ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

সম্ভাবনার স্বপ্নডানায় চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২৫ জুন ২০১৮

 সম্ভাবনার স্বপ্নডানায় চট্টগ্রাম

(গতকালের পর) প্রকল্পের ১১টি স্লুইস গেটের মধ্যে ৯টির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। সড়ক ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি প্রকল্পে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে হালিশহরের দিকে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে সাগরে ওঠা-নামার জন্য জেটি সুবিধা থাকবে। সাগরপাড়ে নির্মাণাধীন ১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে আউটার রিং রোড খুলে দেয়া হলে প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দর, ইপিজেট ও বিমানবন্দরগামী প্রায় পাঁচ হাজার যানবাহন এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে। চাপ কমবে নগরের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে। বর্তমানে নগরের একমাত্র প্রধান সড়কটি চট্টগ্রাম বন্দরমুখী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান আর ইপিজেডের জনজটে প্রায় অচল হয়ে পড়ে। রিং রোড যানচলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলে বিমানবন্দর সড়কের ওপর চাপ অনেকটাই কমে যাবে। পতেঙ্গা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরমুখী বিকল্প সড়ক সৃষ্টি হবে। এতে যানজট নিরসনের পাশাপাশি নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় অবস্থিত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনা, বিভিন্ন বেসরকারী আইসিডি, চট্টগ্রাম ইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেড, ইস্টার্ন রিফাইনারি, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির ডিপো, নৌ ও বিমানবাহিনীর স্থাপনা, সাইলো জেটি, খাদ্য গুদাম, ইস্টার্ন ক্যাবলস’র কারখানার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে মুক্তি পাবে। আউটার রিং রোডটি প্রস্তাবিত কর্ণফুলী টানেলের সঙ্গেও যুক্ত হবে। এতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, মহেশখালী, কক্সবাজার অর্থনৈতিক জোন থেকে বন্দরে সহজে পণ্য পরিবহন করা যাবে। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক দিয়ে কক্সবাজারমুখী গাড়ি টানেল হয়ে নদীর দক্ষিণ পাড়ে যেতে পারবে। এতে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে গতিশীলতার পাশাপাশি পর্যটকও বাড়বে। একই সঙ্গে শহর রক্ষা বাঁধ হিসেবেও কাজ করবে আউটার রিং রোড। সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ হলে কক্সবাজারমুখী গাড়ি সহজেই পতেঙ্গার নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে প্রস্তাবিত টানেল হয়ে কর্ণফুলীর ওপারে চলে যেতে পারবে। . চাক্তাই-কালুরঘাট আউটার রিং রোড প্রকল্প নগরীর কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু থেকে কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে চাক্তাই খালের মুখ থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত সাড়ে আট কিলোমিটার দীর্ঘ আউটার রিং রোড নির্মাণ করা হচ্ছে। মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে। এতে ব্যয় হবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। চিটাগাং আউটার রিং রোড দ্বিতীয় পর্যায় নামের এই প্রকল্পটি ২৫ এপ্রিল ২০১৭ একনেকে অনুমোদন পেয়েছে এবং প্রকল্পটির কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি সড়কের পাশে থাকা ১২টি খালের মুখে জোয়ার প্রতিরোধক রেগুলেটর এবং পাম্প মেশিন স্থাপনের ব্যবস্থা রাখার ফলে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা হ্রাস পাবে, বন্ধ হবে জোয়ারের প্লাবন। নগরীর অপ্রতুল অবকাঠামোগত অসুবিধাসমূহ চিহ্নিত করতে ২০০৬ সালে জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি) একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। তাতে ট্রাঙ্ক রোড নেটওয়ার্কের আওয়তায় দুটি রিং রোড এবং মহানগরীর চারপাশে বৃত্তাকার সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে আরও ছয়টি রেডিয়েল রোড নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটে আউটার রিং রোড প্রকল্পের কাজ শুরু হয় গত কয়েক বছর আগে। ইতোমধ্যে পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত আউটার রিং রোডের কাজ প্রায় শেষের পথে। ফৌজদারহাট থেকে বায়েজিদ বোস্তামি পর্যন্ত চিটাগাং বাইপাসের নির্মাণকাজও শেষ পর্যায়ে। আউটার রিং রোড প্রকল্পের মাধ্যমে শহরের ভেতরে প্রবেশ না করেই দক্ষিণ বা উত্তর চট্টগ্রামের যানবাহনসমূহ বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করতে পারবে। এ প্রকল্পের আওতায় কালুরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু বা চাক্তাই খালের মুখ পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করা হবে। চাক্তাই খালের মুখ থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত রাস্তা রয়েছে। ফলে নগরীর চারদিকে একটি বৃত্তাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার গাড়িগুলো শহরে প্রবেশ না করে টানেল হয়ে পতেঙ্গা থেকে আউটার রিং রোড ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলে যাবে। একইভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে আসা রাঙামাটির কোনো গাড়ি ফৌজদারহাট থেকে বায়েজিদ হয়ে অক্সিজেন কিংবা কাপ্তাই রাস্তার মাথা হয়ে শাহ আমানত সেতুতে পৌঁঁছতে পারবে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ১৯৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন