ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চিকুনগুনিয়ার মহামারী রূপ ও আরও কিছু কথা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ১৫ জুন ২০১৭

চিকুনগুনিয়ার মহামারী রূপ ও আরও কিছু কথা -স্বদেশ রায়

সপ্তাহের বেশি হলো চিকুনগুনিয়ায় ভুগছি। শুধু আমার পরিবারের সকলেই নয়, গত কয়েকদিন হাসপাতাল-ডাক্তারে দৌড়াদৌড়ি করে, আর বন্ধু-বান্ধবের টেলিফোনের কারণে জানতে পারছি ঢাকায় এটা মহামারী রূপ নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিজ্ঞানী অধ্যাপক আ. ব. ফারুক সুহৃদ হিসেবে ফোন করেছিলেন। তার কাছে জানতে পারলাম বিশ বছর আগের থেকে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ঢাকা শহরে দেখা যায় তবে এবার মহামারী রূপ নিয়েছে। ড. অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহর কাছ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি। তিনি তার নিজস্ব উদ্ভাবনীতে এ রোগের জন্য কিছু বাড়তি ওষুধ দেন যার ফলে যতটা শারীরিক কষ্ট পাওয়ার কথা তেমনটি আমরা পাইনি। কলকাতা ও দিল্লী থেকেও কয়েক সাংবাদিক বন্ধু ফোন করেছিলেন। তাদের শহরও এক সময় এ চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হয়েছিল। তারা সেখানকার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মত নিয়ে জানালেন, যেন বেশ সাবধানে থাকি। ডাক্তারের কথা মতো নিয়ম মেনে চলি। কারণ চিকুনগুনিয়া ব্রেনে এ্যাফেক্ট করে। ব্রেনে যে এ্যাফেক্ট করে তা মাত্র কিছুদিন আগে এক বন্ধুর ক্ষেত্রে বুঝতে পেরেছি, তিনি পাঁচ ঘণ্টা স্মৃতিশূন্য হয়ে গিয়েছিলেন। তার ব্রেন ওই সময় কোন কাজ করছিল না। কোন কথা শুনতে বা বুঝতে পারছিলেন না। প্রফেসর আবদুল্লাহর ওখানে গিয়ে যা বুঝতে পারি, তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। শুধু আমাদের মতো তার পরিচিত যত পরিবারের সকলেই তার কাছে হাজির হচ্ছেন- ঠেলা সামলানো তার জন্য কঠিন। আর তারপরে হাসপাতাল ও চেম্বারও আছে। যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুর, আবার বনানী থেকে বারিধারা সর্বত্র যেখানে যত পরিচিত আপনজন আছেন তাদের অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত। সোমবার বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে প্রফেসর আবদুল্লাহ ভাই আমাদের রিপোর্ট দেখতে দেখতে জানাচ্ছিলেন তার অসহায়ত্বের কথা। বললেন, এত রোগী সামলাবেন কীভাবে। আর তার মত হলো, এ রোগ আরও বাড়বে। কারণ এই যে বর্ষা হচ্ছে, এই বর্ষা তো ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বর্ষা নয়। এই বর্ষার পরের দিন আবার রোদ উঠবে, তাতে আরও মশা জন্ম নেবে। অর্থাৎ আরও বাড়বে এই চিকুনগুনিয়া। ঘরে ঘরে সবাই গুডনাইট কিনছে, ইনসেক্টকিলার বাল্ব লাগাচ্ছে। চেষ্টা সকলেই কম করছেন না। তবে চেষ্টায় আর কতটুকু ঠেকাবে! কারণ বাইরে যদি লাখ লাখ মশা জন্মাতে থাকে এক একটা ড্রেনেÑ সে সময়ে ঘরের ভেতর কয়টা মশা ঠেকানো যাবে। ঢাকার দুই মেয়রই আপনজন। উত্তরের মেয়র বিশেষ বন্ধু, দক্ষিণের মেয়র বড় ভাইয়ের ছেলে। দুজনের বিরুদ্ধে কড়া কথা লেখা বেশ কষ্টের। কারণ বয়স হচ্ছে। নতুন করে আর বন্ধু হবে না। আর যারা বড় ভাই ছিলেন তাদের ছেলেদের কড়া কথা লিখি