ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্কুল-কলেজ সরকারীকরণ

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ১৫ জুন ২০১৭

স্কুল-কলেজ সরকারীকরণ

শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান হাল কি তা বোঝার জন্য বিজ্ঞানী বা গবেষক হওয়ার যে দরকার নেই তা শিক্ষিত জনগণ তথা দেশবাসী মাত্রই উপলব্ধি করতে পারেন। যেন তেন স্কুল ও কলেজ যেভাবে সরকারীকরণ হচ্ছে, তাতে অনিয়ম ও বৈষম্য এবং বিধিবিধান লঙ্ঘনের মাত্রা ক্রমশ যে বাড়ছে তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বেসরকারী স্কুল ও কলেজ সরকারী বা জাতীয়করণে আর্থিক লেনদেন, তুলনামূলক ভাল ও পুরনো কলেজ বাদ দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত নতুন স্কুল ও কলেজকে সরকারীকরণসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ বেশ প্রচারিত। এমপিওভুক্ত না হওয়া প্রতিষ্ঠানও সরকারীকরণের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। দেখা গেছে, উচ্চ মাধ্যমিকে মাত্র এক বা দুজন পরীক্ষা দেয় এমন প্রতিষ্ঠানও আছে তালিকায়। এসব ঘটনার প্রতিবাদে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ক্ষোভ বিক্ষোভের ঘটনা এবং হরতালও হয়েছে। এমনকি সরকারীকরণের দাবিতে পঁয়তাল্লিশ বছরের পুরনো কলেজের শিক্ষক ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের লাঠিপেটা এবং শিক্ষকসহ দুজনের মৃত্যু বিভীষিকাময় পরিস্থিতিও দেশবাসী অবলোকন করেছে। ইতোমধ্যে ২৮৫টি বেসরকারী কলেজ সরকারীকরণের লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সম্মতি মিলেছে। সে আলোকে শীঘ্রই পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষামন্ত্রী এরই মধ্যে সংসদকে জানিয়েছেন, দেশের যে সব উপজেলায় সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ নেই, সে সব উপজেলায় একটি করে বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি করে কলেজ সরকারীকরণের লক্ষ্যে কাজ চলছে। শুনে মনে হবে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য কী আপ্রাণ প্রচেষ্টাই না চালানো হচ্ছে। কিন্তু আদতে তা নয়। বরং শিক্ষাকে আরও বিপত্তিকর অবস্থায় ঠেলে দেয়া যে হচ্ছে, তা নিকটকালের ঘটনাগুলোই উন্মোচন করে দেয় বিশৃঙ্খলার মাত্রা কেমন। দেশে এখন সরকারী কলেজের সংখ্যা তিনশ’ পঞ্চান্নটি। সরকার গত বছরের শেষে প্রতিটি উপজেলায় একটি হাইস্কুল ও একটি কলেজ সরকারীকরণের পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারী কলেজ নেই এমন তিন শ’ পনেরোটি উপজেলায় বেসরকারী কলেজ সরকারীকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা বাস্তবায়ন কাজ চলছে এখন। এগুলো যুক্ত হলে সরকারী কলেজের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক হবে। হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ করায় শিক্ষক সমস্যা বাড়ছে। বেসরকারী কলেজে অযোগ্য লোকও শিক্ষক হয়েছে। সরকারী কলেজের শিক্ষকরা বিসিএস ক্যাডারের, তাই কলেজ শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। শিক্ষা মানসম্মত না হলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। ভিত্তি দুর্বল হলে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। কাজেই সরকারীকরণ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান নিয়ে ভাবা জরুরী। সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হচ্ছে না। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং শিক্ষার মান নিশ্চিত করা না গেলে ‘সকলই গরল ভেল।’ যে কোন দেশের উন্নয়নের মূল শর্ত হচ্ছে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ। সরকারীকরণ মানে শুধু সরকারী তহবিল থেকে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়নের দায়িত্বও সমানভাবে সবার ওপর বর্তায়। সরকারীকরণ হলেই শিক্ষার মান বাড়বে এমনটা নয়। বেসরকারীভাবে ভাল চলতে থাকা প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের পর মানের অবনতি ঘটছে এমন দৃষ্টান্ত অনেক। প্রতিটি জেলায় একটি করে জেলা স্কুল রয়েছে সেই পাকিস্তান যুগ থেকে। সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার অবস্থাটা যে কী, তা কর্তৃপক্ষও বলতে পারে না। পরীক্ষার ফলাফলে এদের অবস্থান অনেক নিচে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তথা কতিপয় মানদ- ও শর্তগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ করা ছাড়াই যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ অর্থ ও শিক্ষার অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের তদ্বিরের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। আর এসব কারণে ভাল মানের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ করা হয় না। দেখা গেছে, অনেক উপজেলায় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সরকারীকরণ করা হয়নি। আবার অনেক উপজেলায় বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠান এ সুবিধা পেয়েছে। সব মিলিয়ে একটি অপরিকল্পিত অবস্থার উদাহরণ এসব কার্যক্রম একত্রিত হবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কিন্তু এর সুফল ও কুফল নির্ধারণ করা না গেলে বৃথাই হবে শেকড়ে জল ঢালা। আমরা চাই পরিকল্পিতভাবে সরকারীকরণ করা হোক বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনে। বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব কিছু বিবেচনায় এনে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলায়, তবেই দেশ অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে আরও অগ্রসর হতে পারবে।
×