ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবহন নৈরাজ্য রোধে সব রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করার আহ্বান

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২০ মে ২০১৮

পরিবহন নৈরাজ্য রোধে সব রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করার আহ্বান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থায় চলমান নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করা ও সঙ্কট সমাধানে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকার পক্ষে মত দিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থায় পরিবহন কৌশল, আইন-কানুন, নীতি-নৈতিকতার তেমন কোন গুরুত্ব নেই। ফলে দেশজুড়ে পরিবহন সেক্টরে চরম বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান। ঢাকায় অসহনীয় যানজট। পথে পথে চালকদের অশুভ প্রতিযোগিতা চলছে। ঘটছে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা। মৃত্যু আর আহতের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। গেটলক আর সিটিং সার্ভিসের নামে প্রতারণা অব্যাহত। কোন কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। বাস্তব পরিস্থিতি হলো গণপরিবহন ব্যবস্থা রাজনীতিসম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। তাই সামাজিক এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির সমাধান রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। মূলত এ কারণেই এটি এখন রাজনৈতিক এজেন্ডা হওয়া উচিত। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলসমূহের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি অন্তর্ভুক্তি এবং সমাধানের অঙ্গীকার বাঞ্ছনীয় বলেও মনে করেন তারা। শনিবার ‘গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং যানজট নিরসনের পরিকল্পনা রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তি ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব মতামত তুলে ধরেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার হলে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সেমিনারে অংশ নিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বলেন, বড় দুটি দল আজকের আমন্ত্রণে আসেনি। এতে হতাশার কিছু নেই। আজকে যারা বড় আছে, কালকে তারা নাও থাকতে পারে। তারা আসেনি বলে এমনটি ভাবার কারণ নেই; সড়কে মৃত্যু নিয়ে তারা ভাবছে না। তবে আমি মনে করি বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন ভাবতে হবে। জনস্বার্থে ভাবনার সময় এসেছে। পাশাপাশি প্রতিকারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক ভূমিকা রয়েছে বলে আমি মনে করি। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সড়কে এত মৃত্যুর মিছিল, কিন্তু সরকারদলীয় নেতারা দেখুন কত হৃদয়হীন আচরণ করছেন। বাসের চাপায় মানুষ মারা যাচ্ছে, সরকারের নেতারা বলছেন, ‘আমরা কি বাস চালাই’? ‘সড়কে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে’ সরকার এমন দাবি কেমন করে করে? সড়কে মানুষের মৃত্যুর দায় সরকারকেই নিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা যদি সব দলকে নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার আন্দোলনে যুক্ত করতে না পারি তাহলে কিছুই হবে না। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন নগরে অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মাণের সমালোচনা করে বলেন, অপরিকল্পিত ফ্লাইওভারের কারণে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদে রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুব্রত চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা একটি জাতীয় সমস্যা। এটিকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ এখন আর নেই। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এখন নির্বাচনী ইশতেহারে এসব বিষয় যুক্ত করার সময় এসেছে। তেমনি প্রতিকারে দলগুলোর করণীয় সম্পর্কে জাতি জানতে চায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই দুর্যোগ সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে কমিয়ে আনতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় দোষী চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য নাদের চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক চাপ থাকলে সরকার চালকদের শাস্তি বাড়াতে বাধ্য হবে। বিকল্প ধারার সাংগঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুক বলেন, পরিবহন বাণিজ্যে রাজনৈতিক নেতারা জড়িত। তাই অনেক সময় দেখা যায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে নানা সুযোগ, অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন