ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১১ আগস্ট ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) ধর্মাতপুরে পাপ অস্থির হয়ে নিজের তাঁবুর ভেতর পাঁয়চারি করছেন মহারাজ যশোবন্ত সিং। বিকেলে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ এমন কিছু কথা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন যা তাকে ক্রমে বিভ্রান্ত করে তুলছে। যশোবন্ত–স্বাগতম ধর্মাবতার মহারাজ, আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি আপনার মতো একজন বিজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কষ্ট করে আমার তাঁবুতে পদধূলি দিয়েছেন। বলুন আমি আপনার কি সেবা করতে পারি। ব্রাহ্মণÑআপনি বিচক্ষণ রাজপুরুষ। রাজপুত ঘরানার গর্ব। আপনার বেশি সময় নেব না। আমাদের মহান হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় আপনার চৌদ্দ পুরুষ নিয়োজিত ছিলেন। আমি শুধু আপনার কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে এতদূর এসেছি। একবার ভেবে দেখুন কেন আপনি মুঘলদের অন্তর্দ্বন্দ্বে নিজেকে জড়াচ্ছেন। দারা বা শাহজাহান যিনি সম্রাট হোন তাতে আমাদের কি আসে যায়? যশোবন্ত–এটা কিভাবে সম্ভব ঠাকুর? আপনি ভালভাবে জানেন, রাজপুত রক্ত বিশ্বাসঘাতকতা করতে জানে না। এত দিন মুঘলদের নিমক খেয়েছি। কিভাবে ওদের ত্যাগ করি? ব্রাহ্মণ–আপনি একাধারে সরল এবং বোকা মহারাজ। মুঘলরা আমাদের ধর্মের গুটি কয়েকজনকে উচ্চ রাজপদে আসীন করেছে বলেই তাদের সব ত্রুটি ও অনাচার মিথ্যা হয়ে যাবে? দিন দিন আমাদের সমাজের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজ ধর্ম পালনে অতিরিক্ত কর আদায় করা হচ্ছে কোথাও কোথাও। এখন তো আর সম্রাট আকবরের যুগ নেই। এই মুঘলরা আমাদের জাত শত্রু। কিভাবে তাদের বিশ্বাস করেন আপনি? তাদের মোল্লারা যা শুরু করেছে অচিরেই হিন্দুস্তান ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে আমাদের। এখন আপনি আমাদের ভরসা। যশোবন্ত–আমি একা এই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আমার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেব। ব্রাহ্মণ–দয়া করে আমার কথাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। তা না হলে ইতিহাস আপনাকে ক্ষমা করবে না। অনেক দূরের পথ যেতে হবে। আমাকে ফিরে যাবার অনুমতি দিন মহারাজ। যশোবন্ত–আপনার যাত্রা শুভ হোক। ব্রাহ্মণকে বিদায় দিয়ে রাজা যশোবন্ত সিং চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ধর্মাতপুরে হঠাৎ করে এই ধবধবে সাদা ধুতি পরা কপালে চন্দনের তিন তিলক দেয়া ব্রাহ্মণকে কে পাঠাল? মুরাদ, আওরঙ্গজেব নাকি দারা স্বয়ং যশোবন্তের বিশ্বস্ততার পরীক্ষা নিতে। ব্রাহ্মণকে অপমান করলে ধর্মনাশ হবে। তাছাড়া সৈন্যদের মধ্যে অনেকেই হিন্দু ধর্মের। তারা যদি শোনে একজন সম্মানিত ব্রাহ্মণ পুরোহিত অপমানিত হয়েছেন তবে শিবিরে বিশৃঙ্খলা অনিবার্য। যশোবন্ত সিং কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলেন না। ধর্মাতপুর পৌঁছানোর পর দিপালপুর দীঘিরপাড়ে সৈন্যদের বিশ্রাম দিয়েছেন শাহজাদা মুরাদ। আপাতত এখানেই তাদের অপেক্ষা করতে সাঙ্কেতিক সংবাদ পাঠিয়েছেন বড় ভাই আওরঙ্গজেব। যে কোন দিন তিনি খরস্রোতা নর্মদা নদী পাড়ি দিতে পারেন। এর মধ্যে আওরঙ্গজেব হাল্কা কামান ও রসদপত্র নিয়ে নর্মদার চল্লিশ মাইল উজানে অবস্থান নিয়েছেন দারার চোখ ফাঁকি দিতে। এরপর দুই ভাই মিলিত হবেন। মহারাজ যশোবন্ত সিংয়ের নেতৃত্বে দারার পাঠানো রাজকীয় বাহিনী মুরাদের গতিবিধি জানতে পারলেও আওরঙ্গজেবের উপস্থিতি এখনও টের পায়নি। সাদাসিধে এক তাঁবুর ভেতর যাত্রাপথের ক্লান্তি দূর করতে সন্ধ্যা হতে আফিম সেবন করছিলেন শাহজাদা মুরাদ। ইচ্ছে করে সৈন্যদের শিবির হতে সামান্য দূরে দিওয়ান-এ-খাসের আদলে গড়া রাজকীয় তাঁবুটি এড়িয়ে চলছেন। তারা এখন দারার সীমানায়। কোথায় কোন