কীভাবে? সাংবাদিকতা করলে এমনি বন্ধুত্ব হারাতে হয়। খুশি করা যায় না কাউকে। এমনকি পাঠককেও। যে পাঠক এক লেখার নিচে মন্তব্য লেখেন ভাল লিখেছেন অন্য লেখার নিচে মন্তব্য লেখেন দালালি আর কত করবেন। হাসি মুখে সব কিছু গ্রহণ করতে হয়। এখন মনে হয় বাঙালী যৌথ পরিবারের মায়ের মতো না হলে সাংবাদিকতা করা যায় না। যে যাই বলুক না কেন, হাসি মুখে সব নিতে হবে আর কোন ফলের বা লাভের আশা না করে যেটা নিজের মনের কাছে ভাল মনে হবে সেটাই লিখে যেতে হবে। যার সমালোচনা করছি তিনিও শক্র নন, যার প্রশংসা করছি তিনিও বাড়তি আপনজন নন, সকলেই সমান। তবে দুই মেয়রকে বলছি, রাস্তাঘাট পরিষ্কার বা হকার উচ্ছেদের জন্য যেমন ক্রাশ প্রোগ্রাম নিয়েছেন আপনারা তার থেকে অনেক বেশি ক্রাশ প্রোগ্রাম নেয়া প্রয়োজন এই মশা মারার জন্য। টাকার অভাব থাকলে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলুন। তিনি ছাড়া মুহূর্তে সমাধান দেয়ার মতো দেশে আর কেউ নেই। আগে এমনকি আশির দশক অবধি দেখেছি এ ধরনের কোন মহামারী দেখা দিলে সরকারের পাশাপাশি একটি সামাজিক শক্তি নেমে পড়ত। এখন সামাজিক সংগঠন হিসেবে ছাত্র সংগঠনগুলোর সেই তাড়না নেই। নেই অন্য কোন সামাজিক শক্তির। দেশ ও সমাজের জন্য কাজ করার চেয়ে তারা নিজের ভাগ্য পরিবর্তনকেই যেন এখন বড় মনে করেন। ঢালাও ভাবে বলতে রাজি নই, কারণ বেশ বড় মন নিয়ে ভাল ভাল অনেক কিশোর তরুণ আমার কাছে আসে। মনে হয় ওদের দিয়ে অনেক কাজ করানো যেত। অথচ অনাদরে এ ফুলগুলো ঝরে যাচ্ছে। কোন মালি নেই বাগানে, তাই আগাছার চাপে এ ফুলগাছগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার পরেও ছাত্র সংগঠন বা তরুণদের প্রতি বলব নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে ঢাকার মশা মারার পথে নামতে। তারা যেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো আবার সরকারের কয়েক কোটি টাকার মশা মারার প্রজেক্টে ভাগ বসানোর জন্য সময় কাটানোর চেষ্টা না করে। সপ্তাহখানেক ধরে দেশের হাসপাতাল, ডাক্তার ও ল্যাবরেটরি ইত্যাদিতে দৌড়াদৌড়ি করে আর যে অভিজ্ঞতা হলো তা যদিও নতুন কিছু নয়। আর শুধু যে চিকিৎসা ক্ষেত্রে তা নয়, সবখানে। তার পরেও বলতে হয়, আমি যেমন আমার পেশায় দেখতে পাই মেশিনের পেছনের লোকটির অভাব হচ্ছে দিনে দিনে। সবাই কোন মতে তাড়াহুড়ো করে পথ পাড়ি দিতে চায়, পড়াশোনা বা জানাশোনা নিয়ে তাদের তত তাড়া নেই। তাই বিল্ডিং হচ্ছে, দামী মেশিন হচ্ছে কিন্তু কাজের মান যাচ্ছে নেমে। লেখা ভাল না হলে যেমন পত্রিকার কাটতি দিন দিন কমে যায়, তেমনি ডাক্তারের সুনামের ঘাটতি হয় যদি তিনি ল্যাবরেটরি থেকে সঠিক রেজাল্ট না পান। ডাক্তাররাও যদি বাড়তি পড়াশোনায় মন না দেন। সিনিয়রদের পেছনে লেগে থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন না করেন। এই মেশিনের পেছনের মানুষ তৈরির দায়িত্ব ছিল রাজনীতিকদের। তারা নিজেদের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে ব্যস্ত। এই তো সেদিন পার্লামেন্টে এক সংসদ সদস্য দেশের একজন খ্যাতিমান ডাক্তার প্রাণ গোপাল দত্তকে এক হাত নিলেন। তিনি বললেন, তার আমলে নাকি অনেক ভাল যন্ত্রপাতি এসেছিল বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে। কিন্তু তিনি সঠিক