ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

ছোট কাগজ ॥ পাতাদের সংসার

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ২৯ জুন ২০১৮

ছোট কাগজ ॥ পাতাদের সংসার

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক কাগজ ‘পাতাদের সংসার’-এর চতুর্থ বর্ষ, ১৫তম সংখ্যা বের করা হয় বিদগ্ধ সমাজ ও রবীন্দ্র গবেষক আহমদ রফিককে নিয়ে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ পাওয়া এই সাময়িকী হারুন পাশার সম্পাদনায় পুরো পাঠকের সামনে আসে। পরিবেশকের দায়িত্বে পাঠক সমাবেশ এবং প্রচ্ছদ আঁকেন মাসুক হেলাল। বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি আহমদ রফিক এমন একজন চিন্তক যার নামটাই বহু বিশেষণের সমন্বয়। আলাদাভাবে তার নামের পূর্বে কোন কিছু বসানোর প্রয়োজনই পড়ে না। ‘পাতাদের সংসার’ তাকে নিয়ে কাজ করার যে তাগিদ এই ভাষাসৈনিকের পুরো জীবনাচরণ সেটাই দাবি করে। সঙ্গত কারণেই সম্পাদক হারুন পাশাকে সর্বাগ্রে সাধুবাদ এবং অভিনন্দন। সম্পাদকীয়তে সুর সংক্ষিপ্তভাবে এই রবীন্দ্রবোদ্ধাকে উপস্থাপন করে তার বর্ণাঢ্য জীবনের ওপর আলোকপাত করা হয়। ভাষা শহীদদের উৎসর্গ করা সাময়িকীটি শুরু করা হয় এই বর্ষীয়ান সমাজ গবেষক আহমদ রফিকের একটি সাক্ষাতকারের মাধ্যমে। এই আলাপচারিতাটি অত্যন্ত সুচিন্তিত, জ্ঞানগর্ভ এবং তার দীর্ঘ জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার স্বচ্ছ প্রতিবেদন। এমন অভিজ্ঞ আর বাস্তবচেতনাবোধের সঙ্গে মেধা, মনন ও সৃজনের যে চমৎকার অভিযোজন তা পাঠককে বিমুগ্ধতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাবে বললে অত্যুক্তি হবে না। স্কুল জীবন থেকে শুরু হওয়া মাতৃভূমির হরেক রকম ঘাত-প্রতিঘাতই শুধু নয় নানা বিপরীত ঘটনা ¯্রােতও স্বচ্ছ স্বাভাবিক জীবনকে কতভাবে আলোড়িত করেছে সে সব স্মৃতিকথায় কোন আক্ষেপ কিংবা দোলাচল স্থান পায়নি। সহজ সরল পথে চলতে গিয়ে মেধাবী ছাত্র আহমদ রফিক দেশজ কৃষ্টি সংস্কৃতির ধারা থেকে কখনই চ্যুত হননি। যদিও পরাধীনতার শৃঙ্খলে পুরো দেশ ছিল আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। ১৯২৯ সালে জন্ম নেয়া এই সমাজচিন্তক শৈশব-কৈশোরে অবলোকন করেছেন ’৪৭-এর অনাকাক্সিক্ষত। দেশ-বিভাগ। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ্্ কর্তৃক আদেশকৃত উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়ার অনভিপ্রেত ঘোষণা কিশোর রফিককে কতখানি সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল তা তার বিভিন্ন মননশীলতা আর সৃষ্টিযজ্ঞে মূর্ত হয়ে আছে। আর সরাসরি ভাষা সংগ্রামে সম্পৃক্ত হওয়া তো জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল আর ঐতিহ্যিক ঘটনা। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যার ছাত্র জীবন, শেষ অবধি পেশাগত পর্যায়কে সমৃদ্ধ করতে পারাটা এই বাম ধারার গবেষকের পক্ষে তা ছিল অসম্ভব। আর তাই চিকিৎসাবিদ্যা চূড়ান্ত করার পর চিকিৎসকের ভূমিকায় নামাও সম্ভব হয়নি। সাহিত্য, সংস্কৃতি আর দেশজ কৃষ্টি ঐতিহ্যের নিমগ্ন সাধক সবার ওপরে স্বদেশকেই ভাবতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সেই বোধে নিজের জীবন ও সংগ্রামকে পুরো সমাজের সঙ্গে একীভূত করতেও পিছপা হননি। অর্থ, বিত্ত কিংবা প্রতিষ্ঠার প্রতি কোন ধরনের মোহ কিংবা আসক্তি না থাকার কারণেও জীবনের রথকে অতখানি নিঃসংশয় করতে পারেননি। তবুও দেশাত্ববোধ আর সৃজন শক্তির নিরবচ্চিন্ন সম্পৃক্ততার পেশাগত জীবনে তেমন সফলতা না আসলেও চিন্তার জগতে নিজের আসন শুধু পোক্তই করেননি এক নিষ্ঠবান সমাজ গবেষক ও বিশেষজ্ঞের মতো সম্মানজনক অবস্থায় জোরালো ভিত্তি তৈরিও হয়েছে। ক্ষুরধার লেখনী কোন ঝড়-ঝাপটাকে তোয়াক্কা করেনি। দেশ, প্রকৃতি, মানুষকে উপজীব্য করে মননচেতনায় নিমগ্ন হয়েছেন, সৃজনবোধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছেন। পুরো সাময়িকীর বিভিন্ন লেখকের প্রবন্ধে যেমন আহমদ রফিকের এই দীর্ঘ জীবনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সংযোজিত হয়েছে পাশাপাশি নিজের জবানীতে তিনিও আদ্যোপান্ত সব ঘটনার সারবত্তা পাঠকের সমীপে হাজির করেছেন। বাংলার নির্মল নিসর্গ তার কবিতার অনুষঙ্গ হয়েছে, সঙ্গে সাধারণ মানুষ তার কবিসত্তাকে আলোড়িতও করেছে। সবচেয়ে বেশি শক্তি যুগিয়েছে তার অকৃত্রিম স্বদেশপ্রেম আর মাতৃভাষার প্রতি নিরন্তর দরদ। উপন্যাস লিখেছেন তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে তার সমাজ সচেতনমূলক অসংখ্য প্রবন্ধের নিয়মিত লেখকের মর্যাদায় নিজের অবস্থান শক্ত করা। যা আজও উদ্যোম আর উদ্যোগের ¯্রােতধারায় নিয়তই বহমান। সময়ের নিরবচ্ছিন্ন যোগসাজশে সমকালীন ঘটনা¯্রােত এখনও তাকে ভাবায়, উদ্বেলিত করাই শুধু নয় আলোড়িত আবেগে যৌক্তিক লেখনীও সুষ্ঠু আর সুশৃঙ্খলভাবে পাঠকের দ্বারে কড়া নাড়ে। এই বয়োবৃদ্ধ সুচিন্তিত মননের নায়ক আজও তার অপরিহার্য শব্দমালায় দেশ ও সমাজের বিচার বিশ্লেষণে বস্তুনিষ্ঠ আর যুক্তিসিদ্ধ আলোচনায় যেভাবে ব্যাপৃত থাকেন তা শুধুই অনুভবের বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। হাসান আজিজুল হক কিংবা যতীন সরকারের মতো সুপ-িত এবং বিজ্ঞ লেখকরা আহমদ রফিককে নিয়ে এভাবেই তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই অভিজ্ঞ এবং নিবেদিত জ্ঞান তাপসের রবীন্দ্র অনুরাগ তাঁর মনন অর সৃষ্টিশীলতার এক প্রয়োজনীয় সংযোজন। রবীন্দ্রভক্ত এই প্রাজ্ঞ গবেষক যেভাবে কবির নান্দনিক চেতনা আর সুবিশাল কর্মযজ্ঞ যুক্তিসম্মত উপায়ে বিচার বিশ্লেষণ করে পাঠকের সামনে হাজির করেন সেখানে তিনি পূর্ণমাত্রায় একজন রবীন্দ্রবোদ্ধা। আজও রবীন্দ্রনাথে বিভোর হন, রবীন্দ্র চেতনায় নিজের প্রত্যয়কে শাণিত, পরিশীলিত করেন। সাময়িকীর বিভিন্ন প্রবন্ধে লেখকরা আহমদ রফিকের প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে তাঁর জীবন, মনন আর সৃজনসৌধের এসব ঘটনাপ্রবাহকে অত্যন্ত যৌক্তিক আর বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে পাঠক সমাজকে উপহার দিয়েছেন। আবারও সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা এমন একটি সমৃদ্ধ সঙ্কলন উপস্থাপনের জন্য। আশা করি গ্রন্থটি পাঠক সমাজে আদৃত হবে। এর বহুল প্রচারেও কোন অন্যথা হবে না। পুরুষোত্তম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ও বাঙালীর জীবন এবং ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিসত্তা। জাতির পিতার ঐতিহ্যিক এবং গৌরবান্বিত কর্মযজ্ঞ নিয়ে গান, কবিতা প্রবন্ধ থেকে আরম্ভ করে অনেক স্তুতি অর্ঘ্যে তার ঘটনাবহুল জীবনকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। এ তো শুধু জীবন নয়, এক স্বাধীন জাতির নতুন আলো বিকিরণের এক অকুতভয় বীর সেনানি। যাঁকে কোন সীমাবদ্ধ আলয়ে আটকে রেখে তাঁর বিচিত্র জীবনালেখ্যকে মূল্যায়ন করা সত্যিই কঠিন। বাঙালীর জীবন, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে ধারণ করে সর্বমানুষের অপরাজেয় নেতা হয়ে ওঠা যেমন বিস্ময়ের একইভাবে আকর্ষণীয়ও বটে। নদীস্নাত বাংলা পলিমাটির স্নিগ্ধ প্রলেপে গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর মন ও মননে ছিল এক অপার সম্ভাবনাময় শক্তির কমনীয়তাই শুধু নয় প্রয়োজনে কঠিন-কঠোর হওয়ারও এক অবিচল দৃঢ়সত্তা। সঙ্গত কারণে তাঁকে নিয়ে সৃষ্টিশীল আয়োজন তৈরি করতে গেলে সেভাবেই সবদিক বিবেচনায় এনে তাঁর পর্বত প্রমাণ আদর্শ আর ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলা আবশ্যক। শেখ আসমান এমন একজন চিত্র শিল্পী যিনি ছাপচিত্রের শিল্পভাষায় বঙ্গবন্ধুকে সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেছেন। ছাপচিত্রের মূল মাধ্যম কাঠ এবং কাগজ। উড-কাট খোদাই করে ছাপচিত্রের নমুনা তৈরির কারণ কৌশল অবলম্বন করে এই ধরনের শিল্পচর্চা শৈল্পিক সুষমার এক অনবদ্য সম্ভার। শিল্পের এমন সমৃদ্ধ বৈভবে যদি কোন মহামানবের ছবি অঙ্কিত হয় তাহলে সেটা কোন্ পর্যায়ে চলে যাবে তা কল্পনাকেও হার মানায়। শিল্পী শেখ আসমান ‘পুরুষোত্তম’ বইটিতে বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক শৌর্য-বীর্যের যে নমুনা প্রদর্শন করেছেন তা যেমন অভাবনীয় তেমনি নান্দনিক বিবেচনায়ও অনবদ্য। কোন মানুষের জীবনের গতিধারা যদি হয় বহুমাত্রিক তাকে বিভিন্ন ভাবমূর্তিতে চিত্রায়িত করাও এক অবিস্মরণীয় কর্মযজ্ঞ। শেখ আসমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সেই প্রয়োজনীয় শিল্পকর্মটি সম্পন্ন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তার শিল্প সাধনার এই মহৎ অভিযাত্রাটি শুরু করা হয়েছে ১০ জানুয়ারি থেকে। যেদিন বঙ্গবন্ধু সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের রক্তাক্ত পথপরিক্রমায় প্রাণ সংহার আর অসংহত অবস্থার যে আখ্যান সেখানে জাতির পিতার আদর্শিক চেতনা আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সঙ্গে দেশাত্ববোধের অবিচলতা লড়াই-সংঘর্ষকে অনুপ্রাণিতই করেনি চালিতও করেছে। আর সেভাবেই শেখ আসমান পর্যায়ক্রমিক ধারায় তার শৈল্পিক বোধকে কাঠ-কাগজের খোদাইয়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের বিচিত্র অনুভবকে রূপায়িত করেছেন। শিল্পীকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হয়েছে চিত্রায়নের সময় অবস্থার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর শাণিত প্রভাব যেন যথার্থভাবে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়। আগেই উল্লেখ করা হয় স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রথম চিত্রটি সেই চিরায়ত ভঙ্গিতে অঙ্কিত হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে দৃপ্ত মনোবল, অজেয় চেতনা এবং অবিচলিত ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারলে এমন স্পষ্ট অভিব্যক্তির ছবি ফুটিয়ে তোলা দুঃসাধ্য। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ওপর আঁকা আছে প্রায়ই ১০টি চিত্রকর্ম। প্রতিটি অঙ্কন শিল্পে আছে তৎকালীন ব্যবস্থার আলোকে বঙ্গবন্ধুর সময়োপযোগী অভিব্যক্তি, অবয়বের বলিষ্ঠ রেখা সঙ্গে প্রকাশভঙ্গির এক দৃঢ়চেতা অনুভব। সত্যিই এক দক্ষ শিল্পী তার মনের মাধুরী মিশিয়ে যেভাবে জাতির পিতার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বকে নান্দনিক বোধে চিত্রায়িত করলেন তা শৈল্পিক সুষমার এক বরেণ্য কীর্তি। পরের সাতটি চিত্রকর্ম সাজানো হয়েছে ‘বাংলার তর্জনী’ নামে ভূষিত করে। বলিষ্ঠ কণ্ঠে, দেশপ্রেমের অনমনীয় বোধে আর উদাত্ত আহ্বানে যেভাবে জনগণকে শিহরিত করতেন একইভাবে সেই দৃঢ়তায় নিজের অঙ্গ সৌষ্ঠবও তাড়িত হতো। সেই আবিষ্টতায় ডান হাতের তর্জনী এক সময় উঁচু হয়ে যেত। যে জোরালো আওয়াজের গম্ভীরতায় সারা বাংলা উদ্দীপ্ত হতো। এও এক বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বিশিষ্টতার অন্যতম পর্যায়ে যা তার দৃঢ় ব্যক্তিত্বকে আরও মোহনীয় এবং দৃষ্টিনন্দন করে তোলে। ৭টি ছাপচিত্রের মধ্য দিয়ে শিল্পী শেখ আসমান সেই গুরুগর্জন কণ্ঠের উদ্দীপ্ততায় শাণিত বঙ্গবন্ধুর হাতের তর্জনীকেও তার শিল্পী সত্তায় প্রতিবিম্বিত করেছেন। সত্যিই অভাবনীয় এক শিল্পকৌশল যা দর্শককে যে মাত্রায় নিয়ে যায় তা শুধুই অনুভব আর উপলব্ধির বিষয়। জাতির পিতা হিসেবেও বঙ্গবন্ধুর ছাপচিত্রকে সাজানো হয়েছে। সর্ববাঙালীর মহানায়ক হওয়া সত্যিই গৌরব আর বিস্ময়েরই শুধু নয় তার চেয়ে বেশি মুক্তি পাগল একটি পরাধীন জাতির স্থপতির কাতারে আসন মজবুত করাও। অঙ্কিত ছবিগুলো সেই সম্ভাবনারই দিকনির্দেশনা। শিল্পীকে অভিনন্দন এমন নান্দনিক আর বলিষ্ঠ ছবি উপহার দেয়ার জন্য।
×