ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাকা আইসিস দখলমুক্ত ॥ এরপর কি ঘটছে

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৫ অক্টোবর ২০১৭

রাকা আইসিস দখলমুক্ত ॥ এরপর কি ঘটছে

ইসলামিক স্টেটের স্বঘোষিত খিলাফতের রাজধানী সিরিয়ার রাকা নগরীর অবশেষে পতন ঘটেছে। চার মাসব্যাপী কঠিন লড়াইয়ের পর মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)-এর হাতে নগরীর পতন ঘটে। আইসিসের তিন বছরব্যাপী শাসনের পর রাকার পুনর্দখল এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটির এক প্রতীকী পরাজয়ের স্বাক্ষর। সিরিয়া ও পার্শ্ববর্তী ইরাকে কঠিন চাপের মুখে পড়ে আইসিস জঙ্গীরা দুই দেশের মধ্যবর্তী ইউফ্রেটিস নদী তীরবর্তী ভূখ-ে এবং আশপাশের মরুভূমিতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। কুর্দী ও আরবদের সমন্বয়ে গঠিত সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস ১৭ অক্টোবর জানায় তারা নগরীতে আইসিসের শেষ দুই ঘাঁটি স্টেডিয়াম ও নিকটবর্তী হাসপাতাল দখলে নিয়েছে। এসডিএফএর এক মুখপাত্র বলেন, রাকায় সামরিক অভিযান শেষ হয়েছে তবে ছোটখাটো সেলের অস্তিত্ব থেকে থাকলে তা ধ্বংস করার এবং নগরীকে মাইনমুক্ত করার অভিযান অব্যাহত আছে। রাকার পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে বলে তিনি জানান। মুখপাত্র বলেন, স্থানীয় কাউন্সিল আইসিস জঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের নিরাপদে চলে যাওয়ার পথ করে দেয়। আইসিস জঙ্গীদের মধ্যে যারা এই সুযোগ নেয়নি তারা হয় গুলিগোলায় নিহত হয়েছে নয়ত আত্মসমর্পণ করেছে। তবে পেন্টাগন হুঁশিয়ারি করে দিয়েছে যে, শ’খানেক আইসিস জঙ্গী এখনও নগরীর বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে আছে এবং তারা প্রতিরোধ দিতে পারে। আইসিস ২০১৪ সালের প্রথম দিকে প্রথম রাকা দখল করে এবং তারপর সিরিয়া ও ইরাকের বেশ কিছু বড় বড় নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে। রাকাকে তারা মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে অভিযান পরিচালনার কমান্ড কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। পাশ্চাত্যের বেশ কিছু নাগরিক আইসিসের হাতে বন্দী হওয়ার পর রাকাতেই আটক ছিল এবং সেখানেই তাদের হত্যা করা হয়েছিল। তিন বছর আইসিসের শাসনাধীনে থাকা এবং একের পর এক বিমান হামলা ও স্থ’লযুদ্ধ হওয়ার পর রাকা আর সেই আগের রাকা নেই। চারদিকে বিধ্বস্ত ভবন অথবা ভবনের ধ্বংসস্তূপ। রাকা এখন কে শাসন করবে মার্কিন কোয়ালিশন ও এসডিএফের পরিকল্পনা হলো স্থানীয় আরবদের পছন্দসই এক বেসামরিক শাসন পরিষদ শীঘ্রই রাকার শাসন পরিচালনার দায়িত্বভার নেবে এবং পুনর্গঠনের কাজ শুরু করবে। পরিষদকে সাহায্য সহায়তা দেবে অন্তর্বর্তীকালীন নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু এই পরিকল্পনার মধ্যে বেশ কিছু ফাঁক আছে। এসডিএফ বা সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস মূলত কুর্দীদের নিয়ে গঠিত। তাদের এই আরব প্রধান নগরীকে দখলে রাখার সত্যিকারের কোন দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ নেই। আর আরবরা যারা এখানে বাস করত তাদের অনেকেই হয় শরণার্থী শিবিরগুলোতে পালিয়ে গিয়েছিল অথবা রাকাতেই আইসিসের পাশাপাশি বসবাস করছিল। এই আরবরা প্রধানত সুন্নি। কাজেই এরা হলো সুন্নি জনগোষ্ঠীর সেই অংশ যারা গৃহযুদ্ধের সময় সিরীয় সরকারের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। প্রতিবেশী