সাড়ে আট কিলোমিটার চার লেনের আউটার রিং রোডটির তলা ২৫০ ফুট উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪ ফুট প্রস্থ ৮০ ফুট। . বিএসএমআর মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বর্তমান সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলে চট্টগ্রামের নৌ-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বিশ্বমানের একটি মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মহান জাতীয় সংসদে দেশের ৩৭তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০১৩ সালে বিএসএমআরএমইউ আইন পাস করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে শিক্ষা কার্যক্রমে যায় বিশ্ববিদ্যালয়টি। অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ঢাকার পল্লবীতে। নগরীর কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী চান্দগাঁও-মোহরা এলাকার হামিদ চরে চট্টগ্রাম বন্দরের ১০৬ একর জায়গায় নির্মিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়। সেই লক্ষ্যে নামমাত্র মূল্যে গত বছর হামিদ চরের ১০৬ দশমিক ৬৬ একর জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ দেয় সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণকাজের জন্য প্রস্তাবিত ৯৬৯ কোটি টাকার ডিপিপি একনেকের আগামী সভায় পাস হওয়ার পর পরই হামিদ চরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে নির্মাণকাজ শুরু হবে এবং ২০২১ সাল নাগাদ প্রথম দফার কাজ শেষ হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি ইন ওশানোগ্রাফি ও বিএসসি ইন নেভাল আর্কিটেকচার এ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ৮০ জন ও ৩০ জন করে শিক্ষার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া মেরিটাইম ল, পোর্ট এ্যান্ড শিপিং ম্যানেজমেন্ট ও মেরিটাইম বিজনেস বিষয়ে তিনটি মাস্টার্স কোর্সে ৪০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৩৮ বিভাগ চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিএসএমআরএমইউর চুক্তি রয়েছে এবং সেগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নেয়ার পাশাপাশি এ বছরের মধ্যে আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনার কথা জানা যায়। চট্টগ্রামে শেখ হাসিনা সরকারের অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ডের মধ্যে একটি বিশেষায়িত ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, চট্টগ্রামবাসীর জন্য এটা গৌরবের এবং এটি চট্টগ্রামবাসীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় পুরস্কার। . কর্ণফুলী টানেল ও চায়না শিল্পাঞ্চল ১৪ অক্টোবর ২০১৬ প্রযুক্তির সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একই সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বিশেষায়িত চায়না অর্থনৈতিক জোন উদ্বোধন করেছিলেন দুই নেতা। এর মাধ্যমে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে চলেছে। চায়না অর্থনৈতিক জোনটি শতভাগ চীনের বিনিয়োগে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। উভয় মেগা প্রকল্পের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। দেশের প্রথম এবং একমাত্র এ টানেলটি চালু হলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। সরকারের গৃহীত ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অর্থনৈতিক করিডর বাস্তবায়ন আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। কর্ণফুলী নদীর ওপারে গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক জোন ও সমৃদ্ধ আরও এক মহানগরী। এর ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকার দূরত্ব আরও কমে আসবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মূল শহরের সঙ্গে নদীর অন্য প্রান্তের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পাশাপাশি বিকশিত হবে পর্যটন শিল্প। চাপ কমবে নদীর উপর থাকা অন্য দুই সেতুর। একই সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে প্রস্তাবিত সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে। চট্টগ্রামের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ২০০৯ সালের এপ্রিলে আবদুচ ছালামকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হওয়ার পর প্রথমবার কোন রাজনৈতিক কর্মীকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়নে তার সততা, আন্তরিকতা, দায়বদ্ধতার ওপর আস্থা রেখে টানা ছয়বার নিয়োগের মেয়াদ বর্ধিত করেছেন। শেখ হাসিনার প্রবল আগ্রহে দীর্ঘ সময়ের বন্ধ্যত্ব কাঠিয়ে গত সাড়ে নয় বছরে চট্টগ্রামের উন্নয়নের পালে হাওয়া লেগেছে। বর্তমান সরকারের সাড়ে নয় বছর মেয়াদকালে উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের উন্নয়নে গৃহীত প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, যানজট নিরসনের পাশাপাশি জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে নগরবাসী। কর্ণফুলী টানেল এবং আউটার রিং রোডকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম শহরের বিস্তীর্ণ এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে, বদলে যাবে হালিশহর, পতেঙ্গা, কাট্টলী এবং কালুরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকার আর্থ-সামাজিক চিত্র। উন্মোচিত হবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে সম্ভাবনার স্বপ্নডানায় বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম রূপান্তরিত হবে উন্নত সমৃদ্ধ এক নগরীতে। (সমাপ্ত) লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×