ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাজরিন জাহান তারিন

২১ কোটি রুপির সিইও!

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

২১ কোটি রুপির সিইও!

প্রথম দেখায় খুব হামবড়া লোক তাকে মনে হবে না। খেটে খাওয়া আর দশটা মানুষের মতোই তার চেহারা। অথচ এই মানুষটি একাই একটি ব্র্যান্ড। যেনতেন ব্র্যান্ড নয়, ১০০ কোটি মানুষ তাকে চেনে, জানে এবং পণ্যের গায়ে তার চেহারার ছবি ছাপা আছে দেখে ভরসা পায়, এমন ব্র্যান্ড। পণ্যের বিজ্ঞাপনে তার উপস্থিতিই যথেষ্ট বেচা-বিক্রি বাড়িয়ে দিতে। ভারতের লাখ লাখ পরিবারের গৃহকর্ত্রী তার মসলা বাদ দিয়ে অন্য মসলা রান্নাঘরে তুলবার কথা চিন্তাও করতে পারেন না। আপনিও তাকে চেনেন, অন্তত তার চেহারা একবার হলেও দেখেছেন টিভিতে। তার নাম ধর্মপাল গুলাটি। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মসলা বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান এমডিএইচ মসলার প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কয়েক দশক ধরে তিনি একাই ভারতের লাখ লাখ রান্নাঘরে রাজত্ব করে আসছেন। অথচ আজকের এই অবস্থানে আসতে মাথার ঘাম আর চোখের পানি এক করে ফেলতে হয়েছে। কেননা তার শুরুটা খুব একটা মসৃণ ছিল না। ধর্মপাল গুলাটির বয়স এখন ৯৪। চরম দারিদ্র পেরিয়ে, বহু লড়াই লড়ে, হাজারো চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ তার কোম্পানির দাম ১৫০০ কোটি রুপি। তিনি এর সিইও হিসেবে বেতন নেন ২১ কোটি রুপি, যা ভারতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বেতন নেয়ার রেকর্ড। অথচ আজকের এই এত বড় ব্যবসা, এই মসলার সাম্রাজ্য শুরু করেছিলেন মাত্র ১৫০০ রুপি দিয়ে। এ গল্পের শুরু পাকিস্তানের শিয়ালকোটে। কেননা সেখানেই জন্মে ছিলেন ধর্মপাল গুলাটি। যখন তার বয়স ১০ বছর তখন স্কুল ছেড়ে দেন তিনি। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন তার সেখানেই সমাপ্ত হয়। তার বাবার ছিল মসলার ব্যবসা। বাবা তাকে এক রকম জোর করেই সেখানে বসিয়ে দেন। তখন বয়স ছিল অল্প, গায়ের রক্ত গরম, তাই সহজেই মাথা বিগড়ে যেতো। ঠিক করলেন বাবার ব্যবসা ছেড়ে নিজেই কিছু একটা করবেন? কিন্তু সেই কিছুটা কি? নামলেন সাবান বেচার ব্যবসায়। ১৯৩০ সালের শেষের দিকে মানুষ সাবানের ব্যবসা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাত না। তাই প্রতিদ্বন্দ্বীও তেমন একটা ছিল না। অল্প দিনেই ধর্মপাল ভাল টাকা আয় করে ফেললেন। এরপর বেশ কয়েকটা ব্যবসায় নামলেন একসঙ্গে। প্রতিটাতেই সফল হলেন তিনি। নিজেকে একজন ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেন খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই। কিন্তু কপাল পুড়ল ধর্মপালের একেবারে হুট করেই। সময়টা ছিল ১৯৪৭ সাল। একদিন তিনি জানলেন দেশ ভাগ হয়ে গেছে। ভারত আর পাকিস্তান নামে দুটো আলাদা আলাদা দেশ হয়ে গেছে। ভারত হিন্দুদের দেশ, পাকিস্তান মুসলমানের। ধর্মপালকে তাই দেশ ছাড়তে হবে। কেননা তার জন্মভূমি শিয়ালকোট পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেছে। সব কিছু পেছনে ফেলে শত শত হিন্দু আর শিখ পরিবারের সঙ্গে তিনি ভারতে চলে আসেন। তিন সপ্তাহ পরে ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের অমৃতসরে পৌঁছান ধর্মপাল, কপর্দকশূন্য এক রিফিউজি হয়ে। কিছুদিন অমৃতসারের রিফিউজি ক্যাম্পেই পড়ে রইলেন। সেখানে থাকতে থাকতে শুনতে পেলেন দিল্লীতে নাকি একটু কম খরচে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা। পাকিস্তান ছাড়ার আগে তার বাবা ১৫০০ রুপি সাথে করে এনেছিলেন। সেটা দিয়ে একটা টাঙ্গা, মানে ঘোড়ার গাড়ি কেনেন ধর্মপাল। মাত্র দুই পয়সার বিনিময়ে লোকজনকে এক জায়গা থাকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দিতেন। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী থেকে শুরু হলো গাড়োয়ানের জীবন। দুর্বিষহ সে দিনগুলোতে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কেটেছিল ধর্মপালের। সারাদিন লোকজনকে ডাকতে ডাকতেই কেটে যেত। কিন্তু দিন শেষে ধর্মপাল গুলাটি খোরাকিটাও জুটাতে পারতেন না। প্রায়ই তাকে পরিবারের গঞ্জনা সহ্য করতে হত। মনে মনে অধৈর্য হয়ে উঠলেন ধর্মপাল। ঠিক করলেন আর একটি দিনও এই গরিবী হালত মেনে নেবেন না তিনি। ঘোড়ার গাড়িটা বিক্রি করে দিলেন। যা টাকা পেলেন তাই দিয়ে শুরু করলেন বাবার সেই পুরনো ব্যবসা। শুরু করলেন তার নিজের মসলার দোকান। ছোট্ট একটি দোকান ভাড়া করলেন এবং মসলা বিক্রি শুরু করলেন ধর্মপাল। বাবার কাছ থেকে জাদুকরী মসলা তৈরির কৌশলগুলো রপ্ত করেছিলেন ধর্মপাল। সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়েই বিভিন্ন মসলার মিশ্রণ তৈরি করলেন। মানে কোন একটা বিশেষ পদ রাঁধতে যত রকম মসলা লাগবে তার সবকটাই পরিমাণ এবং স্বাদ মতো পাওয়া যাবে মিশ্রণে। এই ক্ষেত্রে মাপ মতো আলাদা আলাদা মসলা নিয়ে গুঁড়া করে রান্নায় দিতে হবে না। নতুন এ পণ্যের নাম দিলেন এমডিএইচ (মাহাসিয়ান ডি হাত্তি) মসলা। এটাই এক সময় তার ভাগ্য ফিরিয়ে দেয়। বিক্রি শুরু করার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভারতের গৃহিণী মাঝে দুর্দান্ত জনপ্রিয়তা পায় এমডিএইচ মসলা। এরপর আর কখনই পেছন ফিরে তাকাননি ধর্মপাল গুলাটি। এখানে তিনি খ্যাতি এবং টাকা দুটোই কামিয়েছেন দু’হাত ভরে। ১৯৫৩ সালে তিনি তার দ্বিতীয় দোকান খোলেন চাঁদনী চকে। দুই দোকানের লাভ বাড়তেই থাকে। এর ছয় বছর পর এমডিএইচ মসলা তাদের প্রথম জমি কেনে কৃতিনগরে, সেখানেই প্রতিষ্ঠা করা হয় এমডিএইচের প্রথম কারখানা। স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে বাজারজাত করণের জন্য তৈরি হয় এমডিএইচ। আজকের দিনে এমডিএইচ ১০০টিরও বেশি দেশে ৬০ রকমের পণ্য রফতানি করে। স্ত্রী, এক পুত্র এবং ছয় কন্যার জনক ধর্মপাল গুলাটি তার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন ছোট্ট এক দোকান থেকে। তারপর কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায় তাকে পরিণত করেছে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে। তার দুর্দ- সঙ্কল্প আর ক্রমাগত চেষ্টায় আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইরাক, ইউরোপসহ এবং আরও অন্যান্য দেশে পৌঁছে গেছে এমডিএইচ মসলা। ধর্মপালের এত বছরের কঠোর পরিশ্রমে এমডিএইচ এখন ১৫০০ কোটি রুপির কোম্পানি। আর ধর্মপাল বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী সিইও। তবে শুধু টাকা উপার্জনই নয়, ধর্মপালের রয়েছে মানবসেবায়ও বিপুল আগ্রহ। বেতনের ৯০ শতাংশই তিনি দাতব্য সংস্থায় দান করে দেন। তার নেতৃতেই এমডিএইচ ২০টিরও বেশি স্কুল তৈরি করেছে। তিনি বিশ্বাস করেন, ভাল কিছু দিলে ভাল কিছু পাওয়া যায়।’ বছরের পর বছর তিনি মানুষের হাতে কম দামে ভাল জিনিস তুলে দিয়েছেন। তার পুরো জীবনটাই অনেক তরুণের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরার মতো।
×