পরিবহন মালিকরা। এই বদনাম থেকে বেরিয়ে আসতে নিজেদেরই একাট্টা হতে হবে। ঢাকা মহানগরীতে অসহনীয় যানজটে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা শেষে এই তথ্য জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন। ‘মিটিগেটিং ট্রাফিক কনজেশন ইন ঢাকা: এ্যাপ্রোপ্রিয়েট পলিটিক্যাল এজেন্ডা’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনে অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ঢাকা শহরের মোট দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশ ঘটে পথচারী পারাপারের সময়। ঢাকা শহরে প্রতিদিন গণপরিবহনগুলো ৩৬ লাখ ট্রিপ দেয়। এসব গণপরিবহনের ৩৫ শতাংশ যাত্রী যায় কর্মক্ষেত্রে। তিনি বলেন, ঢাকার ৮০ শতাংশ গণপরিবহনই ইঞ্জিনচালিত। যানজটের কারণে পিক আওয়ারে এ গণপরিবহনগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে নেমে আসে, যেখানে হেঁটে চলার গড় গতিও ৫ কিলোমিটার। ফলে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এই যানজটে প্রতিবছর ৩৭ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, নগরের যানজট যদি ৬০ শতাংশ কমানো যায় তবে ২২ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো যাবে। এ সময় তিনি নগরের যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দেন। এখন ঢাকায় দেড় থেকে দুই শ’ বাস সার্ভিস রয়েছে। প্রতিটি রুটে একটি করে কোম্পানিকে এর দায়িত্ব দিলে ভাল হয়। এতে সড়কে প্রতিযোগিতা কমবে। এ ছাড়া আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলো সম্পূর্ণভাবে সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনারও পরামর্শ দেন তিনি। অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, যানজটের কারণে মানব চরিত্রের নয়টি দিক নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগে প্রভাব পড়ছে নাগরিকদের। এ ছাড়া গণপরিবহনে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের নানাভাবে নিগৃহীত হওয়ার কথাও উঠে আসে তার এই প্রতিবেদনে। ঢাকা মহানগরের গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণে একটিমাত্র পরিবহন সংস্থা গঠনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বছরে ১ হাজার কোটি টাকা সাবসিডি দিয়ে বছরে যদি ৫ হাজার কোটি টাকা লাভ করতে পারি, তবে সেখানে সাবসিডি দিলে ক্ষতি কোথায়? পরিবহন খাতে দুর্নীতি, নৈরাজ্য বন্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও মেয়রদের আরও বেশি দায়িত্ববান হতে অনুরোধ জানান। চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স প্রদানে আরও বেশি সতর্ক হওয়া, নগরে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা, বাইসাইকেল লেন তৈরি, হাঁটার পথ তৈরি করার পরামর্শ দিয়ে ধারণাপত্রে বলা হয়, সড়কে ব্যর্থতার দায় নিয়ে সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, নৌপরিবহনমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মন্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, পরিবহন খাতে দুর্নীতি, নৈরাজ্য বন্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও মেয়রদের আরও বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি আবদুল হামিদ শরীফ বলেন, একটি মোটামুটি উন্নত শহরের জন্য ২৫ শতাংশ ভাল সড়ক প্রয়োজন। আমাদের দেশে যা রয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এক কাঠা জমিতে এলিভেটেড টাওয়ার পার্কিং নির্মাণ করতে পারলে সেখানে ৫০টি গাড়ি পার্কিং করা যায়। ঢাকা শহরে পর্যায়ক্রমে ১০০ টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এমন পার্কিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রতিটিতে ৪ কোটি টাকা ব্যয় হবে। সরকার যদি উদ্যোগ নেয় তবে দাতাসংস্থা জাইকা এতে ফান্ড দিতে ইচ্ছুক বলেও সভায় জানান তিনি। বিআরটিসির পরিচালক (টেকনিক্যাল) মাহবুবুর রহমান জানান, দেশের মোট যানবাহনে মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ বিআরটিসি পরিচালনা করে। এতে বাসের সংখ্যা ১ হাজার ও ট্রাকের সংখ্যা ১৫০। ৫ বছর মেয়াদী সেলফ এমপ্লয়মেন্ট এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট প্রকল্পে ৪০ হাজার চালককে প্রশিক্ষণ দেবেন। সারা দেশের ১৯টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হবে বলে জানান তিনি। সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সভাপতি এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। গণপরিবহন ব্যবস্থার পরিকল্পনা নিয়ে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার শিরোনামে সভায় বক্তব্য রাখেন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বিআরটিসির পরিচালক (টেকনিক্যাল) মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।
×