাজিতা : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে কিছু বলুন-
রোকেয়া প্রাচী : আমাদের দেশের নারীরা কিন্তু অনেক বেশি শক্তিশালী। আমাদের দেশের নারীদের কঠোর পরিশ্রম করার মনমানসিকতা আছে, তাদের সামর্থ্য আছে। আমাদের দেশের মেয়েদের ভেতর যদি আত্মবিশ্বাসটা যদি আমরা জাগ্রত করতে পারি এবং তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারি তবে মেয়েরা আরও বেশি সফলভাবে দেশ গঠনে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে, বলে আমি মনে করি। তাছাড়া নারীরা পিছিয়ে থাকার কোন কারণই নেই, যেখানে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, আমাদের দেশের স্পীকার একজন নারী, সেই খানে আমাদের দেশের মেয়েরা পিছিয়ে থাকবে বলে আমি মনে করি না।
অপরাজিতা : এখন তো সার্বিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। সবকিছুতেই নারীরা এগিয়েছে। এ বিষয়টি কেমন লাগে?
রোকেয়া প্রাচী : নিঃসন্দেহে ভাল, তবে আরও অনেক দূর যেতে হবে নারীদের। কাগজে-কলমে নারীরা সমান অধিকার পেলেও বাস্তবে কিন্তু ততটা স্বাধীন এখনও হতে পারেনি। তবে সব সেক্টরেই নারীরা কাজ করতে আসছে। নারীদের বিশ্বাসটা ক্রমশই উন্মুক্ত হচ্ছে- এটা আমাদের জন্য আশার খবর।
অপরাজিত : কাজের ক্ষেত্রে বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন?
রোকেয়া প্রাচী : প্রচুর বাধা আছে। তবে কাজের ক্ষেত্রে বাধা থাকবেই। তবে সকল বাধা বিপত্তি পিছে ফেলে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। আমার জীবনে প্রতিটি কাজেই কোন না কোন বাধাগ্রস্ত হয়েছি। তবে আমাকে দমাতে পারেনি। কেউ যদি সততার সঙ্গে কাজ করে তাহলে তারে কেউ বাধা দিয়ে আটকাতে পারবে না। প্রথম কথা হচ্ছে আমি সততার সঙ্গে কাজ করতে চাই কি-না! যদি চাই তাহলে কেউ বাধা দিয়ে কিছু করতে পারবে না।
অপরাজিতা : নারী হিসেবে সমাজকে নিয়ে কী ভাবছেন?
রোকেয়া প্রাচী : নারী হিসেবেই সবচেয়ে বেশি ভাবা সম্ভব। আমাদের সমাজে নারীরা সবচেয়ে বড় মেকার। নারী প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। প্রতিটি মা শিশুকালে তার সন্তানকে শিক্ষা দেয় যদি যে নারীদের সম্মান দিতে হবে। এবং রাস্তাঘাটে ইভটিজিং করবে না। এ রকম শিক্ষামূলক বিভিন্ন বিষয়ে যদি প্রত্যেক মা তার সন্তানকে শিক্ষা দেয়। তাহলে এর চেয়ে বড় সমাজ সেবা কি আছে? আমি মনে করি নারীদের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি সম্ভব সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। একজন মায়ের সমাজে অনেক ভূমিকা আছে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
অপরাজিতা : রাষ্ট্র, সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। তবুও নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছেই। এ সহিংসতা কেন এবং নিরূপণের উপায় কি?
রোকেয়া প্রাচী : নারীর ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে ব্যাপক কাজ হচ্ছে। বর্তমান সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর উন্নয়নে মৌলিক অঙ্গীকার রয়েছে। নারীর অধিকার রক্ষায় তিনি যথেষ্ট আন্তরিক। তার আন্তরিকতার কারণেই নারীর অধিকার রক্ষায় বেশ কয়েকটি আইন তৈরি হয়েছে। নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ হচ্ছে। রাজনীতি, পেশাগত ক্ষেত্রে বড় বড় জায়গায় নারীরা স্বমহিমায় অবস্থান করছেন। সহিংসতা বাড়ছে তবে নারীর সংখ্যাও বাড়ছে। সংখ্যা যখন বাড়ছে এখন গণমাধ্যম বলতে পারে নারীরা সরব হয়েছে। আগে ধর্ষণ, সহিংসতা গোপনে চলে যেত সামনে আসত না। এখন সামনে আসে বলে সবাই জানতে পারছে। তবে এটা ০% এ চলে আসা উচিত। একজন নারীও যেন সহিংসতার শিকার না হয় তার জন্য পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন সবগুলোকে একসঙ্গে কার্যকার হতে হবে।
অপরাজিতা : নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপনার পরামর্শ কী?
রোকেয়া প্রাচী : আমার পরামর্শ হচ্ছে আমাদের এ কাজটা পরিবার থেকে করতে হবে। খাবার টেবিল থেকে শুরু করতে হবে। একটি স্কুল থেকে শুরু করতে হবে। একটা ১৮ বছরের ছেলেকে শোখানোর কিছু নেই। যা শেখে ছোটবেলাই শেখে। শিশুকাল থেকেই শিক্ষা দিতে হবে। প্রথম শিক্ষক মা। মাকে সচেতন করতে হবে। এবং তাকে সচেতন করতে হবে পরিবারকে। এবং স্কুল পর্যায়ে ক্যাম্পেইন করতে হবে। শিক্ষকদের সচেতন করতে হবে এ বিষয়ে। পাঠ্যসূচীর পাশাপাশি গল্প করে এ বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। স্কুলে বাচ্চারা শিখবে যে নারী-পুরুষ সমান। দুজনার সমতায় সমাজ দেশ সুন্দর হয়। নারীকে সম্মান করতে হয়। দেশের ইতিহাস জানতে হবে।
অপরাজিতা : নারী উন্নয়নে আমরা কোন পর্যায়ে?
রোকেয়া প্রাচী : নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ যে এগিয়ে গেছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। খুব উল্লোখযোগ্য অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দাঁড়িয়ে আছে নারীর উপর। কোন নারী কিন্তু বসে নাই। আজকের নারীরা বিভিন্ন ফরমেটে কাজ করছে। নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ আরও অনেকদূর এগিয়ে যাবে। নারী উন্নয়ন মানে বাংলাদেশের উন্নয়ন; প্রজন্মের উন্নয়ন।
অপরাজিতা : ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে নারী উন্নয়নে আপনি কিভাবে দেখতে চান?
রোকেয়া প্রাচী : আসলে বাংলাদেশকে নিয়ে তো আমাদের কারোরই তো স্বপ্নের শেষ নেই, এই বাংলাদেশ নিয়ে বলে আসলে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত শেষ করা সম্ভব হবে না। সবাই বাংলাদেশকে নিয়ে যেমন স্বপ্ন দেখে ঠিক তেমন আমিও দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত একটি পরিচ্ছন্ন সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। সকল জায়গায় নারীদের জাগরণ তৈরি হয়েছে।
মেয়েরা অশিক্ষিত কেউ নেই। নারী শিক্ষা এগিয়ে গেছে। কাজেই শিক্ষা সংস্কৃতি অর্থনৈতিক মুক্তি এ সবকিছু মিলে সমাজে নারীর ক্ষেত্রে জাগরণে মুক্তি ঘটছে। নারীর প্রতি এখন সহিংসতা করতে চেষ্টা করলে কেউ কিন্তু চুপ করে থাকছে না। সবকিছু আইনের আওতায় আসছে। এটা কিন্তু আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন।