ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সারাদেশে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান

বন্দুকযুদ্ধে জেনেভা ক্যাম্পের নাদিমসহ নিহত ২

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১১ জুলাই ২০১৮

বন্দুকযুদ্ধে জেনেভা ক্যাম্পের নাদিমসহ নিহত ২

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সারাদেশে চলমান মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে ঢাকার কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী বহুল আলোচিত উর্দুভাষী অবাঙালী নাদিম হোসেন ওরফে বেজি নাদিম ওরফে বোমা নাদিম ওরফে পঁচিশ ও ঢাকায় পাইলট বাবু নিহত হয়েছে। পঁচিশ ও পাইলট বাবু হত্যা, মাদক ও অস্ত্র আইনে দায়েরকৃত ২৭টি মামলার আসামি ছিল। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছে চার হাজার ইয়াবা, একটি শূটারগান, একটি পিস্তল ও ছয় রাউন্ড গুলি। নারায়ণগঞ্জে নিহত নাদিম কুখ্যাত ব্যবসায়ী ছাড়াও বোমা তৈরিতে দক্ষ ছিল। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে একাধিক বোমা তৈরির কারখানা স্থাপনের সঙ্গে জড়িত ছিল সে। ইতোপূর্বে তার দুইটি কারখানা থেকে শতাধিক তাজা বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছিল পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে। তার মৃত্যুতে উর্দুভাষী অবাঙালীদের মোহাম্মদপুর ক্যাম্পের বাসিন্দাদের অধিকাংশই খুশি। তাদের ভাষ্য, মাদকের কারণে তাদের ছেলে-মেয়েরা বিপথগামী হওয়াসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। তাই তারা সরকারের মাদকবিরোধী অভিযানের পক্ষে। অভিযান আরও জোরদার করার কথাও বলেন তারা। সোমবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে র‌্যাব নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান চালায়। র‌্যাব জানায়, সেখানে ইয়াবার চালান ভাগ-বাটোয়ারার খবর পেয়ে র‌্যাব অভিযানে যায়। এ সময় র‌্যাবের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের গোলাগুলি হয়। গোলাগুলি থেমে গেলে সেখান থেকে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয় ৪ হাজার ইয়াবা, একটি শূটারগান, একটি পিস্তল, ছয় রাউন্ড গুলি। র‌্যাব জানায়, দীর্র্ঘ সময় পর নিহত মাদক ব্যবসায়ীর পরিচয় শনাক্ত হয়। তার নাম নাদিম হোসেন ওরফে নাদিম ওরফে বেজি নাদিম ওরফে পঁচিশ (৩৫) বলে জানা যায়। সে ঢাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় ২ নম্বর ছিল। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় মাদকবিরোধী অভিযানের কারণে সে রূপগঞ্জে আত্মগোপনে ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মাদক ও অস্ত্র আইনে ১২টি মামলা আছে। যেভাবে নাদিম থেকে পঁচিশ নামে পরিচিত হয় ॥ নাম নাদিম হোসেন হলেও এ নামে তার পরিচিতি ছিল না। রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভাক্যাম্পে তাকে সবাই পঁচিশ নামে চিনত। বছরখানেক ধরে সে মানুষের কাছে নিজেকে সৎ মানুষ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। প্রতি শুক্রবারে মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়াত। দান করত। ক্যাম্পের গরিবদের মাঝে নিজেকে জনদরদি পরিচিত করতে যা করণীয় সবই করত। কখনও কখনও ক্যাম্পবাসীকে নিয়ে নেতৃত্ব দিত মাদকবিরোধী প্রচারে। এসবের আড়ালে তার আসল পেশা ছিল মাদক ব্যবসা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পঁচিশ রাজধানীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকাভুক্ত। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আয় করত মাদক ব্যবসা করে। পুলিশ সহজেই তার নাগাল পাচ্ছিল না। অনেকবার আত্মসমর্পণ করে মাদক ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাড়া পেয়েছে। ছাড়া পেয়েই আবার শুরু করত মাদক ব্যবসা। কেউ যদি তার ব্যবসায় বাধা হয়ে দাঁড়াত তাকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা ছিল না। ক্যাম্পবাসী জানান, মোহাম্মদপুর জেনেভাক্যাম্পেই পঁচিশের জন্ম। জন্মের পর মা-বাবা ছেলের নাম রাখেন মোঃ নাদিম হোসেন। ছোটবেলায় নাদিমের মা-বাবা মারা যান। সংসারে নাদিম ছাড়াও আরও দুই ভাই ও দুই বোন আছে। এক ভাই ও এক বোন প্রতিবন্ধী। অভাব-অনটনের কারণে ছোটবেলাতেই জেনেভাক্যাম্প এলাকার একটি হোটেলে কাজ করতে হয়েছিল তাকে। বেতন ছিল ২৫ টাকা। হোটেলে কাজ করতে করতে গাঁজা বিক্রি শুরু। সাদা কাগজে মোড়ানো এক পুঁটলি গাঁজা বিক্রি করত ২৫ টাকায়। হোটেলের বেতন আর গাঁজার দাম একই হওয়ায় নাদিমকে এলাকাবাসী ডাকতে শুরু করে ‘পঁচিশ’ নামে। একসময় নাদিম নিজেই ‘পঁচিশ’ নামে পরিচয় দিতে শুরু করে। এরপর থেকেই তার নাদিম নাম ছাপিয়ে পঁচিশ নাম ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে তিন আসামিকে আটক করার পর পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের যৌথবাহিনীর ওপর পঁচিশের সহযোগীরা হামলা চালিয়েছিল। এ সময় পঁচিশ নিজেই তিনটি বোমা নিক্ষেপ করেছিল যৌথবাহিনীর ওপর। পুলিশ ছয়টি গুলি ছুড়লে তার সহযোগীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার ইয়াবা ও মাদকসম্রাট ইশতিয়াকের পর গোয়েন্দাদের তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ছিল নাদিম হোসেন ওরফে পঁচিশ। নাদিম ইশতিয়াকের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করত। ইশতিয়াকের হয়ে সেই জেনেভাক্যাম্পে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। গত বছরের ৩ নবেম্বর মোহাম্মদপুরের জেনেভাক্যাম্প থেকে পঁচিশকে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। সেদিনের আলোচিত ওই অভিযানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সঙ্গে ছিল র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, এপিবিএন ও এনএসআইসহ অন্তত ২শ’ সদস্য। গ্রেফতারের ১২ দিন পর ১৫ নবেম্বর নিম্ন আদালত থেকে চারটি মামলায় জামিনে ছাড়া পেয়েছিল নাদিম। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ের আড়ালে মাদক ব্যবসা করত পঁচিশ। পঁচিশের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় হত্যাসহ ১২টি মামলা আছে। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মোহাম্মদপুরের জেনেভাক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের একটি বাড়িতে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে শাহীন ও সোমবার রাতে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত এই আলোচিত নাদিম আহত হয়েছিল। আহত দুইজন ছাড়াও আহত নাদিমের ভাই বশিরকে আটক করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের তথ্যমতে, বোমা তৈরি করে মজুদ রাখা ১শ’টি বোমা উদ্ধার হয়।
×