ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কালো তালিকায় মিয়ানমার!

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

কালো তালিকায় মিয়ানমার!

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে আবারও কালো তালিকাভুক্তির জোর প্রচেষ্টা চলছে। রাশিয়া ও ভারতের সমর্থনসহ চীনের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের হুমকি না থাকলে ইতোপূর্বে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জাতিগত রোহিঙ্গা নিধনের কারণে নিন্দা প্রস্তাবসহ অবরোধ আরোপের প্রস্তাবও নিশ্চিতভাবে পাস হয়ে যেত। যা হোক, এখন যা হয়েছে ও হচ্ছে তাও কম নয় কোন অংশে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেজারির পক্ষ থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূল অভিযানে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে মিয়ানমারের জেনারেল মাউং মাউং সোয়েকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাপী কালো তালিকাভুক্ত ৫৮ ব্যক্তির অন্যতম একজন এই জেনারেল। রাখাইনে রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-নিপীড়ন-হত্যা-ধর্ষণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী করা হয় জেনারেল সোয়েকে। আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে তাকে বদলি করা হয়েছে মাত্র। অন্যদিকে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ দমন-পীড়নের অভিযোগ এবং তাতে সমর্থন দেয়ার সুনির্দিষ্ট কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান এবং রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্ত আউং সান সুচির বিরুদ্ধেও নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়েছে। জাতিসংঘ রাখাইনের বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক তদন্ত দল পাঠাতে চাইলেও সুচির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সরকার তার অনুমতি দিচ্ছে না। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা দায়েরের জন্য ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। ইতোমধ্যে সুচির নানা আন্তর্জাতিক পদক ও সনদ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশের পক্ষ থেকে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের অনেক দেশে প্রবেশসহ প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার যদি বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সুপারিশ ও তালিকা অনুযায়ী রাখাইনে বাংলাদেশে আশ্রিত ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না করে তাহলে আগামীতে তাদের একঘরে হয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। সে অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক অবরোধের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তখন মনে হয় না এমনকি চীন, রাশিয়া, ভারতও অন্তত নৈতিক ও মানবিক কারণে সমর্থন দেবে মিয়ানমারকে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে উদ্ভূত রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশ ৫টি প্রস্তাব পেশ করেছে। এগুলো হলোÑ সে দেশে চিরতরে সহিংসতা ও জাতিগত নিধন বন্ধ করা; জাতিসংঘ মহাসচিবের অধীনে একটি নিজস্ব অনুসন্ধানী দল প্রেরণ; জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং তা পূরণে সেখানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা; রাখাইন রাজ্য থেকে জোর করে বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে, যাদের অধিকাংশ আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে, তাদের নিজ নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; সর্বোপরি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা নিঃশর্ত, পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ তার সীমিত সম্পদ, বিপুল জনগোষ্ঠী ও স্বল্পপরিসরে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে সমর্থ নয়। প্রধানমন্ত্রীর উদারতা, মানবিকতা ও সহানুভূতির কারণে বাংলাদেশ তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সহায়সম্বলহীন শরণার্থীদের জন্য। স্বভাবতই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের এই ঔদার্য ও মানবিকতা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণেও সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ, যা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম কূটনৈতিক সাফল্য। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ইতোমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মেসহ অন্য রাষ্ট্রপ্রধানরা আহ্বান জানিয়েছেন। রাশিয়া, চীন ও ভারত এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে খোলাখুলি কিছু না বললেও বিরোধ মিটিয়ে নিতে বলেছে। ভারত ও চীন ত্রাণ পাঠিয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য। ওআইসিও রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করেছে। বলতেই হয় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবারই প্রথম রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি বেশ জোরেশোরে উপস্থাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে এবং জাতিসংঘে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রস্তাবিত ৫ দফা সমস্যাটির সুদূরপ্রসারী সমাধানে প্রভূত সহায়ক হতে পারে। মিয়ানমার সরকার যত দ্রুত এটি বাস্তবায়নে অগ্রসর হয় দেশটির জন্য ততই মঙ্গল।
×