ইরাকেও সুন্নিদের অনেকে নানা ধরনের বঞ্চনা ও হয়রানির শিকার হয়ে শিয়া সরকারের অধীনে বাস করছে। কাজেই এই সুন্নিদের মধ্য থেকে আইসিস তার বেশিরভাগ রিক্রুট সংগ্রহ করতে পেরেছিল। ইরাক ও সিরিয়া দুটো দেশেই সুন্নিদের অভাব অভিযোগ প্রতিকারের দিকে কেউ নজর দেয়নি। সামনে এগিয়ে আসার মতো আন্তর্জাতিক পরিসরে মর্যাদাসম্পন্ন কোন নেতৃত্বও সুন্নিদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। কাজেই এসডিপি যে ধরনের সরকার গড়ে তোলার কথা ভাবছে সেটা একই সঙ্গে একটা সুসংহত ও সুন্নিপন্থী সরকারও হবে এমন ভাবনা বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। তাছাড়া রাকায় সত্যিকার অর্থে শাসন করার মতো তেমন কিছুও আর অবশিষ্ট নেই। মাসের পর মাস ধরে পরিচালিত বিমান হামলায় সবকিছু ধূলিসাত হয়ে গেছে। এর অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের জন্য শত শত কোটি ডলার প্রয়োজন হবে। নগরী এখন পরস্পরের প্রতিযোগী দুই তিনটি গ্রুপের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। রাশিয়ার বিপুল সামরিক সাহায্যপুষ্ট সিরীয় সরকারী বাহিনী মাত্র কয়েক মাইল দূরে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার একদা বলেছিলেন যে, সিরিয়ায় পুরো ভূখ- পুনরুদ্ধার করা হবে। ওদিকে কুর্দীরা সিরিয়ার উত্তরাংশে তাদের নিজস্ব আবাসভূমি চায়। দরকষাকষির সুবিধার্থে আপাতত তারা সেই দাবিতেই অটল থাকতে পারে এবং তৃতীয়ত রয়েছে স্থানীয়রা যারা হলো রাকার আদি অকৃত্রিম জনগোষ্ঠীর অবশিষ্টাংশ। তাদের আনুগত্য বিভক্ত। থাকার মতো কোন জায়গা নেই। একদা যেখানে বাড়িঘর ছিল সেখানে আজ ধ্বংসস্তূপ। একদা রাকা ছিল স্বৈরাচারী শাসনের মরুভূমির মধ্যে সেকুলার মরুদ্যানের মতো। সকলের জন্য আকাক্সিক্ষত এই নগরীর যে এখন কি হাল হয়েছে তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আইসিস এখন কোথায় আইসিসের হাতে অবশিষ্ট যে ভূখ-গুলো রয়েছে সেগুলো সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলের দুই নগরী দেইর এজর ও মায়াদিন, ইরাকের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় নগরী আল আস্কা এবং ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যকার চরম অরাজক সীমান্ত ভূখ-। শিয়া মিলিশিয়া ও রুশ বিমানবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট সিরিয়ার সরকারী বাহিনী এখন নগরী দুটি অবরোধ করে রেখেছে। বিমান হামলা ও স্থল আক্রমণ দুটোই চলছে। রাকার পতনের পর শত শত আইসিস যোদ্ধা ইরাকী সীমান্তের কাছে ইউফ্রেটিস নদী অববাহিকা নামে পরিচিত সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় চলে গেছে। গ্রুপটি সেখানে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী আনা-নেয়া করছে। ধারণা করা হয় পরবর্তী লড়াইগুলো এই পূর্বাঞ্চলেই ঘটবে। দিয়েই আজরও মায়াদিনের পতন এখন সময়ের ব্যাপার। এরপর আইসিস জঙ্গীরা গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাবে। তারা অপেক্ষায় থাকবে, নিজেদের সংগঠিত করবে এবং সুবিধামতো সময় আঘাত হানবে। গ্রুপটির স্বঘোষিত খিলাফত কখনও ইরাকে ও কখনও সিরিয়ায় আনাগোনা করলেও বাইরে এর উপস্থিতি ও প্রভাব আছে এবং থাকবে। আইসিসের সেল বা ছোট ছোট গ্রুপের এক অত্যাধুনিক নেটওয়ার্ক আছে যা পশ্চিম আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত এই জিহাদী গ্রুপের নামে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আইসিসের এই সেলগুলো আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে, ইয়েমেনে আল কায়েদার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত এবং ফিলিপিন্স, সৌদি আরব, মিসর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, নাইজিরিয়া ও রাশিয়ার ককেশাস অঞ্চলে সক্রিয়। এরা পরে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিতে পারে। তবে সিরিয়া ইরাকে এদের পরাজয় এবং কথিত খিলাফতের অবসান ঘটলেও এ অঞ্চলে এখনও প্রায় সাড়ে ৬ হাজার আইসিস যোদ্ধা আছে। তাদের এখন প্রয়োজন গা-ঢাকা দিয়ে থাকার মতো জায়গা এবং সাইবার অপারেটিভদের নেটওয়ার্ক যার মাধ্যমে রিক্রুট করা, অর্থ সংগ্রহ করা, আক্রমণের পরিকল্পনা করা যায়। আইসিসের সমগ্র কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে এমন ধারণা করার কারণ আছে যে তারা আবার উঠে দাঁড়াতে ও ভূখ- পুনর্দখল করতে পারে। সেটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এই জঙ্গীরা কখনই হাল ছেড়ে দেবে না। তাই রাকা দখলমুক্ত হওয়া মানে এই নয় যে, আইসিস ধ্বংস হয়ে গেল। এটি এমন এক সংগঠন যা অতি শোচনীয় অবস্থা থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে আবার ফিরে আসার অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। সংগঠনটি ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে যে তারা এ অঞ্চলের অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগটির জন্য যতদিন প্রয়োজন ততদিন অপেক্ষা করে থাকার ক্ষমতা রাখে। দ্বিতীয়ত তারা বিদেশী যোদ্ধাদেরও রিক্রুট করতে এবং তাদের দিয়েও আক্রমণ চালাতে সক্ষম। ভূখ- হারিয়েছে মানে এই নয় যে ইরাক ও সিরিয়ার বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করার ক্ষমতাও হারিয়েছে। নতুন সংঘাতের লক্ষণ সিরিয়া ও ইরাকে আইসিসের পরাজয় ঘটেছে। তবে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক সমাধানের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সিরিয়ার দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধে নতুন দফা সংঘাত ও অস্থিরতার ক্ষেত্র তৈরি হতে চলেছে। মনে রাখতে হবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আইসিসকে কেন্দ্র করে শুরু হয়নি। তাই আইসিসের পরাজয়ের মধ্য দিয়েও এটি শেষ হচ্ছে না। আইসিসকে পরাজিত করার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরের নানা ধরনের শক্তি একত্রিত হয়েছিল। এই শক্তিগুলোর অনেকেই ছিল পরস্পরের জাত শত্রু। তারা সাময়িকভাবে তাদের বিরোধ ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। এখন আবার সেই বিরোধ মাথাচাড়া দেয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সংঘাতগুলোর একটি হচ্ছে আরব-কুর্দী উত্তেজনা। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট এসডিপি মূলত কুর্দী যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত। এসডিপি রাকার আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় অধিবাসী (মূলত আরব)দের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত নগর পরিষদের হাতে দিতে চায়। কিন্তু সিরিয়ার সরকার এটা মানবে না এবং তা হতেও দেবে না। বাশার সরকার রাকা পুনর্দখলের এবং এরও বাইরে কুর্দীরা যে আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছিল সেটাও দখলে নেয়ার চেষ্টা করবে। বাশার বাহিনীকে ঠেকাতে আমেরিকা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে তা পরিষ্কার নয়। সূত্র : গার্ডিয়ান ও অন্যান্য
×