কাজ করেননি। অথচ তিনি যে প্রাইভেট হাসপাতালটির মালিক সেটা ভাল চলছে। এ ধরনের বক্তব্য অসাধু ইঙ্গিত। প্রাণ গোপাল দত্ত যে হাসপাতালের মালিকানা নিয়ে আছেন সেটা তার একার নয়, পঞ্চাশজন ডাক্তার মিলে সেটা তৈরি করেছেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তার এই তথ্য জেনে পার্লামেন্টে বলতে হতো। আর এই ধরনের রাজনীতিকরা অনেক ক্ষেত্রে দ-মু-ের কর্তা বলেই ভালকে খারাপ বলা হয়, আবার খারাপকে ভাল। প্রাণ গোপাল ও বর্তমান ভিসি এই দুই ভিসির আমলেই বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের অনেক উন্নতি হয়েছে। তা আমরা যারা সাধারণ, যাদের কম পয়সায় সারাক্ষণ সেখান থেকে চিকিৎসা নিতে হয়, তারা জানি। ওই সব সংসদ সদস্য থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা যান চিকিৎসা নিতে, তাই তারা সে উন্নতি ধরতে পারেন না। হ্যাঁ, ভাল মেশিন এসেছে, প্রাণ গোপাল আনিয়েছিলেন তবে কেন তিনি মেশিনের পেছনের সব লোক ভাল ভাবে তৈরি করতে পারলেন না, তার খোঁজ কি ওই রাজনীতিক নিয়েছেন? তিনি কি কোন দিন বর্তমান ভিসির কাছেও খোঁজ নিয়েছেন যে ভিসি হয়েও তাকে কী পরিমাণ রাজনৈতিক নিয়োগের মামলায় কোর্ট কাছারি করতে হচ্ছে। আর সেখানেও কোন ধরনের খেলাধুলা চলে। তা নিয়েও আবার সবটুকু লেখা যাবে না। আবার আমাকে অর্থদ- দিতে হবে, না হয় জেলে যেতে হবে। দেশের মানুষ বুঝতে পারছেন না, বিচার বিভাগে বসে যারা মুনতাসীর মামুনের ভাষায় হাসিনা খালেদার থেকে বেশি মিডিয়ার স্পেস নিচ্ছেন, সে সব ব্যক্তি ধ্বংসের কোন দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে কোর্ট কাছারিকে। বাস্তবে আমরা শুধু বড় বড় কথা শুনি আর ওপর থেকে দেখি। যেমন মাঝখানে ডাক্তার আবদুল্লাহকে জামিন নিতে হলো। তবে ডাক্তার আবদুল্লাহও জানেন না, তার বিরুদ্ধে যে সব বীর পঙ্গুব গিয়ে হাজির হয়েছিলেন তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? তারা কি তাদের বন্ধুর মৃত্যুর জন্য আবেগে গিয়েছিলেন? না পুলিশের কাছে যে খোঁজ আছে সেটাই সত্য। তারা মূলত তিন কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছিল? মূলত ওই মৃত্যুকে ঘিরে তারা একটি চাঁদাবাজির সুযোগ পেয়েছিল। আর এই চাঁদাবাজিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, বামপন্থীÑ সব এক হয়ে গিয়েছিল। তাদের সন্তুষ্ট রাখতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার প্রক্টরকে অনুমোদন দিলেন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিরুদ্ধে অন্যায় কেস করতে। চমৎকার সব ঘটনা আর কি! চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত শরীর নিয়ে সব কিছু সঠিকভাবে ভাবতে পারছি না। তার পরেও মনে হচ্ছে কোথায় চলেছি আমরা। সবখানেই মানব সম্পদ তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছি। তার পরেও দু-একজন যা হচ্ছেন তাদের হতে হচ্ছে হেনস্থা। অন্যদিকে চিকুনগুনিয়া এপিডেমিক রূপ নিয়েছে তার পরেও মশা মারার উদ্যোগ নেই। আবার অবৈধ অর্থের গন্ধ পেলে সেখানে গড়ে উঠছে মহাঐক্য। অবৈধ অর্থ যদি এমনিভাবে জাতীয় ঐক্যের মূল চাবিকাঠি হয় তখন সত্যিই জাতিকে বাঁচানোর জন্য ভাবতে হবে। অপেক্ষা করলে ক্ষতি আরও বেড়ে যাবে। [email protected]
×