ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

হোটেল সাহারা থিওরি এ যুগেও অচল

প্রকাশিত: ০৩:১৩, ২১ অক্টোবর ২০১৭

হোটেল সাহারা থিওরি এ যুগেও অচল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত একটি মজার মুভি দেখেছিলাম ওয়ানস আপন এ টাইম। ইংরেজী ভাষার এ মুভিটি কে বানিয়েছিলেন মনে নেই, তবে মুভিটির নাম মনে আছে এখনও‘হোটেল সাহারা।’ মরু অঞ্চলের হাইওয়ের পাশে হোটেলটি। এ যুগের হাইয়ে রেস্টুরেন্ট বা পথ-পার্শ্বস্থ হোটেল। তখন বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি তুঙ্গে, হাইওয়ে দিয়ে কখনও হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনী, কখনও সুসজ্জিত হিটলারবিরোধী জোট (ব্রিটিশ-আমেরিকা-রাশিয়া) র সৈন্যবাহিনী ঘোড়া দাবড়িয়ে আসা-যাওয়ার পথে এই হোটেল সাহারায় পানাহার করে। আবার চলেও যায়। হোটেল সাহারার মালিক নিজের ও হোটেলের নিরাপত্তার জন্য হাইওয়েতে তাকিয়ে থাকে। যে বাহিনীকে দেখে সেই বাহিনীর পতাকা হোটেলের সামনে উড়িয়ে দেয়। সব বাহিনীর পতাকাই তার কাছে রয়েছে এবং যখন যে দল আসে সে দলের পতাকা উড়িয়ে দেয় আগেরটা নামিয়ে। এভাবে বেশ চলছিল হোটেল সাহারা। একবার চোখের ভুলে ভুল পতাকা উড়িয়ে দিল। অর্থাৎ এলো রাশিয়ান সৈন্য অথচ পতাকা ফ্যাসিস্ট বাহিনীর এতে তার চালাকি ধরা পড় গেল এবং যা হওয়ার তাই হলো। সমস্ত হোটেল তছনছ করে রাশিয়ান সৈন্যরা চলে গেল। হোটেল সাহারার পতন ঘটল। এ যুগেও কেউ কেউ হোটেল সাহারার চালাকি করতে চায়। কিন্তু এ যুগে হোটেল সাহারা অচল। আমাদের মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদাও এমনি ভূমিকা পালন করতে গিয়ে সমালোচনার পাত্র হলেন। কোন প্রয়োজন ছিল না, তবু সিইসি মহোদয় ধান ভানতে শিবের গীত গাইলেন। ২০১৮-এর শেষের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনা ফাইনাল করার আগে তিনি স্টেকহোল্ডার সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ বৈঠক করেছেন এক এক করে। এমনকি তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং মিডিয়ার সঙ্গেও মতবিনিময় করেছেন। ১৫ অক্টোবর মতবিনিময় করলেন বিএনপির সঙ্গে। বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তাদের ২০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। তাতে রয়েছে নির্বাচনের আগে সহায়ক সরকার গঠন, সরকারের সঙ্গে সংলাপ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং লেভেল ফিল্ড নির্মাণ অর্থাৎ সব দলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। তাদের প্রতিটি দাবিই রাজনৈতিক। দেখা গেল সংবাদপত্রে হেডলাইন হয়েছে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জিয়া : সিইসি।’ যে জন্য সংলাপ করতে গেল বিএনপির সেই ২০ দফা হারিয়ে গেল একটি সাইড লাইনের বক্তব্যে। ঠিক যেমনটি করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। তিনিও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে পাস করা ষোড়শ সংশোধনী তার নেতৃত্বে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে বাতিল করে দেন। তা তারা করতেই পারেন। কিন্তু তিনি যে কাজটি করলেন তা হলো রায়ের অবজারভেশনের নামে বেশকিছু অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিলেন, যার কোন প্রয়োজন ছিল না। তিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে কটাক্ষ করলেন, কোন এক ব্যক্তির নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়নি, সংসদ সদস্যগণ মেধাসম্পন্ন নন ইত্যাদি ইত্যাদি। আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মী, কোটি কোটি সমর্থক, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বাঙালী তার এই অযাচিত মন্তব্যে আহত হলেন। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো। দেখা গেল মাননীয় প্রধান বিচারপতির নিজেরই অনেক গুরুতর দুর্বলতা রয়েছে। যা এক এক করে বের হতে লাগল এবং তিনি ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেলেন। আমি বলছি না প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অনুরূপ দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু তিনি একজন ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। একটুও কি ভাববেন না কি বলছেন বা তার এই কথার ফলে জনমনে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। সিইসি মহোদয় বলেছেনÑ ‘জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা করেছেন।’ তার এ বক্তব্য যেমন পূর্ণ সত্য নয়, তেমনি তিনি ’৭৫ পূর্ববর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারকে কটাক্ষ করলেন। বক্তব্যটি আংশিক সত্য এ জন্য যে, জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৬ সালে পিপিআর জারি করে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের মাধ্যমে কর্মকা- চালাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। জিয়া কি সিপিবি বা জেএসডিকে কর্মকা- চালাতে দিয়েছিলেন? বরং জামায়াত-শিবির, মুসলিম লীগের মতো স্বাধীনতাবিরোধীদের গর্ত থেকে তুলে রাজনীতিতে নামালেন। এসব প্রশ্ন করাটা অযৌক্তিক হবে কি? তাছাড়া কে না জানে জিয়ার আমলে একটার পর একটা মিলিটারি ক্যু, ক্যুর বিচারের নামে শত শত মিলিটারি সদস্যকে ফাঁসি এবং বলা যায় জিয়ার গোটা আমলটাই কেটেছে কার্ফ্যুর মধ্যে। তিনি আরও অনেক কিছু বলেছেন, যা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালীর জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহস, দূরদর্শিতা, কালজয়ী নেতৃত্ব ও সীমাহীন ত্যাগকে অস্বীকার করার শামিল। যদি বিষয়টি এভাবে বিশ্লেষণ করা হয় যে, বিএনপি বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করে মিলিটারি জিয়াকে গ্লোরিফাই করার যে অশুভ রাজনীতির সূচনা করে ব্যর্থ হয়েছে সিইসি মহোদয় জেনে হোক বা সরল মনে একটি কথা বলে প্রকারান্তরে তাকেই আবার পুনর্জীবন দান করলে তাহলে কি খুব অন্যায় হবে? যদি বলা হয় জিয়া সেদিন ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে তার প্রেসিডেন্টের প্রাণ রক্ষা করেননি বা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, উপরন্তু খুনীদের বিদেশী দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। এতে কি বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে না? যদি বলা হয় জিয়া ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিতে পুনর্বাসন ও পুনর্প্রতিষ্ঠিত করেছেন, ৩০ লাখ শহীদ ও প্রায় ৫ লাখ নির্যাতিতা মা-বোনের পরিবার কি এ প্রশ্ন করতে পারেন না? এমনি অনেক প্রশ্ন আছে যা উত্থাপিত হলে বিএনপি পরিবারের জবাব দেয়া কষ্ট হবে। যদি ধরে নেয়া যায়, সিইসি মহোদয় অতীতের একাধিক সিইসির মতো তার নিজস্ব চিন্তাধারা ও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে এসব কথা বলেছেন তাহলেও হয়তো কিছু বলার ছিলো না। তিনি যেমন বিএনপির সঙ্গে সংলাপে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করেছেন, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা করে বিএনপির ভাষায় ‘লেভেল ফিল্ড’ নির্মাণ করতে চান, তাহলে বলব লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য মহৎ হলেও পদ্ধতিটি সঠিক নয়। বরং হোটেল সাহারার মতো অন্তিমে ধরা খেয়ে বিপদে পড়বেন। অবশ্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিপদে পড়লে যতটা না ক্ষতি হবে তার চেয়ে লাখো কোটি গুণ বেশি ক্ষতি হবে, গোটা জাতির। চালাক হওয়া ভাল, চালাকি কাম্য নয়। গোটা জাতি তাকিয়ে আছে নির্বাচন কমিশনের দিকে। আঠারোর শেষে অথবা উনিশের শুরুতে দেশে একটা সাধারণ নির্বাচন হবে এবং সে নির্বাচনে জাতি একটি সাহসী, সক্ষম ও দূরদর্শী সরকার নির্বাচিত করবে, যে সরকার বাইরের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নিতে সামান্যতম হেচিটেট করবে না, যে সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বিদ্যুত, মাথাপিছু আয় এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবে যাতে উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যার বিশাল ক্ষয়ক্ষতি বা রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট সমাধানে কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, গোটা বিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দেবে। সেরকম সরকারকেই জনগণ নির্বাচিত করবে এবং সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে মাননীয় সিইসি কেএম নুরুল হুদা সফল হবেন, জাতি সাধুবাদ জানাবে। কারণ, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্র্বাচনের পুনরাবৃত্তি কেউ কামনা করে না। আমি বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগও না। জাতি তো চাইছেই না। তবে মাঝে-মধ্যে বিএনপি মেজাজ-মর্জি দেখে মনে হয় যতক্ষণ না তারা শিওর হচ্ছে তারা জিতছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের আচার-আচরণ কি হবে তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। ঢাকা-১৯ অক্টোবর ২০১৭ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ই-মেইল: [email protected]
×