গুপ্ত ঘাতক লুকিয়ে আছে কে জানে? তার পরও লক্ষ্য করলে মুরাদের এই তাঁবুটির আলাদা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে। তাঁবুটির এক শ’ গজ দূরত্বে সামান্য তফাতে চক্রাকার অবস্থানে বাকি তাঁবুগুলোর অবস্থান। প্রবেশ মুখে দু’জন সশস্ত্র সৈন্য মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয় উপদেষ্টা বুলন্দের অভাব বোধ করলেন মুরাদ। আহমেদাবাদ দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে এসেছেন তাকে। কথা দিয়েছেন হিন্দুস্তানের বাদশাহ হলে বুলন্দকে প্রধান উজির হিসেবে নিয়োগ দেবেন। বুলন্দ আড়ালে মুরাদের কথায় মুচকি হেসেছিলেন। মুরাদ জানেন না বুলন্দ ততদিনে আওরঙ্গজেবের পোষ্য হয়ে গিয়েছে। বুলন্দের চোখ এখন মুরাদের গতিবিধির দিকে। আওরঙ্গাবাদ ত্যাগের আগে আওরঙ্গজেব আরও বড় কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এই বিচক্ষণ খোঁজাকে। মুরাদের ইশারা পেয়ে তিন হেরেম-সুন্দরী ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এই তিনজন বংশানুক্রমিকভাবে বশীকরণ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। অল্প সময়ে সঙ্গীকে উত্তেজিত করে আনন্দ দিতে এই হেরেম কন্যাদের জুড়ি নেই। এদের একজন রুপালি কৌটা খুলে বিশেষ যৌন উত্তেজক দ্রবণ বের করলেন। শুকনো আদার সঙ্গে সমপরিমাণ গোলমরিচ ও কাঁচা মরিচের মিশ্রণের সঙ্গে বড় মৌমাছির চাক হতে সংগ্রহ করা মধু মিশিয়ে আঠালো দ্রবণটি বানানো হয়েছে। শাহজাদা এখন ক্লান্ত। তাই শৃঙ্গার আনন্দ আরও দীর্ঘায়িত করতে এর সঙ্গে আরেক ধরনের দ্রবণ মেশালেন তারা। পরিশুদ্ধ পারদ চূর্ণের সঙ্গে সিঁদুর মিশিয়ে চামেলী ফুলের রস অল্প পরিমাণে মিশ্রিত করা দ্রবণ তারা পরিমাণ মতো লাগিয়ে দিলেন মুরাদের বিশেষ অঙ্গে। একই সঙ্গে ছোট মৌমাছির চাক থেকে নেয়া মধুর সঙ্গে তেঁতুল বিচির গুঁড়াতে সিঁদুর মেশানো দ্রবণ তারা লাগালেন নিজেদের গুপ্তাঙ্গে। সারা রাত লম্বা প্রমোদ বিহারের জন্য চারজন প্রস্তুত হলেন। যশোবন্ত সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করা সাদা ধুতি পরা সৌম্য কান্তির ব্রাহ্মণটি গভীর রাতে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দিপালপুর এসে পৌঁছালেন। দীঘির কালো জলে ডুব দিয়ে কপালের তিলক ধুয়ে ফেললেন। গোছা চুলের টিকি বিসর্জন দিলেন। ব্রাহ্মণের বেশে খালি গায়ে ন্যাড়া মাথায় প্রচণ্ড শীতে কষ্ট পেলেও নিজ কর্তব্য পালন করতে পেরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন আকবার খান। আওরঙ্গজেবের বাছাই করা একান্ত গুপ্তচর তিনি। অনেক বড় দায়িত্ব দিয়ে তাকে শত্রু শিবিরে পাঠানো হয়েছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি যশোবন্ত সিংকে দ্বিধায় ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। যদিও আরও কাজ অবশিষ্ট আছে। বিচক্ষণ শাহজাদা আওরঙ্গজেবের নির্দেশনা মোতাবেক কিছুদিন পর মোল্লা সেজে দেখা করতে হবে আরেক সেনাপতি কাশিম খানের সঙ্গে। তার কাছে কাফের দারার গীবত গাইতে হবে। সেই সঙ্গে ধর্ম প্রচারের অজুহাতে অন্য সৈন্যদের বোঝাতে হবে তারা যেন মুসলমান হয়ে আরেক মুসলমান ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করেন। পুঁটলি থেকে পশমের আলখেল্লা বের করে গায়ে জড়িয়ে দক্ষ হাতে নকল দাড়ি ও পরচুলা পড়ে অন্ধকারে মুরাদের শিবিরে মিশে গেলেন সেই ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণ আকবার খান। তার ফেলে দেয়া চুলের টিকি ভাসতে থাকল দিপালপুরের শান্ত দীঘিতে। ঠিক সেই সময় কর্কশ শব্দ তুলে রাতের নিস্তব্ধতাকে বিদ্ধ করে ধবধবে সাদা ডানার এক লক্ষ্মী প্যাঁচা মুরাদের তাঁবু ঘেঁষে উড়ে গেল। তিন নগ্নিকার পাশে শুয়ে নির্ঘুম মুরাদ সেই প্যাঁচার ডাকে ফিরে যান গুজরাটে সবুজ নয়না মেহজাবীনের সঙ্গে কাটানো সোহাগ রাতগুলোতে। সেই কথা ভেবে আবার উত্তেজিত বোধ করতে থাকলেন রতিক্লান্ত শাহজাদা। (চলবে)
×